শিয়াল নানা ছল-চাতুরীতে গাধাকে নিয়ে গিয়েছিল সিংহের কাছে। সিংহের থাবা ফসকে গাধা প্রাণ নিয়ে পালিয়েছিল। ক্লান্ত ক্ষুধার্ত সিংহ শিয়ালকে আবারও অনুরোধ জানাল, যেভাবেই হোক গাধাটি ফুসলিয়ে আন। আমি ভীষণ ক্ষুধার্ত।
অনুরোধ রক্ষায় শিয়াল গাধার কাছে যায়। শিয়ালকে দেখে গাধা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। কেমন হারামি, বন্ধুত্বের ভাব দেখাতে এসেছ। কীভাবে আমাকে অজগরের মুখে ঠেলে দিয়েছ? নিষ্ঠুর! আমাকে জমদূত সিংহের হাতে তুলে দিলে? আমার কি কোনো দোষ ছিল, নাকি তোমার স্বভাবের দোষ। শয়তানের স্বভাব তো বিষাক্ত বিচ্ছুর মতো। ভদ্রলোক কোনো ক্ষতি না করলেও বিচ্ছু তার পায়ে কামড় বসায়। মানুষ শয়তানের কোনো ক্ষতি করে না, তারপরও মানুষকে সে বিপদে ফেলে। এটা তার স্বভাব।
আয পেয়ে হার আদমী উ নাকসালাদ
খো ও তাবএ যেশতে খোদ উ কায় হেলাদ
প্রতিটি মানুষের পেছনে নাছোড়বান্দা সে
অস্থি-মাংসের কুস্বভাব কীভাবে ছাড়তে পারে?
যাঁকে খুবসে যাতে উ বী মাওজেবী
হাস্ত সূয়ে জুলম ও উদওয়ান জাযেবী
কারণ স্বভাবের কদর্যতা ইতরামি তার অকারণে
জুলুম ও শত্রুতার দিকে টানে প্রচ- আকর্ষণে।
শয়তান প্রতি মুহূর্তে তোমাকে সুন্দর তাঁবুর দিকে ডাকে। কিন্তু আসলে তোমাকে কোনো গর্তে ফেলাই তার পরিকল্পনায় থাকে। শয়তান তোমার সঙ্গে বন্ধুত্বের ভাব দেখায়; অথচ এর পেছনে লক্ষ্য থাকে তোমাকে কীভাবে গোমরাহ করে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া যায়। তোমাকে বলবে ওখানে স্বচ্ছ-নির্মল পানির ঝরনার কূপ। কিন্তু সেই কূপে তোমাকে নিক্ষেপ করাই তার কুমতলব। চিন্তা করে দেখÑ
আদমী রা’ বা’ হামে ওয়াহয় ও নযর
আন্দর আফকান্দ আ’ন লয়ীন দর শূরো শর
ওহির জ্ঞান ও প্রখর মেধা সত্ত্বেও আদমকে সে
ফেলেছিল সে অভিশপ্ত নানা শোরগোলে ফাঁদে।
মানবজাতির আদি পিতা আদম (আ.) এত মেধা ও প্রতিভা আর ওহির জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও শয়তান নানা কারসাজি করে গন্ধম খাওয়ার প্ররোচনায় ফাঁদে ফেলেছিল। অথচ আদম (আ.) এর কোনো গোনাহ ছিল না, তিনি শয়তানের কোনো ক্ষতি করেননি। এরপরও অভিশপ্ত শয়তান অন্যায়ভাবে আদম ও হাওয়া (আ.) কে বেহেশত থেকে বহিষ্কারের আয়োজন করেছিল।
গোফত রোবাহ আন তেলেসমে সেহর বূদ
কে তো রা’ দর চশম আন শীরি নামূদ
বলল শিয়াল, তা তো ছিল জাদুর তেলেসমাত
তাতে সিংহর রূপে দেখেছ চোখে ছবি অবাস্তব।
