মহামারী সংক্রমণবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থা এপিআইসি (অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোফেশনালস ইন ইনফেকশন কন্ট্রোল অ্যান্ড এপিডেমোলজি) বলছে, করোনাভাইরাসের আক্রমণ ঠেকাতে প্রত্যেকেরই উচিত মুখ, চোখ, নাক, কান স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকা। এটা যদিও কষ্টকর একটি কাজ কিন্তু এটা মেনে চলা এই ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষা করা একটি প্রধান উপায়। তারা বলছেন, মুখ ও নাকের মিউকাস হাতের সংস্পর্শে এলে অথবা হাতে লেগে থাকা জার্ম মুখ ও নাকের মিউকাসের সংস্পর্শে গেলে এই ভাইরাস দেহে প্রবেশ করার সুযোগ পায়। প্রথমে ফুসফুস আক্রান্ত হয়, পরবর্তীতে কিডনি, পাকস্থলী ও দেহের অভ্যন্তরীণ অন্যান্য অঙ্গগুলো সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুর কারণ ঘটায়। ফক্স নিউজ।
কিন্তু মুখের সংস্পর্শ থেকে হাতকে কি সহজে দূরে রাখা যায়? এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি ঘণ্টায় একজন মানুষ গড়ে তার মুখ হাত দ্বারা ২৩ বার স্পর্শ করে। গত সপ্তাহে ক্যালিফোর্নিয়ার হেলথ ডিপার্টেমেন্টের এক কর্মকর্তা সান্তা ক্লারা কাউন্টি বলেন, ‘অভ্যাস গড়ে তুলুন যাতে সহজে মুখ হাত দ্বারা স্পর্শ করতে না হয়। এটা যদিও হাইজিনের ফর্মুলার মধ্যে পড়ে না, কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এটা অত্যাবশ্যক। ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইনফেসশাস ডিজিসের (এনএফআইডি) ডাক্তার উইলিয়াম শাফনারও একই বার্তা দিয়েছেন। এ ব্যাপারে শাপনার কয়েকটি টিপস দিয়েছেন, যা অনুশীলন করলে মুখ স্পর্শ করা থেকে হাতকে সহজে বিরত রাখা যায়। যেমন :
হাত যাতে সহজে মুখের কাছে না যায় সে জন্য বারবার নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য আপনার হাতঘড়ি বা মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রাখুন এবং প্রয়োজনে নোটবুক ব্যবহার করুন। প্রয়োজনে আপনার হাতের আঙুলে একটি পট্টি বা ফিতা অথবা কাপড়ের টুকরো বেঁধে রাখুন, যেটা আপনাকে মনে করিয়ে দিবে যে হাত মুখের সংস্পর্শে আনা যাবে না। সুগন্ধযুক্ত লোশনও ব্যবহার করা যেতে পারে। যেটা মনে করিয়ে দেবে আপনার কার্যকলাপ সম্পর্কে এবং হাতকে নানা কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে। উইলিয়াম শাফনারের আরো পরামর্শ হলো বসা অবস্থায় হাত দুটো কোলে ভাঁজ করে রাখুন বা এক হাত দিয়ে অন্য হাত ধরে রাখুন। এটাও আপনাকে মনে করিয়ে দেবে যে মুখের কাছে হাত নেয়া যাবে না। তিনি বলেন, আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। হাতে সারাক্ষণ পরিষ্কার এক টুকরো রুমাল রাখুন যাতে হাঁচি কাশি এলে রুমালটি ব্যবহার করা যায়। প্রয়োজন হাতের কনুই ব্যবহার করুন, তবুও মুখে হাতের তালু ব্যবহার করা যাবে না। ভালো হয় ওয়ান টাইম ইউজড টিস্যু ব্যবহার করা।
নিচের চারটি টিপস ফলো করা জরুরি : করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে পরামর্শ দিয়েছে, সেগুলো মেনে চলা খুব একটা কঠিন বিষয় নয়। যেমন : সুস্থ থাকলেও বাড়িতেই অবস্থান করতে হবে। যেসব ব্যক্তি ঘন ঘন হাঁচি-কাশি দেয়, তাদের কাছ থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে হবে। সাবান দিয়ে ঘন ঘন হাত ধুতে এবং হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
