বাংলাদেশে গণ-আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর হামলার ভয়ে দেশের বেশিরভাগ এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা গা ঢাকা দিয়েছিলেন। দেড় মাসেরও বেশি সময় পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে আসায় তাদের কেউ কেউ এখন নিজ এলাকায় ফিরতে শুরু করেছেন।
তবে বাড়ি ফেরার জন্য তাদেরকে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হচ্ছে। যারা টাকা দিচ্ছেন না, তাদেরকে এলাকায় ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি কোনো কোনো জায়গায় তারা হামলার শিকারও হয়েছেন বলেও জানা যাচ্ছে।
টাকা দিয়ে সম্প্রতি এলাকায় ফিরেছেন বা ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে-আওয়ামী লীগের তৃণমূলের এমন বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর সাথে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা।
নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের কেউই নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি, এমনকি এলাকার নামও উল্লেখ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
তবে এলাকায় ফিরতে কাকে কত টাকা দিতে হয়েছে এবং ফেরার পর কী অবস্থায় দিন পার করছেন, সেই অভিজ্ঞতা তারা বিবিসিকে জানিয়েছেন।
তৃণমূলের এক আওয়ামী লীগ নেতা বলছিলেন, ‘ঘর থেকে বের হতে পারছি না। সারাদিন ঘরেই থাকতে হচ্ছে।’
বাড়িঘরে ফেরা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা দাবি করেছেন, হামলার হাত থেকে বাঁচতে বিএনপিসহ এলাকার প্রভাবশালীদেরকে টাকা দিতে হচ্ছে। বিএনপি নেতারা অবশ্য অভিযোগটি অস্বীকার করেছে।
অন্যদিকে, তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এলাকায় ফিরতে শুরু করলেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় বেশিরভাগ নেতা এখনো ‘আত্মগোপন’ রয়েছেন।
এর মধ্যে অনেকে দেশ ছেড়েছেন, ‘দেশ ছাড়ার চেষ্টাকালে’ কেউ কেউ গ্রেফতার হয়েছেন বলেও জানা যাচ্ছে।
এ অবস্থায় নেতৃত্ব সঙ্কটে বিপর্যস্ত দলটিকে ঘিরে নানান গুজব ছড়াতে দেখা যাচ্ছে। ফলে প্রায় মাসখানেক সাড়া-শব্দহীন থাকার পর দলটিকে সম্প্রতি বিবৃতি প্রকাশ করতে দেখা গেছে। তবে বিবৃতিটি দেশের ভেতর থেকে নাকি বাইরে থেকে দেওয়া হচ্ছে, সেটি এখনও স্পষ্ট নয়।
‘লাখ টাকা দিয়ে ফিরছি’
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে ঘরছাড়া আ’লীগ নেতাকর্মীরা।
গত ৫ অগাস্টের পর যেভাবে তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে হামলা হতে দেখা যাচ্ছিলো, সেটিও এখন দেখা যাচ্ছে না। ফলে এখন পরিবারের কাছে ফিরতে চাচ্ছেন দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। কিন্তু হঠাৎ এলাকায় ফিরলে যে হামলার শিকার হতে পারেন, সেই ভয়ও কাজ করছে তাদের মধ্যে।
সেজন্য এলাকায় এখন যারা প্রভাবশালী, তাদের সাথে যোগাযোগ করছেন তারা।
আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড পর্যায়ের একজন নেতা বলছিলেন, ‘এটা ছাড়া তো উপায় নাই। বউ-বাচ্চা ফেলে আর কতদিন পালাই পালাই বেড়াবো।’
বেশিরভাগ এলাকায় বিএনপি এখন নিয়ন্ত্রণ নেয়ায় দলটির নেতাদের সাথেই মূলত যোগাযোগ করছেন বলে ‘আত্মগোপনে’ থাকা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এলাকায় ফিরতে তাদেরকে মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হচ্ছে।
দক্ষিণবঙ্গের একটি জেলার ওই নেতা বলছিলেন, ‘চেয়েছিল তিন লাখ, পরে অনেক বলে-কয়ে এক লাখ টাকা দিয়ে ফিরছি।’
কিন্তু টাকাটা নিলেন কে?
