সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:১৮ অপরাহ্ন

বেনজীরের দুর্নীতি: মেঘনাসহ কয়েকটি নদীতে আছে মাছের ঘের

বাংলাদেশ ডেইলি অনলাইন:
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৪ জুন, ২০২৪
  • ৩৭ বার

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ চাকচিক্যভাবেই চলাফেরা করতে ভালোবাসতেন। যেখানেই যেতেন নিয়ে যেতেন নামি-দামি গাড়ি। এমনকি পরিবারের সদস্যরাও কম যাননি। তারাও চলাফেরা করতেন অভিজাত্যভাবেই। কিন্তু বিশাল দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তিনি নামি-দামি জিনিসপত্র বিক্রি করেছেন বা সরিয়ে ফেলেছেন। এর মধ্যে রয়েছে একটি আলিশান বাড়ি ও চারটি গাড়ি। আইজিপির পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর তার গুলশানের বাসায় বেশ কয়েকটি দামি গাড়ি ছিল। কিন্তু এপ্রিল মাসের শেষের দিকে গাড়িগুলো বাসার গ্যারেজ থেকে উধাও হয়ে গেছে। এসব গাড়ির মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা বলে জানা গেছে। ওই গাড়িসহ সবকটি যানবাহন কোথায় আছে তার সন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

এদিকে মেঘনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বেশ কিছু বিস্তৃত জলাশয় রয়েছে বলে তথ্য বেরিয়ে আসছে। এর কিছু অংশ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ক্রয় করা হলেও সিংহভাগই জোর-জবরদস্তি করে নেওয়া বলে অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীরা এতদিন এ ব্যাপারে মুখ না খুললেও বেনজীর বিরুদ্ধে দুদক ব্যবস্থা গ্রহণের খবর প্রকাশ পাওয়ার পর তারা মুখ খুলেছেন। অনেকে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট এলাকার দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। আবার কেউ কেউ থানা কিংবা আদালতে সরাসরি মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
জানা গেছে, স্ত্রী জীশান মীর্জা, ছোট মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর, বড় মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীরসহ সবাই আলাদা আলাদা ব্যান্ডের এক বা একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করতেন। গুলশান-১-এর লেকপাড়ের যে বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকতেন, এসব গাড়ি এতদিন সেখানকার গ্যারেজে থাকলেও এর একটিও এখন নেই। কে বা কারা কবে কোথায় এসব গাড়ি সরিয়েছেন, তাও কেউ জানাতে পারেননি। এ ব্যাপারে বাড়ির কেয়ারটেকারের বক্তব্যও এলোমেলো। তবে বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড রাকিবের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব গাড়ি গ্যারেজ থেকে সরিয়ে নেওয়ার সময় চালক ছাড়া বেনজীর পরিবারের কেউ গাড়িতে ছিলেন না। সবশেষে যে গাড়িটি গ্যারেজে ছিল, তা পুলিশের লোকজন এসে নিয়ে গেছে। সিকিউরিটি গার্ড রাকিবসহ অন্যরা কেউ বেনজীর পরিবারের ব্যবহৃত গাড়ির ব্র্যান্ড, মডেল বা রেজিস্ট্রেশন নাম্বার কিছুই জানাতে পারেননি।
বেনজীর আহমেদের ঘনিষ্ঠজনদের একাধিক সূত্র জানায়, শুধু ঢাকাতেই নয়, গোপালগঞ্জসহ দেশের যেসব জেলায় তার রিসোর্ট, বাগানবাড়ি ও মাছের ঘেরসহ বিভিন্ন সম্পত্তি রয়েছে, এর প্রায় সবখানেই এক বা একাধিক গাড়ি ছিল, যা সেখানে তিনি ও তার পরিবার বেড়াতে এলে ব্যবহার করতেন। এ ছাড়া অতিথিরাও এসব গাড়িতে চড়তেন। অনেকের ধারণা, পেন্ডরার বাক্স থেকে বেনজীরের দুর্নীতির খবর একের পর এক বেরিয়ে আসতে শুরুর পরপরই তিনি সতর্ক হয়ে যান। তাই আগেভাগেই তিনি এসব গাড়ি সরিয়ে ফেলেছেন। কিংবা অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন।

তবে বিআরটিএর একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বল্প সময়ের মধ্যে বেনজীর আহমেদ কিংবা তার স্ত্রী-কন্যাদের নামে রেজিস্ট্রেশনকৃত কোনো গাড়ির মালিকানা বদল করা হয়নি। তাদের ধারণা, তার পরিবার কোনো গাড়ি বিক্রি করলেও হয়তো ক্রেতারা তাৎক্ষণিক নাম পরিবর্তনের আবেদন করেনি। যেহেতু গাড়ি বিক্রির কাগজপত্রে বিক্রেতার স্বাক্ষর নিয়ে রাখলে পরেও মালিকানা পরিবর্তন করা যায়, সেহেতু ক্রেতারা হয়তো বিলম্ব করছেন। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, বিলাসবহুল এসব গাড়ি হয়তো রাতারাতি বিক্রি করে দেওয়া হয়নি। তা হয়তো অন্য কোথাও ঘনিষ্ঠজনদের কারও বাড়ির গ্যারেজে ডাস্ট কভার দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।