শিয়াল বলল, যে জানোয়ারটি সিংহের মতো তুমি দেখেছ, আসলে তা সিংহ ছিল না; বরং জাদুর তেলেসমাত ছিল। তোমার কল্পনাশক্তি জাদুগ্রস্ত হয়েছিল তখন। ফলে একটি অবাস্তব অবয়ব তোমার চোখে বাস্তব সিংহ বলে মনে হয়েছে। তার প্রমাণ দেখ, আমি তোমার চেয়েও দুর্বল প্রাণী। অথচ দিনরাত আমি সেখানেই থাকি। সবুজ চারণভূমিতে বিচরণ করি। কই আমার তো কিছু হয়নি। বনে যদি সিংহের তেলেসমাত তৈরি করে রাখা না হতো, যে কোনো প্রাণী সেখানে নির্ভয়ে বিচরণ করত। তাতে চারণভূমি বিরানভূমিতে পরিণত হতো। নয়নজুড়ানো সবুজের মিতালি, বাতাসের গায়ে দোলে বন-বনানী, গাছগাছালি। হাতির পদবিক্ষেপ, হরিণের চপল নৃত্য, স্বপ্নের সবুজ বাগান সিংহের তেলেসমাত না থাকলে তৃণভোজী প্রাণীদের উৎপাতে সব উজাড় হয়ে যেত।
ভুলটা আমার হয়েছে। চেয়েছিলাম তোমাকে আগেই তালিম দিই, যদি এই বনে ভয়ানক কোনো দৃশ্য দেখ, মোটেও ভয় পাবে না। তোমাকে সেই জ্ঞান দেওয়ার কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আমার হৃদয়টা তোমার দরদে গদগদ ছিল। তোমাকে ক্ষুধায় কাতর খাড়া রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার হুঁশ ছিল না। নচেৎ তোমাকে বলে দিতাম, ওখানে একটি তেলেসমার শহর আছে। সেখানে কল্পনার কারুকাজ, চোখের ধাঁধা অবাস্তব সব কাজকারবার।
শিয়ালের বয়ান শুনে গাধা আরও রেগে গেল। বলল, দূর হও এখান থেকে। তুমি আমার জানি দুশমন, তোমার চেহারা আমি দেখতে চাই না দুই চোখে। যে খোদা তোমাকে হতভাগা করেছেন, তিনিই তোমার চেহারা এমন কদাকার, নির্লজ্জ করেছেন। কোন মুখে তুমি আমার কাছে এসেছ, কথা বলছ। গ-ারের চামড়াও তোমার মতো নির্লজ্জ নয়। তুমি আমাকে প্রাণে মারার ফন্দি করেছিলে। আর এখন বলছ আবারও তোমায় নিয়ে যাব বনে চারণভূমিতে? তোমার প্রতারণার ফাঁদে সেদিন আমি আজরাইলের চেহারা দেখেছিলাম। এমন ভয়াবহ দৃশ্য দেখলে যে কোনো শিশুও একদিনেই বুড়ো হয়ে যেত।
সেদিন প্রাণটা হাতে নিয়ে লাফ দিয়েছিলাম গভীর খাদে। ওলট-পালট ডিগবাজি খেয়ে নেমে আসতে সক্ষম হয়েছিলাম নিচে। আমার পা সেদিন অচল হয়ে গিয়েছিল। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, প্রভু হে! যদি এবার আমায় নাজাত দাও। আর কখনও কারও প্ররোচণায় কান দেব না। আল্লাহ সেদিন আমার হৃদয়নিংড়ানো আকুতি শুনেছিলেন। ফলে মুহূর্তে পায়ে শক্তি ফিরে এসেছিল। মনে হয়েছিল, বন্ধনমুক্ত হয়েছি। নচেৎ মুহূর্তে সিংহ আমার ওপর হামলে পড়ত। সেই সিংহ ফের তোমায় পাঠিয়েছে নতুন ছলেবলে কৌশল নিয়ে।
হক্কে যাতে পাকে আল্লাহুস সামাদ
কে বুয়াদ বেহ মা’রে বদ আয য়া’রে বদ
