দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ আবারও জাতীয় চরিত্রের কয়েকটি দিকের মুখোমুখি করল আমাদের। এর প্রথমটিই হচ্ছে, জাতি হিসেবে আমরা চরম ইনডিসিপ্লিনড, বিশৃঙ্খলাপরায়ণ। আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক ব্যাপারে শৃঙ্খলার অভাব আমাদের অগ্রগতিকেই শুধু বাধাগ্রস্ত করে না, কখনো কখনো জাতীয় বিপর্যয়ও ডেকে আনতে পারে। এ রকম আলামত দেখা যাচ্ছে বর্তমানে করোনাভাইরাসের স্লোলি বাট স্টেডিলি বিস্তারলাভের ক্ষেত্রে। আমাদের জাতীয় মঙ্গলের জন্য কিছু করতে বললে আমরা প্রথমেই প্রশ্ন তুলি কেন করব? না করলে কী হবে? দেখি না কাজটি না করলে কী হয়, এত ব্যস্ততা কিসের। এইসব। আবার যারা অতি চালাক বা বেশি স্মার্ট তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে কী করে কাজটি না করে কর্তৃপক্ষের চোখে ধুলা দিয়ে পার পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে ছেলেবেলায় শোনা গল্পটি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দেই। সেই যে রাস্তার পাশে দেয়ালের গায়ে কর্তৃপক্ষ লিখেছিলেন, ‘এখানে প্রস্রাব করিবে না। করিলে ৫০ টাকা জরিমানা’। পাড়ার দুষ্টমতি কয়েকটি ছোকরা আবার ওখানেই জলবিয়োগ করবে, না করলে যেন তাদের ভাত হজম হবে না। তারা করল কি, রাতের অন্ধকারে ‘করিবে না’ কথাটির পরের দাঁড়িটিকে স্থানচ্যুত করে ‘না’-এর আগে বসিয়ে দিল। ফলে কথাটি হয়ে গেল : ‘এখানে প্রস্রাব করিবে। না করিলে ৫০ টাকা জরিমানা’। এরপর জরিমানার ভয়ে যাদের জলবিয়োগের প্রয়োজন নেই তাদেরও কর্মটি করতে তৎপর হয়ে ওঠা বিচিত্র না। মোট কথা, যে কোনো আদেশ-নির্দেশ-উপদেশ কী করে না মেনে ওটাকে কলা দেখাতে হয় সে ব্যাপারে আমরা নানাভাবে আমাদের মেধার পরিচয় দেই।
আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে যে—কোনো কাজ আজ না করে কাল পর্যন্ত না করার ফন্দি-ফিকির বের করা। সেই স্কুল বালকের মত যে আজ নয় কাল থেকে মাথা বেঁধে পড়াশোনা শুরু করব করব করতে করতে হঠাৎ একদিন দেখে আগামীকাল থেকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু। সে তখন রাত জেগে মুখস্থ করে : ‘অ্যা স্টিচ্ ইন টাইম, সেভস্ নাইন,’ সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের নয় ফোঁড়ের সমান। কিন্তু তার অবস্থা তখন এমন যে, নয় ফোঁড় তো দূরের কথা, একটা ফোঁড় দেওয়ারও সময় ও সামর্থ্য তার নেই।
চীনে যখন করোনাভাইরাস আক্রমণ করল, আমরা তখন ওটাকে চীনের আঞ্চলিক সমস্যা মনে করে নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকলাম। অবশ্য আমাদের কপাল মন্দও বলতে হবে। এই মহামারিটার উদ্ভব ঘটল এমন একটা সময়ে যখন আমাদের কর্তৃপক্ষ মহাব্যস্ত মুজিববর্ষের মত একটি শতবর্ষীয় অনুষ্ঠানের মহাআয়োজনে। আর এর ঢেউ তখন লেগেছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার শহর-বন্দর-গ্রাম, রাজপথ-গলিপথ-আলপথে। আর আমাদের সুপ্রাচীন ‘বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ’ সংস্কৃতির নেতাকর্মীরা তখন ‘কার আগে প্রাণ কে করিবে দান’ জজবায় জরজর হয়ে জয়কেতু উড্ডয়নে ব্যস্ত। আর এই ফাঁকে করোনাভাইরাস সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়ল ১৭ কোটি আদমসন্তান অধ্যুষিত এই ভূখণ্ডে। যেন ‘পশিল কৌশলে কলি নলের শরীরে’ (মাইকেল মধুসূদন দত্ত : মেঘনাদবধ কাব্য)। অবশ্য চীনে জন্মগ্রহণকারী করোনা দস্যুকে শুরুতে যারা পাত্তা দেয়নি তাদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যও আছে। তারা ভেবেছিল, সাত সাগর পাড়ি দিয়ে করোনা তাদের দেশে পৌঁছাতে পারবে না। ভাবটা যেন যে বাড়িতে আগুন লেগেছে সে বাড়ি থেকে তিন-চারটা বাড়ি পার হয়ে আগুন আমার বাড়িতে আসতে পারবে না। