তাপদাহের রেকর্ড ভেঙ্গে রেকর্ড হচ্ছে। গরমে অতিষ্ট হয়ে পড়েছে মানুষ। তাপদাহ বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোডশেডিং। একে তো তীব্র তাপদহ, এরওপর লোডশেডিংয়ের কারণে নির্ঘুম কাটে রাত। শহর বা গ্রাম সবজায়গায়ই প্রায় একই অবস্থা। তবে, শহরের চেয়ে গ্রামে লোড শেডিংয়ের মাত্রা বেশি। বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতার সাথে সঞ্চালন ক্ষমতা না বাড়ায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এমন দাবি বিদ্যুৎ বিভাগের। কিন্তু গ্রাহকদের প্রশ্ন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা বলে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। কয়েক বছরের ব্যবধানে বিদ্যুৎ বিল তিনগুণ পর্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু তারা এর কোনো সুফল পাচ্ছে না। অথচ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা গ্রাহকের পকেট থেকে চলে যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গতকাল বিদ্যুতের চাহিদা দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ১০০ মেগাওয়াট। বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৩০১ মেগাওয়াট। লোডশেডিং দেখানো হয়েছে ১ হাজার ৭১৮ মেগাওয়াট। কিন্তু প্রকৃত লোডশেডিং আরো বেশি বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) ও ন্যাশনাল লোড ডিসপ্যাচ সেন্টারের (এনএলডিসি) দৈনিক প্রতিবেদনে লোডশেডিংয়ের সঠিক তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে না। প্রকৃত লোডশেডিংয়ের পরিমাণ আরও বেশি।
একে তো তীব্র তাপদহ চলছে, দেশজুড়ে চলছে সপ্তমবারের মতো হিট অ্যালার্ট। দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। গতকাল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোরে ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমনি অবস্থায় ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কারণে মানুষ দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। ইট পাথরে ঘেরা শহরে লোডশেডিংয়ের কারণে টেকাই দায় হয়ে পড়েছে। আর গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের মাত্রা আরো ভয়াবহ। আমাদের কুমিল্লা প্রতিনিধি হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, মনোহরগহঞ্জ উপজেলায় আরইবি এলাকায় রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত মাত্র এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে। বাকি সময় লোডশেডিং করা হয়। এমনিতেই সারাদিন প্রচন্ড গরমে গাছ তলায় থাকা যায়, কিন্তু রাতে গরমে ঘরে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। কুমিল্লা শহরেও দিনে রাতে ৭ থেকে ৮বার বিদ্যুৎ থাকে না।
আমাদের বগুড়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জেলার সর্বত্র দিনে রাতে ৮ থেকে ১০ বার বিদ্যুৎ থাকে না। আর একবার গেলে কমপক্ষে এক ঘন্টা লোডশেডিং করা হয়। এ হিসেবে দিনে রাতে প্রায় অর্ধেক সময়ই বিদ্যুৎ বিহিন কাটাতে হচ্ছে। আমাদের সিলেট প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সিলেটেও দিনে রাতে ৮ থেকে ১০ বার লোডশেডিং হচ্ছে।
এদিকে গ্রামের মতো শহরেও লোডশেডিং হচ্ছে সমানতালে। গত সোমবার দিবাগত রাতে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র রামপুরা বনশ্রী বাসীর নির্ঘুম রাত কেটেছে। এমনিতেই প্রচন্ড তাপদহ। এরওপর রাতে প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় লোডশেডিং হয়েছে। ১০ মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ এসে এক ঘন্টা বিদ্যুৎ ছিল না। এভাবে সারারাতই চলে বিদ্যুতের লুকোচুরি। সব বয়সী মানুষই অনেকটা নির্ঘুম রাত কেটেছে।
বিদ্যুৎ বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে কথা বলে জানা যায়, চাহিদার বিপরীতে সারাদেশে ২,৫০০ থেকে ২,০০০ মেগাওয়াটের বেশি লোড-শেডিং করতে হচ্ছে গত কয়েকদিন ধরেই। তাপপ্রবাহের আগে গড়ে সাধারণত ৫০০-১,০০০ মেগাওয়াট লোড-শেডিং হতো। সোমবার হয়েছে ৩,২০০ মেগাওয়াট, যা ছিল এ বছরের সর্বোচ্চ লোড-শেডিং। আর গতকাল মঙ্গলবার হয়েছে ১ হাজার ৭১৮ মেগাওয়াট।
দেশের ৮০ শতাংশের বেশি গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে দেশের সবচেয়ে বড় বিতরণ কোম্পানি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। এই প্রতিষ্ঠানের এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বর্তমানে আমাদের বিতরণ এলাকায় যে চাহিদা রয়েছে, সেই তুলনায় বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। যার কারণে এই গরমের মধ্যেও বাধ্য হয়ে আমাদেরকে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। গ্রাম অঞ্চলে কোথাও কোথাও লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ১০ থেকে ১২ ঘণ্টাও করতে হচ্ছে। আরইবি সূত্রে জানা যায়, গত রোববার সারাদেশের গ্রামাঞ্চলে লোড-শেডিং হয়েছে ২,৮০০ মেগাওয়াটের বেশি।
রাজধানীতেই যদি একদিনে ১৪ থেকে ১৫ বার বিদ্যুৎ যায়, তাহলে ঢাকার বাইরে গ্রামাঞ্চলের কী ভয়াবহ অবস্থা! সরকারের শতভাগ বিদ্যুতায়নের এতো বাজে সুফল আর কখনো দেখিনি। একদিকে তীব্র দাবদাহ, আরেক দিকে ভয়াবহ লোড-শেডিং; ছোট বাচ্চা ও বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। দিন দিন যেভাবে হিটস্ট্রোক বাড়ছে, কোনো দিকেই শান্তির বার্তা পাচ্ছি না। এ কথা বলেন রাজধানীর রামপুরার বাসিন্দা মনির হোসেন।
পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাস ও কয়লা থেকে পরিকল্পনামতো উৎপাদন হচ্ছে। তবে বকেয়া বিলের জটিলতায় তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পুরোদমে উৎপাদন করা যাচ্ছে না। জ্বালানি তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এটি তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি করা যাচ্ছে না।