অমুখাপেক্ষী পবিত্র সত্তা আল্লাহর দোহাই
দুষ্ট সাপ উত্তম দুষ্ট বন্ধু থেকে, সন্দেহ নেই।
দুষ্ট সাপ দুষ্ট বন্ধুর চেয়ে অনেক উত্তম এ কথা অকাট্য সত্য; তবে কোন যুক্তিতে তা মওলানা রুমি বুঝিয়ে দিচ্ছেনÑ
মারে বদ জানী সেতানদ আয সলীম
য়ারে বদ আ’রদ সূয়ে নারে মুকীম
দুষ্ট সর্প বড়জোর করে দংশিতের প্রাণ হরণ
দুষ্ট বন্ধু নিয়ে যায় যেখানে জাহান্নাম চিরন্তন।
দুষ্ট সাপ যখন ছোবল হানে, তখন দংশিত বিষক্রিয়ায় প্রাণ হারায়। কিন্তু দুষ্ট বন্ধুর সাহচর্য জাহান্নামে নিয়ে যায়। মানুষ কোনো কথাবার্তা বা ঘোষণা ছাড়াই বন্ধুর স্বভাব-চরিত্র নিজের মধ্যে চুষে নেয়। সে তা টেরও পায় না। মনোবিজ্ঞানও বলে, যে যাকে ভালোবাসে তার স্বভাব-চরিত্র মনের অলক্ষে নিজের মধ্যে সংক্রমিত হবেই। শুধু তা-ই নয়। অসৎ বন্ধু যখন তোমার ওপর ছায়া বিস্তার করে, তখন তোমার নিজের সৎ, সুন্দর স্বভাব ও আধ্যাত্মিক সম্পদ অলক্ষে চুরি হয়ে যায়। এজন্যই বলা হয়, সৎসঙ্গে স্বর্গবাস অসৎসঙ্গে সর্বনাশ।
গাধার কথায় বাধা দিয়ে শিয়াল বলল, আমি পরিষ্কার ভাষায় কথা বলতে ভালোবাসি। তুমি অমূূলক ধারণায় আক্রান্ত বলেই এসব যুক্তিতর্কের আশ্রয় নিচ্ছ। অবাস্তবকে বাস্তব মনে করাই কল্পনা। তুমি মনের সে কল্পনায় ভাসছ। এসব কাল্পনিক ধারণা অনুমানের কারণেই আজ সমাজে বাহাত্তর ফেরকার যন্ত্রণা। ফেরাউন এ জাতীয় কল্পনায় আক্রান্ত হয়েই খোদায়ি দাবি করে ধ্বংসের গহ্বরে তলিয়ে গেছে। আমি মনের দরদ থেকে তোমার মঙ্গলের জন্য ওখানে যেতে বলছিÑএ কথা তোমার বোঝা উচিত।
ক্ষুধার জ্বালায় গাধার তখন পৃথিবী গদ্যময়। এ সুযোগে দুনিয়ার লোভমোহ চেপে বসল তার অস্তিত্বজুড়ে। মুখে কথা বলার শক্তি নেই। খালি পেটই ভেতর থেকে কথা বলছে, তওবা করেছ তাতে কী। এখন তো ক্ষুধা তোমার পরহেজগারি মানছে না। প্রয়োজনে আবার তওবা কর। এখানে ক্ষুধায় কাতরানোর তো মানে হয় না। এর নাম তো জীবন নয়। এর চেয়ে মরণ অনেক উত্তম। কীসের পরহেজগারি। জীবনের সুখ দরকার। উন্নত জীবন চাই। শিয়ালের কথায়ও তো যুক্তি থাকতে পারে।
শেষ পর্যন্ত গাধা শিয়ালের সঙ্গে রওনা হলো বনে। সিংহ ঘুমের ভান করেছিল সাধুসন্ত সেজে। চারণভূমিতে গাধা আর শিয়ালের পদচারণা সে দেখেও দেখে না। গাধা এক পর্যায়ে সিংহের একেবারে কাছে গেল। অমনি সিংহ হামলা করে এক থাবায় ঘাড় মটকাল। টুকরো টুকরো করল। এত কাজের প্রচ- চাপে পিপাসার্ত সিংহ পানি পানের জন্য দূরের ঝরনায় গেল। এ ফাঁকে শিয়াল গাধার কলিজা ও গোর্দা খেয়ে সাবাড় করল।
