শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৩ পূর্বাহ্ন

দুর্যোগে নেতৃত্ব নেতিয়ে পড়ার দৃষ্টান্ত

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ৭ মে, ২০২০
  • ২৫৩ বার

রশীদ আহমদ:

নানামুখী উদ্যোগ নিয়েও করোনায় কাবু হয়ে গেছে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো। বিশ্বে নিজ দেশের বাইরে অন্যান্য দেশের ক্ষমতার চাবিকাঠির মালিক-মোক্তার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইতালি, স্পেন মাঠে মার খেয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে এ ইস্যুতে গরিব-ছোট কোনো কোনো দেশের চেয়েও তাদের করুণ দশা প্রমাণ হয়েছে। সময় যত গড়াচ্ছে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর এ অসহায়ত্ব আরো খোলাসা হয়ে পড়ছে। এই শক্তিমানদের কেউ কেউ একে অন্যকে শেষ করে দিতে সক্ষম। গোটা দুনিয়াকে মারণাস্ত্রে নিঃশেষ করার হিম্মতও আছে কারো কারো। কিন্তু, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি ভাইরাসকে মোকাবেলার সক্ষমতা কারো হয়নি-করোনা সেটা দেখিয়ে দিয়েছে।

বিশ্বের ক্ষমতাধর অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এমন ব্যক্তিদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার ডটন, মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম পি বার, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জায়ের বলসোনারো, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী সোফি গ্রেগোয়ার ট্রুডো, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাদিন ডরিস, স্পেনের রানি লেতিজিয়ার নাম উল্লেখ না করলেই নয়। তারা প্রত্যেকেই আধুনিক দুনিয়ায় ক্ষমতার অনন্য ব্যক্তি। নিজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে তারা অনেক কিছু ঘটিয়ে দিতে পারেন। দিচ্ছেনও। এই দাপটশালীরাই  করোনাকালে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়া দূরে থাক, নিজেরাও নিরাপদ থাকতে পারেননি। করোনার কাছে ক্ষমতার বদলে অসহায়ত্বের সঙ্গে তাদের সীমিত, ক্ষুদ্রের চেয়েও ক্ষুদ্র দিকটার প্রকাশ ঘটেছে।

যুক্তরাষ্ট্র সময়মতো নিজের অনেক নাগরিকের ‘ভাইরাস টেস্ট’ করাতে পারেনি, পাশাপাশি নিজেও বৈশ্বিক দৌড়ে খবরদারি হারিয়েছে। দেশটির ডাকে ইউরোপ যুগের পর যুগ বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্তে অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। অথচ ভাইরাস হানা দেয়ামাত্র ওয়াশিংটন কোনো ধরনের মতবিনিময় ছাড়াই ঘনিষ্ঠ মিত্র ইউরোপের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। বাকি বিশ্বের জন্যও কোনো দায় বোধ করতে দেখা যায়নি দেশটির প্রেসিডেন্টকে। এ ঘটনায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে ‘স্প্যানিশ-ফ্লু’র কথা স্মরণ করছেন অনেকে। সেই দুর্যোগে অস্ট্রিয়া আর জার্মানি শক্তিমত্তা হারিয়ে উত্থান ঘটেছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্সের।

ডলার-পাউন্ড পকেটে নিয়ে পণ্য না পাওয়ার অভিজ্ঞতা উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক নাগরিকের জন্য জীবনে এই প্রথম। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, সীমান্ত বন্ধ এবং জরুরি অবস্থার মতো ঘটনা। বিশ্বজুড়ে সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়েছে। সব দেশেই ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রণোদনার জন্য মরিয়া হয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। কেউ চাইছেন নগদ সহায়তা, কেউ কর মওকুফ। আর রাষ্ট্রগুলো মদদ চাইছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির কাছে। করুণ এ দশা দেশে-দেশে নিজস্বতা বা জাতীয়তাবাদের তাগিদ তৈরি করতে পারে। এত দিনের খবরদারি করা মুরুব্বিদের ক্ষমতা ও গোড়ার বহর করোনার উছিলায় বুঝে ফেলেছে ছোট দেশগুলো। করোনা বিশ্বায়নের অন্ধকার অংশে আলো ফেলেছে বলেও মূল্যায়ন রয়েছে।

