বিগত রোজার মাসে গরুর গোশতের দাম কেজি ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকায় ঠেকে। এর কয়েক মাস আগে থেকেই গোশতের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। দীর্ঘ সময় চড়া থাকার পর অবশেষে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গরুর গোশতের দাম কমতে শুরু করেছে। ঢাকায় গত সপ্তাহ থেকে বিক্রি হচ্ছে ৬০০-৬৫০ টাকায়। প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ কেন কমছে গরুর গোশতের দাম?
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি ইমরান হোসেন বলেন, খামার পর্যায়ে এখন গরুর দাম কম। খামারিরা নিজেরাও গরু জবাই করে কম দামে গোশত বিক্রি করছেন। খামার থেকে কয়েক দফা হাতবদল না হলে ক্রেতাদের চড়া দামে গোশত খেতে হতো না বলে মনে করেন তিনি।
রাজধানীর শাহজাহানপুর, মোহাম্মদপুর, মালিবাগ, রামপুরাসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি গরুর গোশত ১৫০-২০০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কোথাও আবার ৫৫০ টাকা কেজিতেও বিক্রি করতে দেখা গেছে। গোশতের দোকানের বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গ্রামগঞ্জে গরুর দাম কমেছে। গরুর সরবরাহও বেশি। তাই দাম কমিয়ে গোশত বিক্রি করা হচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে গোশতের উৎপাদন ছিল ৮৭ লাখ টন। ওই বছর দেশের বাজারে গোশতের চাহিদা ছিল ৭৬ লাখ টন। ফলে চাহিদার তুলনায় ১১ লাখ টন বেশি গোশত উৎপাদিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত গো-খাদ্যের উচ্চমূল্যের কারণে গরুর দাম বেড়ে যায়। ফলে এর প্রভাব পড়ে গোশতের বাজারে। তবে, খামারিরা এখন বিকল্প খাবারে যাচ্ছে। তারা উন্নতমানের উচ্চফলনশীল ঘাস চাষ করছেন। খরচ কিছুটা হলেও কমে আসছে।
খামারি ও ভোক্তারা বলছেন, সরকার এই সুযোগে গরুর গোশতের দাম বেঁধে দেয়া উচিত। তা হলে সারা বছরই দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এ দিকে, ভারত থেকে মহিষের গোশত আমদানির অনুমতি চেয়ে আমদানিকারকরা যে আবেদন করেছিল তা নাকচ করে দিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
অন্য দিকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ভুয়া হালাল সনদ ব্যবহারের অভিযোগে গত সপ্তাহে হালাল সনদযুক্ত সব ধরনের পণ্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই খবরে নড়ে চড়ে বসেছেন বাংলাদেশের হোটেল ব্যবসায়ীসহ এ খাতের উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, ভুয়া হালাল সনদযুক্ত গোশত বাংলাদেশে এলে মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতি বিনষ্ট হবে। ফলে দেশী গোশতেই ভরসা রাখতে চান তারা।
বিডিএফএ সভাপতি ইমরান হোসেন বলেন, সবজি-মাছের বাজারে ভোক্তা অধিকার অভিযান পরিচালনা করলেও গরুর গোশতের বাজারে করে না। ফলে ব্যবসায়ীরা খেয়ালখুশি মতো দাম নির্ধারণ করে। এখনো একেক এলাকায় একেক দামে গোশত বিক্রি হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে গরুর গোশতের দাম কেজি ৬০০ টাকা বেঁধে দেয়ার জন্য বারবার বলা হলেও, এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
ইমরান হোসেন বলেন, গত জুলাইয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সাথে বৈঠকে খামার পর্যায়ের গরুর গোশত কেজিতে ৫০ টাকা কমে বিক্রির ঘোষণা দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে গোশত ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে আমরা একাধিকবার বৈঠক করেছি। গোশতের দাম কমাতে খরচ কমাতে খামারিদের উচ্চফলনশীল ঘাসে নির্ভরশীলতা বাড়ানোর বিষয়ে জেলায় জেলায় খামারিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এতে খরচ কমলে গোশতের দাম আরো কমবে। তিনি বলেন, ঢাকায় ‘ফারমার্স মার্কেট’ চালুর বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে (ডিএনসিসি) প্রস্তাবনা দিয়েছি। পশু খাদ্যের দাম কমানো, বিদ্যুতে ভর্তুকি বাড়ানো, উন্নত প্রজাতির গরুর জাত উন্নয়নসহ সরকার নীতি-সহায়তা দিলে ৫০০ টাকায় গোশত বিক্রি করা যাবে।
গোশত আমদানির অনুমতি মেলেনি
গত সেপ্টেম্বরে ভারত থেকে ৫০ লাখ টন মহিষের গোশত আমদানির অনুমতি চেয়ে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (আইবিসিসিআই) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়। এ ছাড়া গত বছরের ৭ জুলাই বাংলাদেশে মহিষের গোশত রফতানির অনুমতির অনুরোধ জানিয়ে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। একই সময়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে গোশত আমদানির অনুমতি চেয়ে শতাধিক আবেদন জমা পড়েছে। তবে কোনো প্রস্তাবেই সায় দেয়নি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
সবশেষ কিছু দিন আগে আইবিসিসিআই-এর ৭৫ হাজার টন গোশত আমদানির অনুমতি চেয়ে একটি চিঠি জমা পড়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে। নিয়মানুযায়ী চিঠিটি প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে পাঠানো হয়। তবে অন্যান্যবারের মতো এবারো অধিদফতর গোশত আমদানির বিপক্ষে মত দিয়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশীদ বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিঠি দিলেও বরাবরই গোশত আমদানির বিষয়ে আমাদের সম্মতি ছিল না বা থাকবেও না। এখনো বলছি, আমরা গোশতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। রফতানি করব এখন। এ জন্য আমাদের কিছু কার্যক্রমও আছে। অনেক দেশ আমাদের কাছে গোশত চাইছে। গোশতজাত পণ্য যাতে রফতানি করতে পারি সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
হালাল সনদ নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ
ভারতের উত্তর প্রদেশে গত রোববার থেকে ‘হালাল’ সনদযুক্ত সব ধরনের পণ্য উৎপাদন, সংগ্রহ বা স্টোরেজ, বণ্টন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভারতের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ভারতের জমিয়তে উলামা হিন্দ হালাল ট্রাস্ট দিল্লি, হালাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া মুম্বাই, জমিয়ত উলামা মহারাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি সংস্থা গোশত রফতানির ক্ষেত্রে হালাল সনদ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ‘হালাল’ সনদযুক্ত খাবার ও পণ্যের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এ সুযোগে ভুয়া ‘হালাল’ সার্টিফিকেট তৈরি করে ব্যবসায়ীরা গোশত বিক্রি করেন। এর আগে একই অভিযোগে ২০২১ সালে গোশত রফতানির ম্যানুয়াল থেকে ‘হালাল’ শব্দ বাদ দিয়েছে ভারতের কৃষিজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রফতানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এপেডা)।