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি এ আগুন যে সে আগুন নয়, এটা অস্ট্রেলিয়া-ক্যালিফোর্নিয়ার সাম্প্রতিক দাবানলের মত সর্বগ্রাসী দাবানল। এখন তারা একে ঠেকানোর জন্য জানা-অজানা সব ব্যবস্থা নিচ্ছে। বাইরের জগৎ থেকে নিজেদের প্রায় পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে, এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না বলে নিত্যনতুন হুকুম-আহকাম জারি করছে। একই প্রক্রিয়া চলছে ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা মহাদেশের সর্বত্র। সবখানেই নানা প্রকার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে। তবে সবই ইংরেজিতে, যাকে বলে রি-অ্যাকটিভ, প্রতিক্রিয়ামূলক, প্রো-অ্যাকটিভ বা প্রতিষেধকধর্মী খুবই কম। এর কারণে যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মত দেশেও কিছু বুঝে ওঠার আগেই এই মড়ক দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে, প্রাণ হারিয়েছে শত শত ব্যক্তি।
তবে সবচেয়ে করুণ অবস্থা ইতালির। চীনের পরেই দস্যু করোনা যে দেশটিকে অজ্ঞাত কারণে টার্গেট করেছিল, তা ইতালি। আর ইতালির প্রতিক্রিয়া ছিল মন্থর। তারা অতি দ্রুত যাবতীয় ব্যবস্থা না নিয়ে ‘আচ্ছা, দেখি কী হয়’ বলে গয়ং গচ্ছ নীতি অবলম্বন করে। ফলে করোনা অতি দ্রুত দেশটিকে কাবু করে ফেলে। কয়েক হাজার লোক মারা গিয়ে ভয়াবহতার দিক দিয়ে তারা চীনকেও ছাড়িয়ে যায়। বিলম্বে গৃহীত কঠোর পদক্ষেপগুলো সময়মত নিলে ইতালি হয়ত এই ট্র্যাজেডি এড়াতে পারত।
সময়মত ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয় সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও হংকং। ফলে এসব দেশে ইতালির মত তাণ্ডব সৃষ্টি করতে পারেনি করোনা। এই দেশগুলোর ব্যবস্থাপনার কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম ছিল অতি দ্রুত সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ ও তার সার্বিক প্রয়োগ। অর্থাৎ যে শহর বা অঞ্চলে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে শুধু সেই স্থানেই পরিচ্ছন্নতা অভিযান, জনসমাবেশ ও সামাজিক মেলামেশার ওপর কড়াকড়ি আরোপ এবং ‘লকডাউনই’ নয়, অন্যান্য এলাকা, যেগুলো আক্রান্ত হয়নি সেগুলোতেও এরূপ কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে করোনার অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করা হয়েছে। বলা যেতে পারে, করোনার সঙ্গে মল্লযুদ্ধে করোনা আঘাত করার আগে করোনাকেই আঘাত করা হয়েছে আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে। এভাবে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ যেসব দেশে নেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে ‘অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স’ নীতি যারা অনুসরণ করেছে, সেগুলোতে করোনা সুবিধা করতে পারেনি। এটাই সময়ের এক ফোঁড়ের সুফল।
এখানে লক্ষণীয় বিষয়, এসব দেশের কর্তৃপক্ষ করোনার আবির্ভাব সূচিত হওয়ামাত্র তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় আর সব কিছুকে গৌণ ঘোষণা দিয়ে মানুষের জীবন রক্ষার্থে করোনা প্রতিরোধ অভিযানকে সর্বোচ্চ স্থান দেন। আর এই ধরাধামে প্রথম যে দেশে করোনা হানা দেয় সেই চীনের হুবেই প্রদেশের বাইরে এই আততায়ী যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বিশাল দেশ চীনের কর্তৃপক্ষ ত্বরিত সব রকমের ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন। ফলে চীনে করোনা হুবেই প্রদেশেই এক রকম গৃহবন্দি বা লকডাউন হয়ে পড়ে। আর দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করার ফলে এই দেশে নতুন সংক্রমণও শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। তবে