শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৬ অপরাহ্ন

কোয়ারেন্টিনে থেকে ঝুঁকিতে পড়ছে মানসিক স্বাস্থ্য

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১১ এপ্রিল, ২০২০
  • ৩১৮ বার

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে এক আতঙ্কের নাম করোনা। অদৃশ্য শত্রু থেকে বাঁচতে গৃহবন্দি সবাই। অকোষী ভাইরাস যেন দখল করে নিয়েছে পুরো পৃথিবী। চারদিকে এক দমবন্ধকর পরিস্থিতি। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু সংবাদ অনেক বেশি অসহায় করে তুলছে মানবজাতিকে।

স্বাভাবিক জীবন ছেড়ে মানুষ হোম কোয়ারেন্টিনে দিনের পর দিন। করোনা ভাইরাসের এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা আবিষ্কার না হওয়ায় সারাবিশ্বে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকাটাই একমাত্র সমাধান মনে করা হচ্ছে।

ঠিক কবে এ থেকে মুক্তি মিলবে তাও অনিশ্চিত। এ অনিশ্চয়তা থেকেই মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা জানান দীর্ঘদিন গৃহবন্দি থাকায় মানুষের মাঝে সৃষ্টি হচ্ছে হতাশা। দেখা দিচ্ছে অস্থিরতা। এতে করে যাদের এনজাইটি ও উচ্চরক্তচাপ রয়েছে তাদের বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ভাবনা মানুষের মেজাজকে করে তুলছে খিটখিটে। যার প্রভাব গিয়ে পড়ছে পরিবার ও স্বজনদের ওপর।

অস্বাভাবিক এ অবস্থা শিশুদের ওপর ভীষণভাবে মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে।

এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে নানা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

যেভাবেই হোক এ সময়টা লকডাউনে থাকতে হবে; না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে উল্লেখ করে ইউনিভার্সাল মেডিক্যাল কলেজ রিসার্চ সেন্টারের প্রধান মো. রিদওয়ানউর রহমান আমাদের সময়কে বলেন : ঘরবন্দি থাকায় নানা রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তারা হাঁটতে পারছেন না। এর ফলে ওজন বেড়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে ডিপ্রেশন দেখা দিচ্ছে, দেখা দিচ্ছে মানসিক অস্থিরতা।

অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও আতঙ্কের কারণে উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।

এর কোনো ওষুধ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এ ভয়ভীতিগুলো দূর করতে হবে।

হাসপাতালে যেতে নিরুৎসাহিত করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা নিতে হবে। বাসায় বসে ফোন করে যারা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে কাউন্সেলিং করতে হবে ও তাদের দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে।

পরিশ্রম কম হওয়ায় ও টেনশনে ঘুম না হওয়ায় অস্থিরতা বাড়ছে উল্লেখ করে রিদওয়ানউর রহমান বলেন : এ কারণে অনেকের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। সে থেকে পারিবারিক কলহ সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে।

বন্দি এ অবস্থা শিশুদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এটি একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। বড়রা এটা মেনে নিতে পারলেও শিশুরা এ অবস্থার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারছে না।’

এ অবস্থায় থাকার জন্য শিশুদের বাধ্য করা হচ্ছে। স্কুলে যেতে পারছে না। খেলাধুলা করতে পারছে না। যে কারণে তারা কোনো কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছে না। হয়ে পড়ছে হতাশ। যারা সচেতন বাবা-মা তারা এ অবস্থায় শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন। বিভিন্নভাবে তাদের সন্তানদের প্রফুল্ল রাখছেন। কিন্তু যারা এটা পারছেন না বা করছেন না তাদের সন্তানরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।

দুঃসহ এ পরিস্থিতিতে কীভাবে সুস্থ-সুন্দর ও মানসিক চাপমুক্ত থাকা যায় সে উপায় জানিয়েছেন ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট মো. মাহবুবুর রহমান হৃদয়। আমাদের সময়ের পাঠকদের জন্য তার পরামর্শগুলো তুলে ধরা হলো।

শিশুদের অনন্দঘন পরিবেশ দিতে হবে : বাবা-মা’দের তাদের সন্তানদের সব সময় হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করতে হবে। শিশুদের সঙ্গে বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্ট নিয়ে খেলতে হবে। তাদেরক সময় দিতে হবে। একসঙ্গে বসে টিভি দেখা, যাদের ছাদ আছে ছাদে গিয়ে ফুটবল অথবা ক্রিকেট খেলা বা বাসার মধ্যে ছোট্ট পরিসরে খেলাধুলা করতে হবে।

পড়াশোনার জন্য চাপ নয় : শিশুদের পড়াশোনার জন্য চাপ না দিয়ে তাদের মতো করে লেখাপড়া করার সুযোগ দিতে হবে। তাদের সঙ্গে ছবি এঁকে, নাচ-গান করে তাদের ভালো রাখতে হবে।

