কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে রমজান মাসে রেস্তোরাঁগুলোতে ইফতার সামগ্রী বিক্রি করার অনুমতি দেয়া হলেও, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সাধারণ মানুষকে ঘরে তৈরি খাবারের ওপরই নির্ভর করার পরামর্শ দিচ্ছেন। কারণ রেস্তোরাঁ থেকে কেনা ইফতার সামগ্রীর মাধ্যমেই ছড়াতে পারে করোনাভাইরাস।
তারা মনে করেন, ইফতার সামগ্রী তৈরি করা থেকে শুরু করে বিতরণ পর্যন্ত যদি রেস্তোরাঁগুলো মহামারির ভয়ঙ্কর এই মুহূর্তে যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলে তাহলে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ক্রেতা এবং বিক্রেতারা স্বাস্থ্যবিধি এবং নিরাপদ দূরত্ব অনুসরণ করবে এমন শর্তে গত মঙ্গলবার থেকে দোকান ও রেস্তোরাঁগুলোতে ইফতার সামগ্রী বিক্রি করার অনুমতি দেয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
বৃহস্পতিবার নগরীর কয়েকটি রেস্তোরাঁ ঘুরে দেখা যায়, যারা ইফতার সামগ্রী তৈরি ও বিতরণ করছেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগই যথাযথভাবে গ্লাভস এবং মাস্ক ব্যবহার করছেন না। তারা বারবার খাবারে হাত দিচ্ছিলেন। আর এভাবেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এসব খাবারের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি।
রেস্তোরাঁগুলোতে সামাজিক দূরত্বের দিকনির্দেশনা না মেনে এবং খালি হাতেও খাবার স্পর্শ করতে দেখা গেছে অনেক গ্রাহককে। কিছু মানুষ এ নির্দেশনা মেনে চললেও বেশিরভাগ গ্রাহকের মধ্যেই এ বিষয়ে তেমন কোনো সচেতনতা দেখা যায়নি।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা ইউএনবিকে বলেন, ‘মানুষকে এই রমজানে যতটা সম্ভব বাড়িতেই থাকতে হবে কারণ কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা এখন বাড়ছে। যারা রোজা পালন করছেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি তাদের উচিত স্বাভাবিক এবং সহজে হজম হয় এমন খাদ্য গ্রহণ করা। সুরক্ষার জন্য তাদেরও ঘরে তৈরি ইফতার সামগ্রী গ্রহণ করা উচিত।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘রেস্তোরাঁ থেকে ইফতার সামগ্রী নেয়া এখন নিরাপদ নয়। আমাদের দেশের বেশিরভাগ রেস্তোরাঁগুলো তাদের ইফতার সামগ্রী উন্মুক্ত অবস্থায় রাখে এবং তাদের কর্মী ও গ্রাহকরা অনিরাপদভাবে সেসব খাবার স্পর্শ করে। আর এভাবেই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।’
‘তবে যেখানে সমস্ত কর্মীরা কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে, সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করে এবং তাদের খাবার প্যাকেটে রাখে, সেসব রেস্তোরাঁ থেকে লোকজন ইফতার সামগ্রী কিনতে পারেন। কিন্তু এ ধরনের রেস্তোরাঁ শহরে খুব কমই দেখা যায়। তাই এখন রেস্তোরাঁ থেকে খাবার ক্রয় না করাই উচিত বলে আমরা মনে করি,’ বলেন তিনি।
খান আবুল কালাম আজাদ আরো বলেন, কেউ যদি হোটেল থেকে খাবার ক্রয় করে তাহলে বাসায় নিয়ে এটি পুনরায় গরম না করে খাওয়া উচিত নয়।
পাশাপাশি খাবারগুলো প্যাকেট থেকে বের করার পর ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে এবং প্যাকেটগুলো একটি উপযুক্ত ডাস্টবিনে ফেলার পরামর্শও দেন তিনি।
ঢামেক অধ্যক্ষ বলেন, রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষকে তাদের সকল কর্মীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে যাতে কেউ ভাইরাসে আক্রান্ত না হন বা এর লক্ষণ না থাকলেও তারা যেন খাদ্য তৈরি ও বিতরণ প্রক্রিয়ায় জড়িত না থাকেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কোষাধ্যক্ষ এবং মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রত্যেকেরই এখন ঘরে তৈরি ইফতার সামগ্রী গ্রহণ করা উচিত।
তিনি বলেন, ‘আমার একজন সহকর্মী আমাকে বলেছেন যে, তিনি কোনো হোটেল কর্মী বা গ্রাহককে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মাস্ক ও গ্লাভস ব্যবহার করতে দেখেননি। এটি এখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কারণ রাজধানী এখনও করোনাভাইরাস সংক্রমণের হটস্পট।’
ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের (ডিসিএমসিএইচ) মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হারুন-অর-রশিদ বলেন, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে যখন সংক্রমণ বাড়ছে তখনই রেস্তোরাঁগুলোকে ইফতার সামগ্রী বিক্রি করার অনুমতি দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্তকে ন্যায়সঙ্গত বলা যায় না।
তিনি বলেন, ‘রেস্তোরাঁগুলোতে খাবার প্রস্তুত ও বিক্রি করার প্রতিটি পর্যায়ে করোনার সংক্রমণ হতে পারে কারণ রেস্তোরাঁ কর্মীরা এবং গ্রাহকরা স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন নন। আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে যে বর্তমান পরিস্থিতিতে হোটেলগুলো নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে সক্ষম নয়। সুতরাং, কোনো দোকান বা বাড়ির বাইরের রান্না করা ইফতার সামগ্রী এখন কেনা উচিত নয় কারণ এটি ভাইরাস সংক্রমণের কারণ হতে পারে।’
কী খাবেন এবং কী এড়াতে হবে:
ডা. আতিকুর রহমান বলেন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী রাখতে ইফতার ও সেহরিতে মশলাদার, তৈলাক্ত ও অতিরিক্ত ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত নয়।
‘যারা রোজা পালন করেন তাদের উচিত শাকসবজি, তাজা ফল এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা। অতিরিক্ত খাবার গ্রহণও এড়িয়ে চলা উচিত কারণ এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়। যাদের করোনার লক্ষণ যেমন কাশি, জ্বর বা শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা রয়েছে তাদের গরম জল এবং চা খাওয়া উচিত। গুরুতর দুর্বলতায় ভুগলে তাদের রোজা পালন করা উচিত নয়,’ বলেন তিনি।
ডা. আতিক আরো বলেন, ‘অতিরিক্ত ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার অস্বাস্থ্যকর যা বিভিন্ন রোগের কারণ হয়। ট্রান্স ফ্যাটগুলো প্রায়শই প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্টফুড, স্ন্যাকস, বিভিন্ন ভাজা খাবার সামগ্রী, বিস্কুট, কুকিজ এবং মার্জারিনে পাওয়া যায়। সুতরাং, রমজানের সময় এই খাবারগুলো এড়ানো উচিত।’
ডা. হারুন বলেন, ‘সাধারণত এই মাসে সবার মাঝে বেশি পরিমাণে খাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, তবে খাবারের তালিকা সম্পর্কে তাদের এখন খুব সতর্ক থাকা উচিত। সবার উচিত পর্যাপ্ত পানি এবং হাইড্রেটিং খাবার গ্রহণ করা। বিশেষ করে ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে।’ সূত্র : ইউএনবি