করোনা এখনো যায়নি। তার দ্বিতীয় ঝাপ্টা আরো জাঁকিয়ে বসেছে। বাংলাদেশে তো বটেই, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও। ব্রিটেনে অবশ্য গত শনিবার (৪ জুলাই) থেকে পাব-রেস্টুরেন্ট খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লন্ডনের কাছেই লেস্টার শহরে আবার নতুন করে লকডাউন করা হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, ভ্যাকসিন না বেরোনো পর্যন্ত কভিড-১৯-কে দমানো যাবে না। কোথাও কমবে, কোথাও বাড়বে—এভাবে চলবে।
করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার যা করছে, তাকে আমার কৈশোরে দেখা মোকাররম মাঝি যা করেছিলেন, তার সঙ্গে তুলনা করা যায়। ভয়ংকর তুফানে এটা নাকি অতীতে সব বড় নৌকার সব মাঝিই অনুসরণ করতেন। আমি একবার গয়না নৌকায় হিজলা বন্দর থেকে মেঘনা পাড়ি দিয়ে চাঁদপুরে যাচ্ছি, নদীতে ভয়ংকর ঝড় উঠল। আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা দেখে মোকাররম মাঝি আগেই বলেছিলেন, আজ সন্ধ্যায় তিনি মেঘনা পাড়ি দেবেন না। কাল সকালে আকাশ দেখে পাড়ি দেবেন। কিন্তু অবুঝ যাত্রীদের পীড়াপীড়ি। মোকাররম মাঝি নৌকা ছাড়তে বাধ্য হলেন।
নৌকা ছাড়ার আধঘণ্টা না যেতেই সেই ভয়ংকর ঝড় শুরু হলো। শোঁ শোঁ বাতাস। সেই সঙ্গে বিরাট ঢেউ। নৌকা এই ডোবে তো সেই ডোবে। যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিল। মোকাররম মাঝি এ সময় একটি কৌশল খাটালেন। তিনি নৌকাটি মাঝনদীতে নিয়ে পাল তুলে বৈঠা হাতে বসে রইলেন। যাত্রীরা বললেন, সর্বনাশ, এই ঝড়ের মুখে মাঝনদীতে নৌকা এনে ছেড়ে দিয়েছেন। আমরা কোথায় যাচ্ছি? মাঝি বললেন, কোথায় যাচ্ছি জানি না। যদি সমুদ্রে না গিয়ে পড়ে আমরা বেঁচে যাব। নৌকা কূলের কাছে রাখার উপায় নেই। তাহলে কূলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে যাবে। ঝড়ের প্রতিকূলেও নৌকা চালাবার উপায় নেই। তাহলে ডুবে যাবে। তাই বাতাসের অনুকূলে পাল তুলে নৌকা মাঝনদীতে ছেড়ে দিয়েছি। এখন যাই হোক নৌকা ডুববে না। আমাদের প্রাণে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
করোনার বর্তমান ভয়ংকর ঝড়েও বাংলাদেশ সরকার সম্ভবত মোকাররম মাঝির কৌশল গ্রহণ করেছে। পূর্ববর্তী ভুলে (লকডাউন শিথিল করা, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি খুলে দেওয়া ইত্যাদি) যেভাবে শহরে-বন্দরে-গ্রামে ভাইরাস ছড়িয়েছে, তাতে শক্তভাবে সারা দেশে আবার লকডাউন ঘোষণা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আরোপ করে বেশি লাভ হবে না। ভাইরাস যা ছড়াবার তা শহুরে বাবুরা ঈদের ছুটিতে দলে দলে গ্রামে গিয়ে ছড়িয়ে এসেছেন। এখন তাই পরিস্থিতির অনুকূলেই সরকার নৌকা ছেড়ে দিয়েছে। নৌকা যেখানে গিয়ে ভিড়তে চায় ভিড়ুক। নৌকা শেষ পর্যন্ত বাঁচলেই নিশ্চিন্তি। শেষ পর্যন্ত দেশটা বাঁচলেই হয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশের টেলিভিশনে দেখলাম, পুরান ঢাকার ওয়ারী এলাকায় লকডাউনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মানুষ লকডাউন মানছে না। ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। মানুষের রুটি-রুজি প্রয়োজন। তাদের মধ্যে কুসংস্কারও প্রচুর। তার ওপর এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী মানুষকে ভুল শেখাচ্ছে। এই অবস্থায় সরকার একা কী করবে? মোকাররম মাঝির মতো হাল ধরে নৌকা বাতাসের অনুকূলে চলতে দেওয়া ছাড়া? তবু বাংলাদেশের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভারত, ব্রাজিল ইত্যাদি দেশের চেয়ে ভালো। করোনার রাশ টেনে ধরার জন্য সরকার তার সাধ্যের বাইরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নেতৃত্বের দরুন।
করোনা আজ যাবে, কাল যাবে বলে মানুষের মনে মিথ্যা আশা না জাগিয়ে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল যুদ্ধ করার জন্য মানুষের মনকে প্রস্তুত করতে হবে। এই ভাইরাসের প্রতিষেধক ভ্যাকসিন অবশ্যই বেরোবে। কিন্তু তা কত দিনে বেরোবে, কত দিনে তার কার্যকারিতা পরীক্ষিত হয়ে সব দেশের মানুষের জন্য সহজলভ্য হবে, তা কেউ বলতে পারে না। এ অবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি যথাসম্ভব মেনে চলাই সবার জন্য এই মুহূর্তের কর্তব্য।