তবে শেষের দিকের পরামর্শটি মেনে চলা খুব একটা সহজ হয়ে উঠে না। কার্যত প্রত্যেকেই অভ্যাসগতভাবে প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে মুখ স্পর্শ করে থাকে। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবের সময়ে বর্তমানে মুখ স্পর্শ করা খুবই বিপজ্জনক। কারণ মুখ, নাক ও চোখ আর্দ্রতার কারণে এখানে জীবাণুর পরিমাণটা বেশি থাকে। আর এসব স্থান স্পর্শের সময়ে জীবাণুগুলো শরীরে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়ে যায়। যদিও বলা হয়, সংক্রমিত ব্যক্তির কাছাকাছি থাকলে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, কিন্তু সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে অন্য কোনো স্থান, কঠিন জড়বস্তুর তল বা জায়গা থেকেও যে কেউ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। আমেরিকান একাডেমি অব ডারমাটোলজির মুখপাত্র ডেবরা জেলিমান সংক্রমণ রোধে চারটি পরামর্শের কথা উল্লেখ করেছেন :
১. মানুষ তার অবচেতন মনেই সারা দিন ঘণ্টায় গড়ে ২৩ বার মুখ স্পর্শ করে। গত সপ্তাহে এ সম্পর্কে ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা ক্লারা কাউন্টির জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরিচালক সারা কোডি এ ঘোষণা দিতে গিয়ে অবচেতন মনে বারবার তিনি তার মুখ হাত দ্বার স্পর্শ করেছেন; যা কিনা পরবর্তীতে বেশ ভাইরাল হয়ে যায়। নিউ ইয়র্কের ‘প্রসবিটারিয়ান হাসপাতাল ওয়েল-কর্নেল স্কুল অব মেডিসিনের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ গেইল সাল্টজ বলেন, কিছু করতে নিষেধ করার কথা বললে সেই কাজটি আরো মনে বেশি বেশি করার ইচ্ছে জাগে। অবচেতন মনের এই ইচ্ছাটাকে দমন করে রাখাই হবে সংক্রমণ রোধের একটি উপায়।
২. বিভিন্ন কারণে মানুষ তার মুখ স্পর্শ করে। এ ক্ষেত্রে মুখ স্পর্শ করার সংখ্যা কমিয়ে আনতে আগে বের করুন মুখের কোনো কোনো স্থান আপনি বেশি বেশি স্পর্শ করছেন এবং কেন স্পর্শ করেন। আমরা মুখের বিষয়ে বেশি সতর্ক। এর কারণ আমরা বস্তুগতভাবে মুখ এবং মাথার দ্বারা (দেখা, শোনা ও হাসি) দ্বারা আমাদের আবেগ ও সেন্স প্রকাশ করি। এমনকি স্ট্রেস ও হতাশার কারণেও মুখ স্পর্শ করে অনেকে। কিন্তু বর্তমানে মুখ স্পর্শ করা ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই করোনাভাইরাস সম্পর্কে নিউজ দেখা, সচেতনতামূলক প্রচার পড়া বা শোনা এ ক্ষেত্রে আপনাকে মুখে হাত দেয়ার ঘটনাকে কমিয়ে আনতে পারে।
৩. মুখ স্পর্শ করার সময় অন্য আচরণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। মুখ স্পর্শ করার তাগিদ অনুভূত হলে আপনি মুখ নয়, দেহের অন্য কোনো জায়গা স্পর্শ করুন। এভাবে মুখ স্পর্শ করার অবস্থা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা জরুরি। প্রয়োজন হলে আপনার হাতটি ধরে রাখুন অথবা হাতের ওপর বসে থাকুন। বিষয়টি হাস্যকর হলেও এ মুহূর্তে এই অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করলে কয়েক সপ্তাহ পর মুখে হাত দেয়ার অভ্যাস কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা যাবে। এতেও যদি কাজ না হয়, তা হলে আপনার মোবাইলে ঘন ঘন অ্যালার্ম বাজানোর ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। এটি আপনাকে বলে দেবে, মুখ স্পর্শ করা যাবে না। এ ব্যাপারে সতর্ক হন।
৪. শুধু মুখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকলেই কি করোনার সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করা যাবে? না, এ ক্ষেত্রে সংক্রমণের অন্য বিষয়গুলোও সতর্কতার সাথে মেনে চলতে হবে। মুখ স্পর্শ না করা এই ভাইরাস থেকে বাঁচার একটিমাত্র উপায়। সে ক্ষেত্রে অন্য বিষয়গুলোও সতর্কতার সাথে মেনে চলতে হবে। সিডিসির মতে, অন্যান্য প্রতিরোধের কৌশলগুলো অবশ্যই মনে চলতে হবে। বাথরুম, ঘরের মেঝে ও ঘরের অন্যান্য তল পরিষ্কার রাখা, বিশেষ করে অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করে ধোয়াÑ এগুলো যথাযথভাবে পালন করে যেতে হবে।