ভুলে গেলে চলবে না চীন, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং বা দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্তৃপক্ষকে সেসব দেশের জনগণ পুরোপুরি সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছে। সরকার বা প্রশাসন তাদের যখন যেমনটি করতে বলেছে তারা তা-ই করেছে। তারা গল্পের ‘করিবেন না’র পরের দাঁড়ি চিহ্ন অন্যত্র সরিয়ে দিয়ে পুরো ব্যবস্থাকেই ভণ্ডুল করে দেয়নি। এর অন্যতম প্রধান কারণ ওইসব দেশের মানুষের আশৈশবের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শৃঙ্খলাবোধ। এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো আমাদের দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি কেমন, কেমন আমাদের শৃঙ্খলাপরায়ণতা। আর এই অনুষঙ্গগুলো যে কোনো জাতির অস্তিত্বের জন্য, সাফল্যের জন্য, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মত অপরিহার্য।
সেই সঙ্গে আরেকটি কথাও বলা উচিত। যে কোনো দেশের সরকার যদি ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের স্বার্থকে তুচ্ছ জ্ঞান করে জনস্বার্থকে সব ব্যাপারে, সব কিছুতে সর্বোচ্চ স্থান দেয়, তা হলে সেই দেশের আপামর জনসাধারণের আস্থা অর্জন করতে তারা সফল হয়। তখন মারি ও মড়ক, যুদ্ধবিগ্রহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যাই আসুক না কেন সরকারের ডাকে তারা অকুণ্ঠ সমর্থন দেয়। সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যে কোনো নির্দেশ নির্দ্বিধায় পালন করে। অন্য দিকে সরকার ও জনগণের মধ্যে আস্থার সংকট সৃষ্টি হলে সরকারের যে কোনো ভালো উদ্যোগকেও তারা সন্দেহের চোখে দেখে। তখন একই কর্মকৌশল অন্য দেশে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় শতভাগ সফল হলেও আস্থাহীন সরকার ও সন্দেহবাতিক জনগণের দেশে তা সফল হয় না। আবার কখনো কখনো দেখা যায় দেশের কোনো তথাকথিত অতি ক্ষমতাধর ও ‘আমি কী হনুরে’ মার্কা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নিজেদের কার্যকলাপ দ্বারা সরকারকে জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলেন। অতি সম্প্রতি (২১ মার্চ) আমাদের দেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনের ঘটনাটি এ রকম একটা অবিমৃশ্যকারিতার উদাহরণ। দলমতনির্বিশেষে সারা দেশের মানুষ উপনির্বাচনটি পেছানোর দাবি জানালেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি গোঁ ধরেন তারা ওই দিনেই নির্বাচন করবেন। তা না হলে যেন তাদের জমিদারি লাটে উঠবে। ঢাকা-১০ আসনটি রাজধানীর ধানমণ্ডি ও তৎসন্নিহিত এলাকাসমূহ নিয়ে গঠিত। জনদাবি উপেক্ষা করে ওই আসনে যখন উপনির্বাচন করবেন বলে ঘোষণা দিলেন নির্বাচন কমিশন, তখন সারা দেশে কাঁপুনি দিয়ে করোনাভাইরাস হামলে পড়ি পড়ি করছে। একদিকে সরকার ও সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য দপ্তর জনগণকে বলছেন, ‘নিতান্ত ঠেকায় না পড়লে ঘরের বাইরে যাবেন না,’ অপরদিকে বিজ্ঞ নির্বাচন কমিশন ঢাকা-১০ আসনে ভোটের দোকান খুলে ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করছেন ভোট দিতে যেতে। ভাবটা এমন, গুলি মারেন আপনার করোনা-ফরোনাকে, আগে ভোট দিয়ে প্রমাণ করুন আপনি সুনাগরিক। হ্যাঁ, এ রকম প্রমাণ দিলেন বটে বাপের ব্যাটা কিছু সাহসী ভোটার। তবে তাঁদের সংখ্যা কুল্লে শতকরা ৫ ভাগের সামান্য বেশি। জানি না, তাতেই নির্বাচন কমিশন খুশিতে বগল বাজাচ্ছেন কিনা। কিন্তু শতকরা ৫ ভাগ ভোটারের উপস্থিতির নির্বাচনের জন্য নিশ্চয়ই এই কমিশনকে স্বাধীনতা পদক বা ওই রকম কিছু দেওয়া যেতে পারে। (অবাক হবেন না। এর চেয়ে কম কৃতিত্বের জন্যও এই সেদিন এক ব্যক্তিকে—যার নামও কেউ কোনোদিন শোনেনি—সরকার