ঝামেলা বস্তি! নামটা শুনেই চমকে উঠেছিলাম। যাকে এড়িয়ে চলার কথা তাকেই সাদরে এনে বস্তির নামে যাঁরা ঠাঁই দিলেন, তাঁরা কেমন মানুষ? অথবা কোন বাধ্য-বাধকতার আদেশ ঝুলছিল তাঁদের মাথার উপর? মনটা যে ব্যাকুল হয়েছিল তাতে ভুল নেই। ঝামেলা বস্তির ঠিকানা উত্তরবঙ্গে। পরে বুঝেছি, নামে ঝামেলা থাকলেও বাস্তবে এখানে কোনও ঝামেলা নেই। বরং মেলে শান্তির আশ্বাস।
নিউ মাল স্টেশনে নামতেই চারিদিক বেশ ছিমছাম। প¬্যাটফর্মের কয়েক হাত দূর থেকে চা-বাগান শুরু হয়েছে। স্টেশন থেকে বেরিয়েই গাড়ি পাওয়া গেল। তকতকে পিচের রাস্তা। উত্তরবঙ্গের চেনা-পরিচিত দৃশ্য। নয়ন ভোলানো চা-বাগান। মাঝে মাঝে টিনের শেড দেওয়া বাড়ি। চেনা-অচেনা ফুলের বিছানা। সুপুরি বাগান। চালসায় পশ্চিমবঙ্গ যুব কল্যাণ ও ক্রীড়া দপ্তরের এক যুব আবাসের খোঁজ পাওয়া গেল, আশ্রয়ও। এর অবস্থানটা বেশ চিত্তাকর্ষক। পাশে জঙ্গল। সামনে চা-বাগান। আবার কয়েক কিলোমিটার দূরেই মূর্তি নদী। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল টিয়াপাখির কলরবে। ব্রেকফাস্ট সেরে একটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
ধরণীপুর চা বাগান: প্রকৃতির লীলাভূমি ডুয়ার্স। ডুয়ার্সের মন খারাপ হলে কুয়াশা ঝরে, বৃষ্টি পড়ে। পাহাড়ের বুকে কান পাতলে শোনা যায় পাহাড়ের পদাবলী। পাহাড়ের সর্পিল পথ মিশে গেছে অন্য আর-একটি পাহাড়ে। ঘণ্টাখানেক পরে প্রথমে এল লুকসান মোড়। খুব একটা অলাভজনক মনে হল না। সেখান থেকে উত্তর দিকে ডায়না নদী পেরিয়ে ধরণীপুর চা বাগান। পথের পাশে একটা বস্তি। চা-বাগানের শ্রমিকদের আবাস। একটা দোকান দেখে নেমে পড়লাম। গরম চায়ে চুমুক। স্থানীয় লোকেরা আড্ডা দিচ্ছে। আধো আধো হিন্দিতে তাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনলাম। বাগানের মাঝেই বস্তি। এঁরা সারাদিন চা-বাগানে কাজ করেন। বিনিময়ে রোজ হিসাবে পান ১৭০/১৮০ টাকা। ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে বাঁচার ন্যূনতম রসদ বস্তিবাসীদের কাছে এসে পৌঁছয়, কি পৌঁছয় না। তবু এরা জীবনকে মুখোমুখি সামনে বসিয়ে কথা বলে। হাসে।
ঝামেলা বস্তি: চেংমারির সবুজ চা-বাগানের বুক চিরে পৌঁছলাম এক গ্রামে। যেন পিকচার পোস্টকার্ড। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট ছোট্ট কাঠের বাড়ি। চারপাশে জঙ্গল আর চা-বাগান। নেপালি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস এই গ্রামে। মুখে তাদের সর্বদা হাসি। এ হাসির মৃত্যু নেই। আমাদের মতো অজানা মানুষদেরও সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন তাঁরা। রাস্তার দু’দিকে বাড়ি, ফল-ফুলের গাছ। মাঝে একটা শিবমন্দির আর গির্জা। মূলত এদের পেশা চাষবাস এবং পশুপাখি পালন। আশির দশকের প্রথম দিকে ঝামেলা সোমরা নামে এক মানুষ রীতিমতো আন্দোলন করে চেংমারি চা-বাগানে এই বস্তি তৈরি করেছিলেন। তাই এটা ঝামেলা বস্তি। মেঘেদের লুকোচুরি। নাম না-জানা রঙিন ফুলে ভরে আছে চারপাশ। গ্রামের ঠিক শেষপ্রান্তে পাহাড় খাড়া হয়ে নীচে নেমে গেছে। সরু পায়ে চলা পথ ধরে নীচের দিকে নেমে গেলাম। নদীর