সরকারি বাজেট নিয়ে বহুদিন ধরে চলে আসা নিম্নমধ্যবিত্তের উদ্বেগ–উৎসাহ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রত্যাখ্যান বনাম সমর্থন এবং গণমাধ্যমের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সংবাদ পরিবেশনা—সব যেন পানসে হয়ে গেছে। বাজেটসহ অনেক জাতীয় ইস্যুতে কেন এই নিরুৎসাহ, সেটি ভাবার যথেষ্ট অবকাশ আছে।
বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি সংসদে উপস্থাপন করে দেশের অর্থমন্ত্রী যে কর প্রস্তাব পেশ করেন, সরকারি ব্যয়ের ধারণা দেন এবং উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরেন, সেটি প্রকৃতপক্ষে সারা দেশে জনগণের সামগ্রিক আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষিত হিসাব নয়। এই ফিরিস্তি সরকারি ব্যয়ের মোট দেশজ উৎপাদনের বড়জোর ১৪-১৫ শতাংশ!
নিকট অতীতে বাজেটের প্রচারে অবশ্য তা মনে করা কঠিন ছিল, বিশেষত ঢাকাকেন্দ্রিক শহুরে ‘হুজুগে’। পণ্যমূল্য এবং ক্ষেত্রভেদে কর বৃদ্ধির একটা শঙ্কা দেখা যেত অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার আগে; তা সম্ভবত দারিদ্র্য এবং বিজাতীয় শাসনের অভিজ্ঞতার বিচারে। সে–ও ছিল রাজনীতি–সচেতন মানুষের ভাবনা।
অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ আলী তসলীম অনেক বছর আগে আমাদের বলেছিলেন, উন্নত দেশে বাজেট আলোচনায় এত শোরগোল পড়ে না। পরবর্তী সময়ে কোনো ব্যবসায়ী নেতা যখন বলতেন, তাঁদের বাদ দিয়ে জাতীয় বাজেট অসম্পূর্ণ—মনে হতো তিনি প্রতিনিধিত্ব করছেন মতিঝিল এলাকা, যেখানে ‘বসবাস করে’ বেসরকারি খাত।
বাজেটের দলিলপত্র প্রণেতারা কি কখনো সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞেস করেছেন, তাঁদের জন্য সরকার কী করতে পারে? তাঁদের সংসারের হালহকিকতের খবর কে রাখে বা কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তাঁদের জন্য, কে বলবে?
দেশে চারের এক ভাগ মানুষ ঋণ করে মৌলিক চাহিদা পূরণ করছেন বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক জরিপে তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন বলছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের খাবারের খরচ দুই বছর আগের তুলনায় বেড়েছে ৫৮ শতাংশ।
এই শ্রেণির মানুষই সহযোগিতা পাওয়ার কথা সামাজিক সুরক্ষার মাধ্যমে। আমাদের ক্ষেত্রে সরকারি তহবিল থেকে তা পেতে গিয়ে গরিব হলেও একটু খাতির দরকার হয়। দুর্নীতির সঙ্গে বরাদ্দ কম বলেও অভিযোগ আছে। যেমন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে দরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেখানো হয় ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ।
প্রতিবছর একটি জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে কোটি পরিবারের বাজেট তৈরিতে অবদান রাখা যায় যদি দেশে প্রতিনিধিত্বশীল ও কার্যকর জাতীয় সংসদ থাকে। এই আশা করা সাধ্য কার? সমাজে যৌথ বা পারস্পরিক উন্নতি একটি জাতিকে চাইতে হয় আগে; এরপর আসে অর্জনের প্রশ্ন।
কিন্তু সরকারি পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ, কৃষিতে ভর্তুকি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ঋণের সুদে ভর্তুকি, স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বরাদ্দ করা করদাতাদের সমুদয় টাকা নিশ্চয়ই গরিবের পকেটে যাবে না। সুতরাং এগুলোর বরাদ্দ সরিয়ে ফেললে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতে প্রকৃত বরাদ্দ দাঁড়ায় ৫০ হাজার কোটি টাকার আশপাশে বা জিডিপির ১ শতাংশের মতো।