সাহিত্যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পদকটি দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য ভুল বুঝতে পেরে থুক্কু দিয়ে ওই নামটি কেটে দেওয়া হয়। এসব কর্মকাণ্ডের জন্যই বিদূষককে প্রায়ই বলতে শোনা যায় : কী বিচিত্র এই দেশ সেলুকাস!) আরো মজার ব্যাপার হলো, এক যাত্রায় পৃথক ফল দেখা গেল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, বগুড়া, যশোর ইত্যাদি আসনের উপনির্বাচনের বেলায়। ওইসব নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। কিংবদন্তির বিদূষক এবার হয়ত বলবে : দাল মে কুচ কালা হ্যায় মালুম হোতা।
করোনা আক্রমণের শুরু থেকেই সরকারি লোকজন বলে আসছেন আমরা প্রস্তুত আছি, আমাদের প্রস্তুতির কোনো ঘাটতি নেই। এদিকে বহিরাগতদের বিনা পরীক্ষাতে বিমানবন্দর ত্যাগ করার ঘটনা থেকে শুরু করে ভাইরাস পরীক্ষার যন্ত্রপাতি ও উপকরণের ঘাটতির কথাও মিডিয়ার কল্যাণে আমরা বরাবর শুনে আসছি। সর্বোপরি যা যৎসামান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাও ঢাকাকেন্দ্রিক। আবার এও মনে হচ্ছে, কর্তৃপক্ষ শুধু ‘সাবান দিয়ে ভালো করে হাত পরিষ্কার করবেন’ ‘গৃহবন্দি হয়ে থাকবেন’ ‘ছোঁয়াছোঁয়ি, কোলাকুলি করবেন না’ ইত্যাদি মার্কা নির্দেশ দিয়ে ফটোসেশন করতেই ব্যস্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) কর্তাব্যক্তি টেড্রোস আধানম গ্রেব্রিয়েসিস শুরু থেকেই তারস্বরে বলে চলেছেন ভাইরাস আছে কিনা তা দেখার জন্য পরীক্ষা করো, পরীক্ষা করো, পরীক্ষা করো। অর্থাৎ রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষার বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের দেশে তো পরীক্ষা করার উপকরণেরই অভাব। এমনকি ডাক্তার-নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতিরোধমূলক পোশাকেরও তীব্র অভাব। এমতাবস্থায় অবশেষে চীন খয়রাতি হিসেবে কিছু পরীক্ষা-উপকরণ, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য গাউন ইত্যাদি নাকি পাঠিয়েছে। কিন্তু তা নিশ্চয়ই পর্যাপ্ত নয়। এই পরিস্থিতিতে যা যা বিদেশ থেকে সংগ্রহ করতে হবে তা নগদ মূল্যে কেনার জন্য পকেটে টাকা নিয়ে একটি টিম চলে যাওয়া উচিত ছিল সিঙ্গাপুর, টোকিও, লন্ডন প্রভৃতি জায়গায়। এতে নিয়ম-কানুন-পদ্ধতির দিকে তাকালে চলবে না। তবে হ্যাঁ, এই মওকায় দুর্নীতিবাজ অসৎ চক্রটি যাতে ফোকটে টু-পাইস বানাতে না পারে সেদিকেও অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
করোনাভাইরাসের মত একটি দানবকে সামলাতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। অন্যান্য অনেক ব্যাপারের মত পাছে আবার কাউকে কৃতিত্বের ভাগ দিতে হয় এই আশঙ্কায় সরকার যদি একলা চলার নীতি আঁকড়ে ধরে থাকেন তবে ভুল করবেন। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। এই যে সরকারের নির্দেশনা মানছে না পাবলিক, তার জন্য তো জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি। আমাদের মানুষের মানসিকতা যে এ রকমই তা কি আমরা জানি না। কর্তৃত্ববাদী শাসন যদি আমাদের দেশের মানুষ মানত, তা হলে তো পাকিস্তানিদের হটানো যেত না এদেশ থেকে। কাজেই প্রশাসন, সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ, যাই ব্যবহার করেন না কেন সাফল্য নির্ভর করবে জনগণকে পাশে পাওয়ার ওপর। আর এটা সম্ভব জনপ্রতিনিধিদের সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে, স্থানীয় সরকারকে দায়িত্ব দিয়ে। এই মুহূর্তে দেশে ক’টি ইউনিয়ন পরিষদ, ক’জন সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর মাঠে নেমেছেন জানতে পারি কি? তারা কি কেবল কিল মারার গোঁসাই? ভাতের ভাতার হবার দায়িত্বে কি তাদের কোনোদিন দেখা যাবে না?