তবে এ প্রসঙ্গে দুদকের সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, এসব যানবাহন দুদকের ক্রোকের তালিকাভুক্ত সম্পদ হলে তা বেচাকেনা করা যাবে না। কেউ এসব গাড়ি কেনার উপযুক্ত প্রমাণ দিলেও আইনগতভাবে তার মালিক হওয়ার সুযোগ নেই। কেননা ক্রোকের তালিকাভুক্ত সম্পদ বেচাকেনা বৈধ নয়। এ ছাড়া ক্রোকের তালিকায় থাকা গাড়ি কেউ লুকিয়ে রাখলে কিংবা এ কাজে সহায়তা করলে তিনিও দোষী সাব্যস্ত হবেন।

এদিকে শুধু বিলাসবহুল গাড়িই নয়, সমুদ্র, নদী ও বিস্তৃত জলাশয়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য অত্যাধুনিক স্পিডবোট রয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও এসব যান কার নামে কেনা সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। তবে দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ হওয়ার পর তার ব্যবহৃত শখের স্পিডবোট আর আগের অবস্থানে নেই। এগুলোও রাতারাতি উধাও হয়ে গেছে। যদিও তা বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে নাকি কারও হেফাজতে অন্য কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তা নিশ্চিত করে কেউ জানাতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে দুদকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, এগুলো খুঁজে পাওয়া খুব বেশি কঠিন হবে না। যদি না এর যন্ত্রাংশ আলাদা করে বিক্রি করে না ফেলা হয়। ওই কর্মকর্তার দাবি, বেনজীর হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ এবং বিভিন্ন ব্যাংকে বিশাল অঙ্কের অর্থ থাকার ফিরিস্তির সামনে ৫-৬ কোটি টাকার গাড়ির বিষয়টি তুচ্ছ মনে হয়েছে। তবে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অন্যান্য সম্পদের সঙ্গে এগুলোও ক্রোক করা হবে।

এদিকে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের নামে যে ৬২৭ বিঘা জমি জব্দ করা হয়েছে, ওই সম্পদের বাইরেও রাজধানীতে আরও দুটি বাড়ি ও ৪০ বিঘা জমির সন্ধান মিলেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে। সেই সম্পত্তি জব্দের অনেক আগেই বিক্রি করে হস্তান্তর ও ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ দেওয়ার কারণে ক্রোক বা জব্দের বাইরে রয়ে গেছে। এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের যেসব সম্পত্তি ইতিমধ্যে তৃতীয়পক্ষ বা অন্যান্য ব্যক্তির নামে হস্তান্তর করা হয়েছে, তা তদন্ত করে দেখবে অনুসন্ধান টিম। এসব সম্পত্তি বিক্রি হয়ে থাকলেও কার নামে সম্পদ ক্রয় করা হয়েছিল, লেনদেনের প্রক্রিয়া ও কার কার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হবে।

দুদকসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে থাকা একটি প্লটে সাততলা বাড়ি করা হয়েছে। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্লটটি জীশান মীর্জা পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বলে মনে হয়েছে। তবে ভবন নির্মাণে ব্যাংক থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়। এ ঋণের জন্য বাড়িটি ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ রয়েছে। এ বাড়িটি নিয়ে আরও অনুসন্ধান করবে দুদক।

বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী ও এক মেয়ের নামে পূর্বাচল লাগোয়া গাজীপুরের কালীগঞ্জের তুমুলিয়ার বেতুয়ারটেক গ্রামে ৪০ বিঘা জমির সন্ধান পেয়েছে দুদক। সংস্থাটির এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৭ ও ’১৮ সালের দিকে এসব সম্পত্তি কেনা হয়েছিল, পরবর্তীকালে সেসব সম্পত্তি হস্তান্তর করা হয়েছে বলে দুদকের কাছে তথ্য রয়েছে। এসব সম্পত্তির বিষয়ে আরও অনুসন্ধান চালিয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া গেলে তা ক্রোক করা হবে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর জানান, বিভিন্ন জেলায় বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদের তথ্য চেয়ে দুদকের পক্ষ থেকে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় নতুন করে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। জানা যাচ্ছে যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সম্পত্তি হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন। এখন যদি এসব সম্পদ জব্দ করা না হয়, তাহলে অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতায় মামলা, আদালতে অভিযোগপত্র জমা, আদালত কর্তৃক বিচার শেষে সাজার অংশ হিসেবে অপরাধলব্ধ আয় থেকে অর্জিত সম্পদ সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্তের সব উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে।

এ প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান বলেছেন, ক্ষমতার অপব্যবহারে করে বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমদ। এসব সম্পদ গড়ার পেছনে জমি দখলসহ নানা অভিযোগ দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীরা চাইলে তার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ এবং থানায় মামলা করতে পারবেন।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com