ছোটবেলায় প্রবাদ শুনেছি, সরকার কারও বাড়িতে দালান বানিয়ে দেবে না। মানুষ খুব ভালো করে এটা জানেও। তাই তাঁরা কৃষিকাজে উৎপাদন বাড়ানো ও বৈচিত্র্য আনেন, গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্পকারখানায় কাজ খোঁজেন, বিদেশে কঠিন জীবন বেছে নেন এবং উদ্যোক্তা বা ফ্রিল্যান্সার হতে চান।
তাঁরা সবাই সরকার থেকে কী পান তা বড় কথা নয়; এঁরা কর দেন, নিদেনপক্ষে মূল্য সংযোজন কর, অর্থনীতির চাকা সচল রাখেন এবং পরিবার–পরিজনসহ পরবর্তী প্রজন্ম লালন–পালন করেন। তাঁরাই বাংলাদেশের উত্থান–প্রচেষ্টার নায়ক। তাঁরা ক্ষমতার অপব্যবহারকারী ঘুষখোর নন, কর-খেকো বা ফাঁকিবাজ নন, মুনাফাখোর বা অর্থ পাচারকারীও নন। রাজস্বের অর্থ দিয়ে যাঁরা কোটিপতি হন অথবা সম্পদ আরও বৃদ্ধি করেন, তাঁরা কিন্তু ভিন্ন মানুষ, কোটি জনতা নন।
বাংলাদেশে জিডিপির তুলনায় করের হার খুবই কম, এ কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। অন্যান্য দেশের অনুকরণে এই বক্তব্যের গোলকধাঁধায় আমরা প্রশ্ন করি না আমাদের তথ্য-উপাত্ত কতটা সঠিক। অলিগার্কিসহ সমাজের ওপরতলার নিচে এবং ২০-২৫ ভাগ নিম্নবর্গের ওপরের মানুষগুলোর কর দেওয়ার সামর্থ্য কতখানি?
করোনা ও পরবর্তী সময়ে এই কোটি পরিবারের মধ্য থেকেই সৃষ্টি হয়েছে নতুন দরিদ্র গোষ্ঠী। একদিকে আয়রোজগারের সুযোগ কমে যাওয়া, অন্যদিকে পণ্য ও সেবার মূল্যে ভয়াবহ ঊর্ধ্বগতি তাদের কয়েক দশকের মধ্যে অনেক বেশি ভঙ্গুর করে ফেলেছে।
এমতাবস্থায় একেকটি সংসারের বাজেট কীভাবে প্রণয়ন করা হবে, যদি অর্থমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করা হয়? জাতীয় পর্যায়ের চিন্তা দূরে থাক, নিজের পারিবারিক খরচের হিসাব মেলাতেই কাহিল অতি উন্নয়নবলয়ের বাইরে থাকা ব্যাপক জনগোষ্ঠী। তবে ঘরে থাকেন, আর বাইরে—সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা আপনাকে ছাড়বে না। উপরন্তু কর্তৃপক্ষের কিছু সুযোগও থাকে কল্যাণমুখী উদ্যোগের সুফল জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার।
অসহায় মানুষকে আর্থিক সমর্থন, চাকরি সৃষ্টি, শ্রমঘন খাতে প্রণোদনা, ব্যবসা ও জনবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ, বিশেষ শিল্পে করছাড়, আবিষ্কার, বিনিয়োগ, অধিক উৎপাদনশীলতা ও নতুন বাজারের প্রচেষ্টাকে উৎসাহ জোগানোই হচ্ছে কিছু আর্থিক হাতিয়ার, যা দিয়ে রাষ্ট্রীয় সুবিধাদি বণ্টন এবং সমাজে ভারসাম্য আনা যায়।
সাধারণত একটি দেশে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের স্বার্থের সংঘাতকে সহনশীল পর্যায়ে আনা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয় জাতীয় বাজেট দিয়ে। রাজস্ব বণ্টন এবং আর্থিক নীতির উদ্দেশ্য নিয়ে এই বিশ্লেষণ ছিল সংসদীয় গণতান্ত্রিক যুগের এক অর্থমন্ত্রীর।
সেই ‘সংঘাতে’ গ্রহণযোগ্য সামাজিক সমঝোতা হলে দেশে উন্নতি হয় এবং সব মানুষের কিছু না কিছু অর্জনের পরিবেশ তৈরি হয়। যদি এক পক্ষ, বিশেষ করে ক্ষমতাবান ও বিত্তশালীরা একতরফাভাবে বিজয়ী হয়, তখন সংখ্যাগুরুরা তাঁদের কাছে পদানত হয়।
প্রতিবছর একটি জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে কোটি পরিবারের বাজেট তৈরিতে অবদান রাখা যায় যদি দেশে প্রতিনিধিত্বশীল ও কার্যকর জাতীয় সংসদ থাকে। এই আশা করা সাধ্য কার? সমাজে যৌথ বা পারস্পরিক উন্নতি একটি জাতিকে চাইতে হয় আগে; এরপর আসে অর্জনের প্রশ্ন।