একদম কাছে। ঠিক গা ঘেঁসেই বয়ে যাচ্ছে এক তন্বী নদী। তন্বীর মতনই তার কোমরের ভাঁজ। নদীর কুলকুল কলতানে যৌবনের উচ্ছ্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে। তাই সবুজেরা যেন এখানে আরও বেশি তাজা। মৃদুমন্দ বাতাসেও ভিজে ভিজে ভাব। পুরো আকাশ ঢাকা না থাকলেও আকাশে জলভরা মেঘেদের ইতস্তত আনাগোনা। পান্না-সবুজ জল পাথরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে সশব্দে ছিটকে পড়ছে। এ যেন ক্যানভাসে আঁকা নিখুঁত জলরঙা ছবি। সৃষ্টিকর্তা নিজের খেয়ালে এঁকেছেন। পাহাড় থেকে নেমে আসা স্বচ্ছসলিলা বহতা নদী, ডায়না। অনেক পাথর পড়ে আছে নদীর ধারে। নদীর পাড়ে ঝোপ-জঙ্গল। ভুটানের কোলঘেঁষা ঝামেলা বস্তি। ডায়না নদী তাদের আলাদা করে রেখেছে। দূরে, নীলচে ভুটান পাহাড়ের হাতছানি।
ঘন সবুজের মাঝে খরগ্রোতা উদ্ভিন্নযৌবনা ডায়না। তার কাছে ধরা দিতে বাধ্য যে-কোনও অন্তর্মুখী মানুষ। গ্রোতের শব্দ ফিসফসিয়ে কানে কানে কিছু বলে যাচ্ছে। মেঘ-রোদ্দুরের সঙ্গে পাগলা হাওয়ার মাতামাতি। নদীর ওপর প্রায় ১ কিলোমিটার লম্বা একটি ঝুলন্ত ব্রিজ, যা জায়গাটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এই ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে ভুটানে যাওয়া যায়। নদীর ওপারে যে-বাড়িঘরগুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলো রাজার দেশের। মানুষের প্রয়োজনে মুছে যায় রাজনৈতিক সীমারেখা। গ্রামের লোকেদের কাছ থেকে শুনলাম হাটবারে সীমানা পেরিয়ে ভুটান থেকে দলে দলে মানুষ আসেন এপাশে। সংগ্রহ করে নিয়ে যান নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
উদ্দাম ডায়না নদী: নদীর পাড় ধরে উঁচু পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম সত্যি বললে এটা ঠিক হাঁটা নয়, একটা পাথর থেকে অন্য পাথরে লাফিয়ে চলা । কিছুক্ষণ চলার পর সামনে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। পায়ে চলা পথটি সোজা নেমে গেছে খরগ্রোতা নদীতে। উজানে বেশ গ্রোত। ছোটবড় পাথরের খন্ড বিছানো নদীর বুকে। বাঁশ জুড়ে জুড়ে নদী ডিঙানোর মতো একটা সাঁকো ছিল, কিন্তু জলের তুমুল গ্রোতে সেটি ভেঙে গেছে । তাই জলের মধ্যে দিয়ে হেঁটেই নদী পেরোতে হবে। না হলে সোজা হেঁটে গিয়ে বড়বড় পাথরগুলো টপকে ব্রিজে উঠতে হবে। ক্লান্ত হয়ে একটা পাথরের ওপর বসে পড়লাম। নদীতে পা ডুবিয়ে। নদীর জল প্রায় হাঁটুর ওপর। গ্রোতও অনেক। বরফ শীতল জল। শিরশিরে বাতাস। মাথার ওপর কড়া রোদ আর পায়ের নীচে পাথুরে জল। কিছুদুরে ঝোপঝাড়ে রঙিন প্রজাপতি উড়ছে বেশ কিছু।
নদীর অপর পার থেকে খাড়া উঠে গেছে সবুজ পাহাড় নদীর বুকে। কিছু সবুজ গাছ আর কিছু ন্যাড়া শুকনো গাছ দাঁড়িয়ে আছে। বিকেলের সূর্য ততক্ষণে অস্ত যাবার তোড়জোড় শুরু করেছে, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁক দিয়ে তার আলো এসে পড়ছে নদীর বুকে। স্বচ্ছন্দে বয়ে চলা চঞ্চল গ্রোতের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে চারিদিক ঝাপসা হয়ে এল। দু’চোখ ভরে দেখলাম। তারপর ধীরে অন্ধকার ঝরতে থাকল।