যেসব রাষ্ট্রকে এতদিন আদর্শ বলে ভাবা হতো করোনা সেই ভাবনা পাল্টে দিয়েছে। করোনার সংক্রমণে রাষ্ট্রগুলো সীমান্ত উদারতার বদলে নিজ নিজ সীমান্ত আটকানোর প্রতিযোগিতা করেছে। বুকের বদলে পিঠ দেখিয়েছে প্রতিবেশী বন্ধুদের।

আন্তর্জাতিক দুনিয়ার এ চিত্রের ছায়া দেশে-দেশে কম পড়েনি।  নিজ  দেশে কী চিত্র দেখছি আমরা? দেশকে সিঙ্গাপুর, কানাডা, আমেরিকা বানানোর গল্প শোনালেও বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র প্রায় সবারই জানা। আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অবস্থা দেশের কারো অজানা নয়। করোনা নিয়ে সরকারের শিথিল ভূমিকা, অব্যবস্থাপনা ও লুকোচুরি মানুষের মধ্যে এক ধরনের আস্থার সঙ্কট তৈরি করেছে। সামনে কঠিন সময় আসছেÑ এই বার্তা দেয়া হচ্ছিল বিভিন্ন মহল থেকেই। কিন্তু, দৃশ্যত তা আমল দিলেও বাস্তবে কোটি কোটি মানুষের জীবনকে অনিরাপদ করে তোলা হয়েছে। সরকারি খুদকুঁড়ো  খেয়ে তাগড়া হওয়া ব্যক্তি-গোষ্ঠী কেবল নিজেরা ভালো থাকলেও হতো। কিন্তু, এরা নিজেরা ভালো থাকতে গিয়ে বাদ বাকি সবাইকে ধইঞ্চার জায়গায়ও রাখেনি। একেবারে উচ্ছিষ্ট ও ঝুঁকির চরমে ছুড়ে ফেলেছে। অস্বীকারের সুযোগ থাকলেও লুকোচুরির কোনো সুযোগ নেই। সরকারি দান-ত্রাণ নিয়ে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। বেসরকারিভাবে যারা দান-খয়রাতে হাত বাড়িয়েছিলেন তারাও হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন। রোজা-রমজানের উছিলায় এ মাসটায় কিছু দান দক্ষিণা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু পরের মাসে বিশেষ করে ঈদের পর পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে যেতে পারে, অনেকেই ভেবে অস্থির।

রাজধানীতে হাজার হাজার ফেরিওয়ালা, হকার পুঁজি খেয়ে ফেলেছেন। এরাও ত্রাণ খোঁজেন। ছোট চাকরিজীবী ও কম আয়ের বহু মানুষ মুখে মাস্ক পরে টিসিবির পণ্যের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। অনেক গার্মেন্ট কারখানা অর্ডার ক্যানসেলের দোহাই দিয়ে শ্রমিক কমিয়ে এনেছে। বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান ভেতরে-ভেতরে অনেক ছাঁটাই করেছে। সেটা সামনে আরো বাড়বে, যা সামনে আরো কঠিন সময়ের বার্তা দিচ্ছে। এরই মধ্যে নগরীর রাস্তায় গা-গতরে সামর্থ্যবান কাউকে দেখলেও চার পাশ থেকে ঘিরে ধরার কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে। এরা খুব অদেখা-অপিরিচিত নয়। ক’দিন আগেও এরা বিভিন্ন দোকান-বাসায় কাজ করেছেন। নইলে ছিলেন রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা বা গ্যারেজের হেলপার-মেকানিক। এরা ধীরে ধীরে ভিখারিতে পরিণত হলে কোথায় যাবে সামাজিক চিত্র? তারা কী আদতে ভিখারি থাকবেন? চাহিদা না মিটলে আগ্রাসী হয়ে ভিন্ন মূর্তিতে নামবেনÑ যুগে যুগে এটাই সামাজিক নিয়ম।