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নেতা বলেন, ‘বড় কোনো নেতা না। আমাদের মতোই ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা।’
গত ৫ অগাস্টের কয়েক সপ্তাহ পরেই যোগাযোগ শুরু করেছিলেন বলে জানাচ্ছেন তিনি।
ওই নেতা বলেন, ‘তখনই রাজি হইছিলো, তবে বলছিলো যে একটু ধৈর্য ধরতে হবে।’
এসব তথ্য জানালেও বিএনপির তৃণমূলের যে নেতা টাকা নিয়েছেন, তার নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি এলাকায় ফেরা আওয়ামী লীগ নেতা।
ওই নেতা আরো বলেন, ‘এটা জানাজানি হলে আরও ডিস্টার্ব করবে, বোঝেনই তো। তখন পরিবার নিয়ে এলাকায় থাকতে পারবো না।’
‘কতজনরে টাকা দেবো?
আ’ লীগের ওয়ার্ড পর্যায়ের ওই নেতা অর্থের বিনিময়ে এলাকায় ফিরতে পারলেও এমন অনেকে রয়েছে যারা টাকা দিয়েও ঘরে ফিরতে পারছেন না।
তেমনই একজন জানিয়েছেন যে, বাড়ি ফেরার জন্য দু’জন নেতাকে তিনি দুই দফায় টাকা দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের থানা পর্যায়ের ওই নেতা বলছিলেন, কিন্তু এরপর তিন সপ্তাহ চলে গেলো, বাড়ি যেতে পারলাম না। কবে যেতে পারবো, সেটাও জানি না।’
কিন্তু টাকা দেয়ার পরও কেন এলাকায় ফিরতে পারলেন না?
ক্ষোভ প্রকাশ করে ওই আওয়ামী লীগ নেতা বলছিলেন, ‘কিভাবে ফিরবো? দু’জনরে টাকা দিছি শুনে এখন আরো মানুষ মোবাইল করে টাকা চায়। কতজনরে টাকা দেবো?
দুই নেতাকে এখন পর্যন্ত যে দেড় লাখ টাকা দিয়েছেন, সেটিও কোনো কাজে আসবে বলে মনে করছেন না তিনি।
প্রথম দফায় যারা টাকা নিয়েছেন, তারা বিএনপির স্থানীয় নেতা বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ তৃণমূলের নেতা। তবে এখন যারা টাকা চাচ্ছেন, তারা বিএনপির অঙ্গসংগঠনের পরিচয় দিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের ওই নেতা বলেন, ‘কেউ বলে যুবদলের নেতা, কেউ বলে স্বেচ্ছাসেবক দল। ওদেরকে টাকা না দিলে নাকি এলাকায় পা রাখতে দেবে না।’
ঘর বাঁচাতে ৫০ হাজার
গত ৫ অগাস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মীর বাড়িঘর-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটে।
তখন সে যাত্রায় যারা বেঁচে গেছেন, তাদের অনেকের বাড়িতে এখন হামলার হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
ঢাকার কাছের একটি জেলার একজন আওয়ামী লীগ নেতা বলছিলেন, ‘আমি তো দেড় মাস ধরেই এলাকাছাড়া। এর মধ্যে বাড়ি এসে আমার ওয়াইফকে হুমকি দিয়ে গেছে যেন এক সপ্তাহের মধ্যে ৫০ হাজার টাকা রেডি রাখে।’
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টাকা না দিলে বাড়িঘর ভাঙচুর করে আগুন দেয়া হবে বলেও হুমকি দিয়েছে চাঁদা দাবি করা লোকগুলো।
ওই আওয়ামী লীগ নেতা আরো বলেন, ‘এমনিতেই কোনো আয়-ইনকাম নেই। তারওপর এত টাকা চাঁদা কোথা থেকে দেবো, সেই চিন্তা করছি।’
কিন্তু চাঁদা চাওয়া লোকগুলো ঠিক কারা?
