বন্দর নগরী চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমিত রোগী ৪ হাজার ছুঁই ছুঁই করলেও হাসপাতালগুলোতে শয্যা বাড়েনি সে তুলনায়। পাশাপাশি চলছে সঙ্কটাপন্ন রোগীদের জন্য আইসিইউ ও অক্সিজেনের হাহাকার। শয্যা সঙ্কটে নগরীর কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলো রোগীতে ঠাসা। পাশাপাশি রয়েছে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে হতে রোগীদের ফিরিয়ে দেয়ার অভিযোগ। নিয়ন্ত্রণ নেই করোনা চিকিৎসাসহ সাধারণ ওষুধের মূল্য ও সরবরাহ ব্যবস্থায়ও। সবমিলিয়ে চট্টগ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশা ও বিপর্যস্ত চিত্রে চিকিৎসাপ্রার্থীদের মধ্যে এক দিকে আতঙ্ক চলছে, অন্য দিকে করোনায় মৃত্যুর মিছিল বাড়তে থাকায় চিকিৎসাবিহীন মৃত্যুর ভীতি ভর করছে জনমনে।
করোনা রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকায় লেজে গোবরে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের মানুষ। দেশের বেশির ভাগ রাজস্বের জোগানদাতা হলেও চট্টগ্রামের মানুষকে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার সংশয়ে থাকতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতাল জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউসহ সব সিট রোগীতে পরিপূর্ণ, বিআইটিআইডি ও ফিল্ড হাসপাতালও রোগীতে ঠাসা। জেনারেল হাসপাতাল থেকে কিছু রোগী রেলওয়ে হাসপাতাল এবং হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালে স্থানান্তরের কথা বলা হলেও প্রতিদিন শনাক্ত হওয়া নতুন আক্রান্ত করোনা রোগীরা কোথায় যাবে তার কোনো কুল-কিনারা করতে পারছে না।
চিকিৎসা শয্যার পাশাপাশি চিকিৎসা সরঞ্জামাদিরও তীব্র সঙ্কট চলছে চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে। অতিসঙ্কটাপন্ন রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) নেই। অন্য দিকে আইসিইউ পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবলও নেই। খোদ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই এখন পর্যন্ত কোভিড ডেডিকেটেড আইসিইউ নেই। ইতোমধ্যে বেশ কিছু আইসিইউ সমৃদ্ধ বেসরকারি ইমপেরিয়াল হাসপাতাল এবং ইউএসটিসির বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতাল সরকার কর্তৃক কোভিড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করা হলেও সেগুলো এখনো করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত হয়নি। জেলা সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য মতে চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত কোভিড ডেডিকেটেড আইসিইউ শয্যা রয়েছে মাত্র ১০টি।
করোনা আক্রান্ত রোগীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের শ্বাসকষ্টের তীব্রতা বেড়ে গেলে জীবন বাঁচানোর জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন সরবরাহের। কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে বর্তমানে যতগুলো অক্সিজেন পয়েন্ট রয়েছে তার প্রতিটি একজনকে দেয়ার কথা থাকলেও এখন চার-পাঁচজনে ভাগাভাগি করে একেকটি অক্সিজেন পয়েন্ট ব্যবহার করার তথ্য মিলেছে। এক দিকে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলো সিলিন্ডার নির্ভর অক্সিজেন রোগীদের দিতে গিয়ে হিমশিম অবস্থা, অন্য দিকে জীবন বাঁচানোর অনুষঙ্গ হিসেবে যারা বাসায় অক্সিজেন আনতে যাচ্ছেন তাদের অসাধু চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে গুনতে হচ্ছে স্বাভাবিকের কয়েকগুণ মূল্য।
চিকিৎসা সরঞ্জামাদির সঙ্কটের পাশাপাশি চট্টগ্রামে ইতোমধ্যে ৮৩ জন চিকিৎসক গত দুই সপ্তাহে করোনা পজেটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। এরই মধ্যে মারা গেছেন দুইজন চিকিৎসক। তা ছাড়া করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকেরা টানা এক সপ্তাহ দায়িত্ব পালন শেষে ১০ দিনের কোয়ারেন্টাইন থাকতে হচ্ছে। ফলে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক সঙ্কটও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি উভয় ধরনের হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও করোনা উপসর্গবিহীন রোগীরাই চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ উঠছে প্রতিনিয়ত, করোনা উপসর্গ থাকলে তো কথাই নেই। নিজ চিকিৎসালয়ে চিকিৎসা না পাওয়ার কথা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছেন খোদ একজন চিকিৎসক।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি এ প্রতিবেদককে বলেন, চট্টগ্রামে করোনা চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত জেনারেল হাসপাতালের ১০টি আইসিইউ কার্যকর রয়েছে। এর বাইরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা ডেডিকেটেড পাঁচটি আইসিইউ বেড স্থাপনের চেষ্টা চালালেও আইসিইউর জন্য প্রশিক্ষিত জনবলের তীব্র সঙ্কট রয়েছে। এর বাইরে চমেকে যারা ডিউটি করেন একসপ্তাহ পর তাদের কোয়ারেন্টাইনে যেতে হচ্ছে। ফলে জনবলের সঙ্কট আরো তীব্রভাবে দেখা দিয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আইসিইউ জনবলও অনেকটা চমেকের জনবলের ওপর নির্ভরশীল জানিয়ে তিনি বলেন, চমেকে যারা কাজ করেন তারাই সেখানকার ডিউটি শেষে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে সময় দেন। ফলে বেসরকারি হাসপাতালগুলোও আইসিইউ জনবলের সঙ্কটে রয়েছে বলে তিনি জানান।
জনগণের চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিতে সাধ্যমতো চেষ্টা চালানো হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, হলিক্রিসেন্ট হাসপাতাল ও রেলওয়ে হাসপাতালে আইসোলেশন সুবিধা চালু করা হয়েছে, সিটি হলেও আইসোলেশন সেন্টার চালু হচ্ছে। আইসোলেশন সেন্টার আরো বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
এ দিকে চট্টগ্রামের চিকিৎসাব্যবস্থার বিদ্যমান সঙ্কট নিরসনে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলো কোভিড হাসপাতাল ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ও ড্যাব নেতা ডা: শাহাদাত হোসেন।
বিএমএ চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক শাসকদলের নেতা ডা: ফয়সাল ইকবাল চৌধুরীও নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘বারবার চিৎকার করে বলেছি তিন-ছয় মাসের জন্য চুক্তি করে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, বেসরকারি ক্লিনিকগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য। কিন্তু কোনো কিছুতেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত যারা ঢাকায় বসে আছেন সেসব নীতিনির্ধারক কিছুই করেননি। নতুন নতুন কেনাকাটা না করে জরুরি ভিত্তিতে অবিলম্বে চট্টগ্রামের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও কিছু কিছু ক্লিনিকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য। নতুবা আগামী দিনগুলো হবে ভয়াবহ।’