সবাইকে এ অবস্থা মেনে নিতে হবে : আমরা একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সবাই আতঙ্কিত, অনেক বেশি ভীত হয়ে পড়ছি। যা থেকে আমাদের মানসিক চাপটা বাড়ছে যেটাকে জেনারেল আ্যাঙজাইটি ডিসর্আর বলে। আমাদের সবাইকে এ অবস্থাটা মেনে নিতে হবে। যত দ্রুত আমরা এটা মেনে নিতে পারব ততদ্রুত আমরা এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারব।

নিজেই নিজেকে সাহায্য করতে হবে : এ পরিস্থিতিতে নিজেই নিজেকে সাহায্য করা বা সেল্ফ হেল্পের কোনো বিকল্প নেই। যে এ কাজটা যত ভালো পারবে তার জন্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়া ততটাই সহজ হবে।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সহানুভূতিশীল আচরণ করতে হবে : এ পরিস্থিতিতে সবাই আতঙ্কিত। বিশেষ করে পরিবারে বয়স্ক যারা রয়েছেন তাদের নিয়ে অনেক বেশি দুশ্চিন্তা করছে সবাই।

বয়স্করা বাসায় থাকতে চান না। মসজিদ বা উপাসনালয়ে যেতে চান। তবে এ বিষয়ে রেগে না গিয়ে তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে। সহানুভূতি ও সহমর্মিতার সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পারস্পরিক যোগোযোগ বাড়াতে হবে : সারাদিনের একঘেয়েমি ও মন্দলাগা কাটাতে পারিবারের সদস্যদের সঙ্গে পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। বাবা-মা, ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে গল্প করে আড্ডা দিয়ে সুন্দর সময় কাটাতে হবে।

সামাজিক দূরত্ব নয় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে : মন ভালো রাখতে প্রিয়জনদের সঙ্গে ভার্চুয়াল যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এখানে সামাজিক দূরত্ব নয় বিষয়টা মূলত শারীরিক দূরত্ব। ব্যস্ততার কারণে অনেক সময় দেখা যায় আমরা আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে মাসে একবারও কথা বলতে পারি না। এ সময়টাতে আমরা নিয়মিত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি। এতে মানসিক বন্ধন দৃঢ় হবে।

অনলাইনে বিভিন্ন কোর্স করা যেতে পারে : ব্যস্ততার কারণে ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় অনেক কোর্স করা হয়ে ওঠে না। সে ক্ষেত্রে সময়টাকে কাজে লাগিয়ে অনলাইনে ছোট ছোট কোর্স করা যায়। নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে এ সময় অনলাইনে কারিগরি শিক্ষা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সসহ ফ্রি লান্সিং কোর্স করা যায়।

পুরুষরা ঘরের কাজে নারীদের সহায়তা করবে : পুরুষরা ঘরের কাজে স্ত্রী বা মা-বোনকে সহায়তা করতে পারে। এর ফলে পারস্পরিক বন্ধন দৃঢ় হবে এবং সংসারে নারীদের যে ভূমিকা সেটাও তারা অনুভব করতে পারবে।

পছন্দের কাজে সময় দিন : বই পড়া, গান শোনা, নাটক-সিনেমা দেখা, ছবি আঁকা, হাতের কাজ ও বাগান করা যেতে পারে। মূল কথা হলো যার যে কাজ পছন্দ সে কাজে সময় দিতে হবে।

সঙ্গীকে ভালোবাসুন : সারাদিন বাসায় থাকায় মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়ায় পারিবারিক কলহ সৃষ্টি হচ্ছে। কলহ এড়াতে সঙ্গীকে ভালোবাসতে হবে। তাকে সময় দিতে হবে। প্রতিটি মুহূর্তকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে।

নিয়মিত শরীরচর্চা করুন : করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ও মন ভালো রাখতে নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে। সেই সঙ্গে পুষ্টিকর খাবার ও ভিটামিন সিযুক্ত ফলমূল গ্রহণ শরীর সুস্থ রাখতে সহায়তা করবে।

হেল্পলাইন সেন্টারে পরামর্শ নিন : করোনা ভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় বিভিন্ন হেল্পলাইন খোলা হয়েছে। প্রয়োজনে সেখানে কথা বলে পরামর্শ নিতে হবে।

মহামারীর চেয়েও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস গত বছর ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের উহান প্রদেশে প্রথম শনাক্ত হয়। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারাদেশে ৩৩০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ২১ জন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৩২ জন। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে আছেন ৭২ জন। হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন ১০ হাজার ১৫৭ জন। আইসোলেশনে আছেন ৮৪ জন।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com