ঢাকা বিভাগের একটি জেলার ওই নেতা বলছিলেন, ‘আমাদের এলাকারই লোকজন। এতদিন সেভাবে রাজনীতি করতে দেখিনি। এখন বলতেছে, তারা নাকি যুবদলের।’
এলাকায় ফিরেও ঘরবন্দী
টাকার বিনিময়ে এলাকায় ফিরতে পারলেও প্রকাশ্যে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছেন না আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
দেড় মাস পর ঘরে ফেরা আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, ‘যাদের মাধ্যমে এলাকায় ঢুকছি, তারাই বলতেছে ঘর থেকে না বের হতে, বাহিরে বের হলে অসুবিধা হতে পারে।’
এ অবস্থায় চল্লিশোর্ধ ওই ব্যক্তির সারাদিন কাটছে ঘরবন্দী অবস্থায়। হামলার ভয়ে বাহিরে বের হতে না পারায় নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও খুলতে পারছেন না।
তিনি আরো বলছিলেন, ‘বাজারে আমার একটা কাপড়ের দোকান আছে। দেড়ে মাস ধরে সেটা খোলা হয় না। সব ঠিকঠাক আছে কি-না, সেটাও জানি না।’
এদিকে, এলাকায় ফেরার পর যারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাদের অনেকে হামলার শিকার হচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে।
তেমনই একজন খুলনার ছাত্রলীগ নেতা শফিকুল ইসলাম মুন্না। ‘আত্মগোপন’ অবস্থা থেকে বের হওয়ার পর সম্প্রতি তার ওপর হামলা হয়েছে, যাতে মুন্না গুরুতর আহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার এক আত্মীয়।
ওই ছাত্রলীগ নেতার আত্মীয় বলেন, ‘তিন-চারজনে মিলে দৌড়ানি দিয়ে ওরে রাস্তায় ফেলে কুপাইছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি জানিয়েছেন, মুন্না বর্তমান হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
অন্যদিকে, লক্ষ্মীপুরে নূর আলম নামে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে। গত রোববার রাতে সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নে ওই ঘটনা ঘটে।
এর বাহিরে, গত এক সপ্তাহে বরিশাল ও চুয়াডাঙ্গায় তিনজন ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনা ঘটেছে।
এসব ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে না পারলেও হামলার শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের পক্ষ থেকে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের দায়ী করা হয়েছে।
কী বলছে বিএনপি?
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করার সাথে বিএনপির জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলছিলেন, ‘ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ যেভাবে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে, তারপরে আমাদের নেতাকর্মীরা এ ধরনের ঘটনার সাথে জড়িত হবে বলে আমি মনে করি না।’
আরেক বিএনপি নেতা শামা ওবায়েদ মনে করেন, বিএনপির ভাবমূর্তি নষ্ট করতেই একটিপক্ষ দলটির নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করছে।
মিজ ওবায়েদ বলেন, ‘শুরু থেকেই এ বিষয়ে আমাদের দলের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর। দলের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে নেতাকর্মী নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যেন কেউ এসবের সাথে যুক্ত না হয়। তারপরও আমরা লক্ষ্য করছি যে, এক শ্রেণির লোক বিএনপির নাম ব্যবহার করে এ ধরনের অপকর্ম করছে।’
বিএনপির নাম ব্যবহার করে কেউ চাঁদা চাইলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে, বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্য থেকে কেউ যদি চাঁদাবাজিসহ অন্য কোনো অন্যায়ের সাথে যুক্ত থাকে, তাহলে তথ্য-প্রমাণসহ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য খান বলেন, ‘ওই সব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে অবশ্যই সামনে এসে নাম ধরে অভিযোগ করতে হবে এবং অভিযোগের পক্ষে তথ্য-প্রমাণ দেখাতে হবে।’
অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
গত ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা, লুটপাট ও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠতে দেখা গেছে।
এসব ঘটনায় গত দেড় মাসে পটুয়াখালী, নেত্রকোণা, খুলনাসহ বেশকিছু জেলায় শতাধিক নেতাকর্মীকে শোকজ নোটিশ প্রদান, দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি, এমনকি বহিষ্কারও করেছে বিএনপি।
সূত্র : বিবিসি