সিংহ ফিরে এসে তালাশ করে প্রিয় খাবার কলিজা-গোর্দা। শিয়াল বলল, আসলে ওর কোনো কলিজা গোর্দা ছিল না। তার যদি কলিজা থাকত প্রথমবার আপনার থাবায় মৃত্যুর হাত থেকে পালানোর পর কি আবারও একই ফাঁদে পা দিত। কলিজা, গোর্দা, অন্তর, কলব, আত্মা বলে কিছু থাকলে সে কি আপনার কাছে আবার আসত? কেয়ামতের দিন অবস্থা হবেÑ
‘তারা বলবে, আমরা যদি দুনিয়ায় নবী-রাসুলদের কথা শুনতাম এবং আমাদের জ্ঞানশক্তিকে কাজে লাগাতাম, তাহলে আজ জাহান্নামিদের অন্তর্ভুক্ত হতাম না।’ (সূরা মুলক : ১০)।
চোন নবাশদ নূরে দিল দিল নীস্ত আন
চোন নবাশদ রূহ জুয গেল নীস্ত আন
যদি দিলে নুরের বাতি না জ্বলে দিল নহে তা
রুহ না থাকলে এ দেহ আস্ত মাটির দলা।
দিল, যাকে অন্তর, মন, হৃদয়, বিভিন্ন নামে অভিহিত করি, যদি তাতে নুর না থাকে, দিলের প্রদীপে যদি ওই জগতের আলো না জ্বলে তাকে দিল বলা যাবে না। তা প্রাণহীন নিথর দেহের মতো।
অন যুজাযী কূ নদারদ নূরে জান
বউল ও কারুরেস্ত কিন্দিলাশ মখান
যেই চেরাগে প্রাণের আলো না থাকে তাকে
চেরাগ না বলে মাটির চাটিই বলতে হবে।
বিদ্যুতের ব্যাপক ব্যবহারের আগে চেরাগ জ্বালিয়ে ঘরবাড়ি আলোকিত করা হতো। সেই চেরাগে আগুন ও আলো না থাকলে কি চেরাগ বলা হবে? বড়জোর মাটির চাটি বা কাচপাত্র বলা যাবে।
নূরে মিসবাহ আস্ত দাদে যুল জালাল
সানআতে খলকাস্ত অন শীশে ও সেফাল
চেরাগের আলো তা মহামহিমের দয়ারদান
মাটির বাটি ও কাচপাত্র মৃৎশিল্পের অবদান।
মানুষের দেহকাঠামোর অভ্যন্তরে যে অন্তর, তাতে আলো জ্বালাতে হলে আল্লাহর নুরের ঝলক চাই। সেই ঝলকের চরিত্র অভিন্ন। মানুষের দেহ ভিন্নভিন্ন; কিন্তু অন্তরের আলো অভিন্ন। দশটি চেরাগ সামনে রাখ, মনে হবে পরস্পর আলাদা, চেরাগ অতিক্রম করে আলোকে বিবেচনায় নাও দেখবে এক, অভিন্ন। কাফেররা চেরাগ দেখেছে। এ কারণে তারা ভিন্ন ভিন্ন পাত্রের পূজারি মোশরেক হয়েছে। যদি সবকিছুর অন্তরালের নুর দেখত, তাহলে খাঁটি মোমিন, আলোকিত আল্লাহর ওলিতে পরিণত হতো।
অন জুহুদ আয যরফহা’ মুশরিক শুদাস্ত
নূর দীদ আন মুমেন ও মুদরেক শুদাস্ত
সত্য অস্বীকারকারীরা পাত্র দেখে মোশরেক হয়েছে
সত্যিকার মোমিন সে আলোর পরশে ওলি হয়েছে।
সৃষ্টিলোকের বিভিন্ন বস্তুর ওপর নিত্য আল্লাহর তাজাল্লির বিচ্ছুরণ হচ্ছে, যারা বস্তুকেই বিবেচনায় নেয় তারা মোশরেক হয়ে যায়। যারা বস্তুর অন্তরালে তাজাল্লির সন্ধানী হয় তারা খাঁটি ঈমানদার হয়। মোমিন ও কাফেরের মাঝে বিশ্বাসে এ তফাৎ লক্ষণীয়।
(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-২৬০০-২৮৮৬)