প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মাধ্যমে সরকারের সরবরাহ করা মৃত, আক্রান্ত, শনাক্ত ইত্যাদি তথ্য নিয়ে কিছু কথাবার্তা রয়েছে। এসব তথ্য সঠিক না হলে কোনটা সঠিক, তা-ও বলতে পারছেন না তারা। আবার জ্বর, সর্দি, কাশিতে মৃত দেখানো হতভাগ্যদের নিয়েও জোরকণ্ঠে কথা নেই। এটাই বাস্তবতা। দুর্যোগ বা অন্তিম সময়ে যুগে যুগে, দেশে-দেশে এমনই হয়। সঠিক তথ্য বা ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়। বিশ্ব পরিসংখ্যান বলে দেয়, এই ভাইরাসের আক্রমণ শুরুতে ধীরে হলেও একসময় তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা এক থেকে এক লাখে পৌঁছাতে ৬৭ দিন সময় লেগেছে। দ্বিতীয় এক লাখ আক্রান্ত হতে সময় লেগেছে ১১ দিন। কিন্তু তৃতীয় এক লাখ আক্রান্ত হতে সময় লেগেছে মাত্র চার দিন। আমেরিকা, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, ইরান, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণেও দেখা যায়, প্রথম শনাক্ত থেকে প্রথম মৃত্যু হতে বেশ কিছু দিন সময় লেগেছে। আবার সে মৃত্যুর সংখ্যা তিন অঙ্কে আসতেও কয়েক সপ্তাহ লেগেছে। কিন্তু এরপর আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃতের সংখ্যা  বেড়েছে খুব দ্রুত। নমুনায় মনে হয়, আমাদের জন্যও আগামী দুই-তিন সপ্তাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেটা অগ্রাহ্য করে নানা গল্প ও চাতুরী চর্চায় সময় পার করে দেয়া যাবে। সমাধান আসবে না।

দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীন ভূমিকা আর কিছু মানুষের অমানবিক আচরণে কেবল বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর করার কিছু নেই। ইতালি, স্পেন, চীন, ইরান, আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্সসহ বহু দেশের মৃত্যুর মিছিলের তুলনায় এখনো অনেকটা স্বস্তিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। ইউরোপ-আমেরিকার মতো এই অঞ্চলে মৃতের সংখ্যাটা এখনো ঝাঁকি দেয়নি। অন্যান্য দেশের অবস্থা দেখে আগেভাগেই ব্যাপক সতর্কতা নিয়েছে অনেক দেশ। এখন পর্যন্ত সেই সতর্কতার সুফলও তারা পাচ্ছে। আবার শুরুতে গাছাড়া দিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকার খেসারতও দিতে হচ্ছে। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা ম্যার্কেল নিজের সামর্থ্যরে অকুলানের কথা জানিয়েছেন আগেভাগেই। করোনা সংক্রমণকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সবচেয়ে বড় সঙ্কট বলেছেন তিনি। ইউরোপ-আমেরিকার চলতি পথে কোনো বাধা আসতে পারে-কল্পনায়ও আসেনি কারো কারো। এটা বৈশ্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের পালাবদলের তাগিদ কি না, এ নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। সব মহামারীর শিক্ষা একরকম নয়। তবে, কোনো কোনো মহামারীর ইতিহাসে অভিভাবকসুলভ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়ে বহু রাজত্ব নুয়ে পড়ার ঘটনা রয়েছে। হ

লেখক : আইনজীবী ও সাবেক খতিব,

দারুল আমান ইসলামিক সেন্টার, লন্ডন

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com