বাতাসে একটা গুঞ্জরন শোনা যাচ্ছে। আশা করব, যা রটে তার কিছুও বটে না হয়। পাকিস্তানি আমলে কোথাও কলেরা বা বসন্তে ৫০ জন মারা গেলে প্রশাসনের ওপর অলিখিত নির্দেশ ছিল যেন কমিয়ে ৫/৭ জন বলা হয়। এটা অবশ্যই ছিল মিথ্যাচার ও আত্মঘাতী। করোনাতে সংখ্যার হেরফের করে দিনশেষে অবশ্যই বলা সহজ : ‘আমাদের তৎপরতার জন্য অন্যান্য সব দেশের তুলনায় আমাদের দেশে সংক্রমিতদের সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা অনেক কম’। এটা হবে পুরোপুরি মিথ্যাচার ও আত্মঘাতী।
বলছিলাম কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা, যা আমাদের দেশে কোনো দিনও প্রতিষ্ঠা পাবে না। ওই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, এমনকি এলাকাপ্রধান যা বলবেন, যে হুকুম দেবেন সেটাই ‘হানড্রেড পারসেন্ট’ শিরোধার্য। এর ভেতর আর কোনো যদি-কিন্তু-কেন নেই।
তা হলে শেষ করি আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র চীনের কিছুকাল আগের একটা গল্প দিয়ে। তখন আমেরিকার সঙ্গে চীনের বৈরী সম্পর্ক আস্তে আস্তে নাতিশীতোষ্ণ হতে চলেছে। এ রকম সময়ে বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন কমেডিয়ান বব হোপ শুভেচ্ছা সফরে গেছেন চীনে। একদিন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো চীনের সেনাবাহিনীর একটি গ্যারিসনে, যেখানে শত শত সৈনিক সারিবদ্ধভাবে বসে আছে তার হাস্য-কৌতুক উপভোগ করতে। মুশকিল হলো ভাষা নিয়ে। বব হোপ চীনা ভাষা জানেন না, সৈনিকরাও ইংরেজি ভাষার একটা হরফও বোঝে না। তখন রফা হলো, বব হোপ ইংরেজিতেই তাঁর ‘জোক’ বলবেন, আর পরে ওই গ্যারিসনের যিনি ইংরেজি ভাষা জানা কমান্ডার তিনি চীনা ভাষায় ওটা অনুবাদ করে শোনাবেন তাঁর সৈনিকদের। তাই হলো। বব হোপ তাঁর দীর্ঘ জোকটি ইংরেজিতে রসিয়ে রসিয়ে শোনালেন হাজিরানে মজলিসকে। তারপর গ্যারিসন কমান্ডার চীনা ভাষায় কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করতেই সৈনিকরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল একজন আরেকজনের ওপর। বব হোপ তো অবাক। তিনি কমান্ডারকে বললেন, শুনেছি চীনা ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি ভাষা, কিন্তু তা যে এতটা সমৃদ্ধ তা তো জানতাম না। আমার ওই দীর্ঘ জোকটির তরজমা আপনি কয়েকটি চীনা শব্দেই করে ফেললেন। সত্যি, অপূর্ব আপনাদের ভাষা। কমান্ডার তখন বললেন, আরে না, আমাদের ভাষা সমৃদ্ধ-ফমৃদ্ধ কিছু না। আসলে আমি নিজেও আপনার ইংরেজিতে বলা জোকের সবকিছু বুঝিনি। আমি শুধু আমার বাহিনীকে বললাম, কমরেডস্, মাননীয় মার্কিন অতিথি একটা দারুণ ‘জোক’ শুনিয়েছেন। তোমরা হাসো। আর অমনি…।
কর্তৃত্ববাদ জিনিসটা অবশ্যই ভালো না। তবে মাঝে মাঝে ওষুধ হিসেবে বোধ হয় খুব খারাপ না। তখন করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে জাতি গৃহবন্দি থাকবে—এ রকম একটা চরম নির্দেশ দিলেও বোধ হয় একটা বান্দাও ঘরের বাইরে যাবে না।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি