ডোনাল্ড ট্রাম্প বলে থাকেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার বন্ধু। মোদিও দাবি করেন, ট্রাম্প তার বন্ধু।
গত সেপ্টেম্বরে নরেন্দ্র মোদি যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমন্ত্রণে কোয়াড শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন, তখন ট্রাম্প মোদির সাথে দেখা করবেন বলে জানিয়েছিলেন।
তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছিলেন।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর মিশিগানের ফ্লিন্টের টাউনহলে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আগামী সপ্তাহে মোদি যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন এবং তার সাথে আমার দেখা হবে। তিনি একজন চমৎকার মানুষ।’
নরেন্দ্র মোদি অবশ্য সে দফা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে দেখা না করেই ভারতে ফিরে আসেন।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ কয়েকবার নরেন্দ্র মোদির নাম নিয়েছিলেন এবং তার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছিলেন।
নির্বাচনের ফলাফলে যখন অনেকটাই এগিয়ে গেছেন তখনই ট্রাম্পকে একজন বন্ধু হিসেবে ‘জয়ের জন্য অভিনন্দন’ জানিয়ে দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
এ দু’জনের ‘বন্ধুত্ব’ দেখার মতো ছিল ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে হিউস্টনে ‘হাউডি মোদি’ অনুষ্ঠানে। সেখানে ট্রাম্প ও মোদি প্রায় ৫০ হাজার ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকের উদ্দেশে ভাষণ দেন।
সেখানেই মোদি স্লোগান দিয়েছিলেন ‘আবকি বার ট্রাম্প সরকার’ বলে।
আবার ২০২০ সালে মোদির নিজের রাজ্য গুজরাটের আহমেদাবাদে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্প বহুবার নরেন্দ্র মোদিকে বন্ধু বলে অভিহিত করেছেন।
ভারতের নীতি নিয়ে ট্রাম্পের সমালোচনা
নরেন্দ্র মোদিকে বন্ধু বলে অভিহিত করলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের বিভিন্ন নীতিমালার কড়া সমালোচনাও করেছেন। ট্রাম্প অনেকবারই অভিযোগ করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর ভারত কর আরোপ করে, অথচ তারা যখন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু পণ্য রফতানি করে, তখন তারা চায় সেগুলো করমুক্ত রাখা হোক।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘ভারত খুবই সমস্যা-জনক দেশ। ব্রাজিলও সেরকমই। এটা আমি আপনাদের সবাইকে বলতে পারি।’
এর আগে জুলাই মাসের এক নির্বাচনী সমাবেশে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আপনি যদি চীনে কিছু উৎপাদন করতে চান, তাহলে তারা আশা করবে যে আমরা এখানে সেটা উৎপাদন করে সেদেশে রফতানি করব। তখন তারা সে পণ্যের ওপর ২৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে। আমরা সেটা চাই না। এরপরেও আবার তারা আহ্বান করবে যে আসুন এখানে আপনাদের কারখানা তৈরি করুন। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে এখানকার সংস্থাগুলো সেখানে যায়।’
ট্রাম্প বলেন, ‘হার্লে ডেভিডসনের ক্ষেত্রেও একই কাজ করেছে ভারত। বাইকের ওপরে ২০০ শতাংশ শুল্কের কারণে হার্লে ডেভিডসন সেখানে বাইক বিক্রি করতে পারেনি’।
ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক নিয়েও ট্রাম্পের বক্তব্য স্পষ্ট।
তিনি চান, ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা সমঝোতা বাড়ুক। তবে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও অভিবাসন নিয়ে ভারতের সমালোচনা করেন তিনি।
ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি তার সাথে মোদির বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে একটা সীমাবদ্ধতা তৈরি করে থাকে।
ওই নীতি অনুযায়ী, ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি হওয়া তথ্য প্রযুক্তি, ওষুধ ও তৈরি পোশাক রফতানির ওপরে শুল্ক আরোপ করতে পারেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প ইতোমধ্যেই ভারতকে শুল্কের রাজা বলে অভিহিত করেছেন। ট্রাম্প চান, ভারত তার পণ্যের ওপর যে কর আরোপ করে, যুক্তরাষ্ট্রও একই কর আরোপ করবে।
যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার।
ভারতের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ, যাদের সাথে তাদের বাণিজ্য ঘাটতি নেই। অর্থাৎ ভারত যুক্তরাষ্ট্রে বেশি রফতানি করে এবং সেখান থেকে কম পণ্য আমদানি করে।
ভারত-মার্কিন বাণিজ্য
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বি-পক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ২০২২ সালে ছিল ১৯ হাজার ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি। কিন্তু ট্রাম্প যদি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির আওতায় ভারতের বিরুদ্ধে শুল্ক আরোপ করেন, তাহলে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও রাশিয়ায় ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত কানওয়াল সিবাল ট্রাম্প ও মোদির বন্ধুত্ব নিয়ে বলছিলেন, ‘বন্ধুত্ব পারস্পরিক স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু স্বার্থের সংঘাত ঘটলে আসলে বোঝা যায় বন্ধুত্বের ব্যাপ্তি কতটা।’
তার কথায়, ‘যুক্তরাষ্ট্র তখনই মুক্ত বাণিজ্যের কথা বলে যখন তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। এটা এখন আর সংরক্ষণবাদীদের বিষয় নয়। বিশ্বের যে বৃহত্তম অর্থনীতি, যারা ডলারের মাধ্যমে বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থাটা নিয়ন্ত্রণ করে। তারা কিভাবে ভারতের কাছ থেকে শুল্ক-সমতা দাবি করতে পারে? যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা চীনকে নিয়ে, ভারত নয়।’
সিবাল আরো ব্যাখ্যা করছিলেন, কিছু ক্ষেত্রে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি মোদির জন্য সুবিধাজনক হবে। সেসব বিষয়ে দু’জনের বন্ধুত্ব প্রকাশ পাবে।
যেমন ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবেন না ট্রাম্প। অর্থাৎ মানবাধিকার, সব ধর্মের মধ্যে সমতা ও গণতন্ত্রের কথা বলে ট্রাম্প কিছু বলবেন না, যেটা বাইডেন প্রশাসন করত।
হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি নিয়ে ট্রাম্প কিছু বলবেন না। তবে মার্কিন কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণে থাকা সংস্থাগুলোর লাগাম তো ট্রাম্প ধরে রাখতে পারবেন না!
‘রাশিয়ার সাথে শত্রুতা ও চীনকে উপেক্ষা’
ভারতীয় বিশ্লেষকরা বরাবরই বলে আসছেন, রাশিয়ার সাথে শত্রুতা করতে গিয়ে চীনের বিপদগুলোকে উপেক্ষা করছে যুক্তরাষ্ট্র। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, মার্কিন নীতির কারণে রাশিয়া ও চীন আরো কাছাকাছি আসছে।
ট্রাম্পের জয়ের পর ইংরেজি পত্রিকা ‘ওপেন’-এ সামরিক বিশেষজ্ঞ ব্রহ্মা চেলানি লেখেন, ‘পাশ্চাত্যের স্বার্থ ও মার্কিন নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থার প্রতি আসল হুমকি যে রাশিয়া নয়, সেটা যে চীন তা ট্রাম্প প্রশাসন উপেক্ষা করতে পারবে না। কারণ রাশিয়া তার প্রতিবেশীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চায়। অন্যদিকে, চীনের আকাঙ্ক্ষা যুক্তরাষ্ট্রের জায়গাটা নিয়ে নেয়া।’
চেলানি লেখেন, ‘জনসংখ্যার মতোই চীনের অর্থনীতিও রাশিয়ার থেকে ১০ গুণ বড়। চীনের সামরিক বাজেটও রাশিয়ার চেয়ে চার গুণ বেশি। সাথে পরমাণু অস্ত্র বাড়াচ্ছে চীন। সামরিক তৎপরতাও বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন ভুল শত্রুর দিকে নজর দিয়েছে।’
তিনি আরো লেখেন, ‘ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে বাইডেনের কঠোর মনোভাব থেকে সরাসরি লাভবান হয়েছে চীন।’
রাশিয়ার ওপর সবচেয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করেছে। এটি চীনের জন্য আশীর্বাদ হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে, কারণ বাধ্য হয়েই রাশিয়ান ব্যাংকগুলো চীনা মুদ্রা ইউয়ানের আন্তর্জাতিক ব্যবহার বাড়িয়েছে।
তিনি বলেন, ‘রাশিয়া এখন তার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বেশিভাগই ইউয়ানে করছে। রাশিয়া সব ইউয়ান চীনা ব্যাংকে রাখছে এবং চীন এতে লাভবান হচ্ছে।’
‘স্বার্থ’ বাদ দিয়ে ‘বন্ধুত্ব’ করবেন না ট্রাম্প
ব্রহ্মা চেলানি মনে করেন, ট্রাম্প এ নিয়ে ভিন্নপন্থা অবলম্বন করবেন এবং রাশিয়ার পরিবর্তে চীনের দিকে মনোনিবেশ করবেন।
যদি তাই হয় তবে সেটাও ভারতের পক্ষেই যাবে, কারণ ভারত ও রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতায় বাইডেন প্রশাসনের মতো ট্রাম্প প্রশাসন এ নিয়ে চাপ দেবে না।
লন্ডনের কিংস কলেজের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক হর্ষ পন্থ বলেন, কাউকে বন্ধু বলার অর্থ হলো ব্যক্তিগত স্তরে সম্পর্কতে তুলে ধরা।
অধ্যাপক পন্থ বলেন, ‘কেউ যদি কাউকে বন্ধু বলে, তার মানে এই নয় যে নীতিগত বিষয়ে কোনো ছাড় থাকবে। মোদিজির কূটনীতির নিজস্ব স্টাইল রয়েছে, তিনি ব্যক্তিগত যোগাযোগ গড়ে তোলেন এবং কখনো কখনো এই পদ্ধতিটিও কাজ করে।’
পন্থের কথায়, ‘বিশ্ব নেতাদের মধ্যে তার পছন্দ ও অপছন্দের ব্যাপারে ট্রাম্প খুব স্পষ্ট। তার পছন্দের নেতাদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদি অন্যতম। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ট্রাম্প নরেন্দ্র মোদির জন্য নিজের স্বার্থ বিসর্জন দেবেন। বাণিজ্য ও অভিবাসন প্রশ্নে ভারতের প্রতি ট্রাম্পের মনোভাব কঠোর হবে। একটা বিষয় নিশ্চিত, ভারতের রাজনীতিতে কী হচ্ছে, তাতে তার কিছু যায় আসে না। কিন্তু ভারতে খ্রিস্টানদের কিছু হলে ট্রাম্প সোচ্চার হবেন, কারণ তাকেও তার দেশের খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাবাবেগের দিকে নজর রাখতে হবে।’
কাশ্মির নিয়ে ট্রাম্পের কথায় অস্বস্তিতে পড়েছিল ভারত
পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ২০১৯ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। ইমরান খানকে হোয়াইট হাউসে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওই সময়েই ট্রাম্প কাশ্মির নিয়ে মধ্যস্থতা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
তিনি ওই সময় বলেছিলেন, মোদিও চান যে তিনি (ট্রাম্প) কাশ্মির নিয়ে মধ্যস্থতা করুন।
ভারত অবশ্য ট্রাম্পের সে দাবি খারিজ করে দিয়ে বলেছিল যে প্রধানমন্ত্রী মোদি ট্রাম্পকে এমন কোনো কথা বলেননি বা অনুরোধ করেননি।
পাকিস্তান ট্রাম্পের বক্তব্যকে স্বাগত জানালেও ভারতের জন্য সেটা অস্বস্তিকর ছিল। ভারতের আনুষ্ঠানিক অবস্থান হলো, কাশ্মির নিয়ে তারা কোনো মধ্যস্থতা মেনে নেবে না।
ফলে শেষ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদির বন্ধুত্ব কতটা আনুষ্ঠানিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকবে আর কতটা বাস্তব সমস্যা সমাধানে কাজে লাগবে- সেটা এখনই বলে দেয়ার সময় হয়ত হয়নি।
সূত্র : বিবিসি