করোনা বিশ্ব অর্থনীতিতে পরিবর্তন ঘটাবে, এটা এখন সবার জানা। সবাই বলছেন, গত শতকের ত্রিশের মন্দার চেয়েও ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা আসছে। এই অর্থনৈতিক মন্দার সঙ্গে একটা বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তনও ঘটবে বলে অধুনা অনেক রাজনৈতিক পণ্ডিত ও পর্যবেক্ষক বলছেন। বিশ্বরাজনীতিতেও বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটার ইঙ্গিত তাঁরা দিচ্ছেন। এই পরিবর্তনটা হয়তো প্রথমে আমেরিকায়ই ঘটবে। লন্ডনের সানডে টাইমস ৫ জুলাই তারিখে এক বিরাট প্রতিবেদন ছেপেছে আমেরিকার ওপর। তাতে বলা হয়েছে, দেশটির স্বাধীনতা দিবসের (৪ জুলাই) ভাষণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘ফার লেফট ফ্যাসিজমকে’ (অতিবামপন্থী ফ্যাসিবাদ) আমেরিকার প্রধান শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়েছেন। এই অতিবামপন্থী ফ্যাসিবাদী বলতে তিনি বুঝিয়েছেন সম্প্রতি জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ নামে যে গণ-আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেই আন্দোলনকারীদের।
কিন্তু ট্রাম্পের এই পুরনো বর্ণবাদী কৌশল এবার কাজে লাগবে বলে রাজনৈতিক পণ্ডিতরা মনে করছেন না। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা দেশবাসীকে কোনো ইলিউশনে না রেখে গোড়া থেকেই দৃঢ়ভাবে করোনার বিরুদ্ধে লড়ছেন। আমেরিকার মতো শক্তিমান দেশে ট্রাম্প করোনাকে গোড়ায় কোনো গুরুত্ব না দিয়ে দেশের মানুষকে ইলিউশনের পর ইলিউশনে রেখেছেন এবং চীনবিরোধী রাজনৈতিক তত্পরতায় বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনে ওয়াশিংটন যখন উত্তাল হয়ে উঠেছিল, তখন তিনি আন্দোলনকারীদের সম্মুখীন না হয়ে হোয়াইট হাউসের ভূগর্ভস্থ বাংকারে গিয়ে পালিয়েছিলেন এবং সেখানে সারা রাত কাটিয়েছেন। এটা তাঁর সমর্থকদের কাছেও তাঁর ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।
৫ জুলাই প্রকাশিত সানডে টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘With covid figures rising and poll numbers falling, his team and party fear he has already lost America’ . (কভিডে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে ট্রাম্পের নির্বাচনে সমর্থন এতটাই কমেছে যে তাঁর টিম ও দল আশঙ্কা করছে, তিনি এরই মধ্যে নির্বাচনে হেরে গেছেন।) বাংলাদেশের মানুষের এটা জেনে উত্সাহিত হওয়া উচিত যে তাদের অবস্থা বিশ্বের একক সুপারপাওয়ারের চেয়ে অনেক ভালো। এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সব কটি দেশের চেয়ে ভালো। সে কথা ৫ জুলাই বিবিসির প্রবাহ অনুষ্ঠানেও বলা হয়েছে। বাংলাদেশের বড় সমস্যা অন্যখানে। সে প্রসঙ্গ পরে আলোচনা করব।
আমেরিকার কথায় আসি। ট্রাম্পের গোঁয়ার্তুমি ও ভুল নির্দেশনায় গোটা আমেরিকা আজ বিপর্যস্ত। দেশটিতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দেখা দেওয়ার পর রোজ নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ৫৫ হাজার। ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা ৩৮ শতাংশে নেমে গেছে এবং নামছেই। তাঁর শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত ফ্লোরিডা-পেনসিলভানিয়া ও মিশিগানে প্রেসিডেন্ট পদে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন ৬ পয়েন্ট এগিয়ে আছেন। সানডে টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বামপন্থীদের বিরুদ্ধে ‘জিংগোইজমের’ সাহায্য নিয়ে ট্রাম্প তাঁর জনপ্রিয়তায় ধস ঠেকাতে চাইছেন। যদি পারেন সেটা তাঁর ভাগ্য। নইলে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবার কথাও ট্রাম্প ভাবছেন।
ভারতেও করোনাভাইরাস বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। বিপর্যস্ত দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়াকেও টপকে ভারত তৃতীয় স্থানে পৌঁছেছে। সবচেয়ে বিপর্যস্ত মোদির শক্ত ঘাঁটি মহারাষ্ট্র। বিবিসির (৫ জুলাই) এক প্রতিবেদনে ভারতের বিপর্যয়ের কথা বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি করেছে বটে, তথাপি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার অর্থাত্ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থা ভালো। এটা সম্ভব হয়েছে নেতৃত্বগুণের জন্য।
ভারতে নরেন্দ্র মোদি সরকারের আগের জনপ্রিয়তা নেই। মোদির জাদুকরী জনপ্রিয়তাও দ্রুত কমছে। করোনার আগে বিজেপি আশা করেছিল, মোদি হাওয়ায় তৃতীয়বারের মতো সাধারণ নির্বাচনে তারা জিতে যাবে। হয়তো লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা কিছুটা হারাবে। এখন তারা এই জয়লাভ সম্পর্কে আর নিশ্চিত নয়। কংগ্রেস সম্মিলিত বিরোধী দল গঠন করে ভালো নেতা দিতে পারলে মোদিও তাঁর গদি সম্পর্কে নিশ্চিত নন।
করোনার হামলার জন্য বিশ্বরাজনীতিতে ওপরে বর্ণিত পরিবর্তন ঘটবেই—এ সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত কথা বলতে পারছেন না। শেষ মুহূর্তে হাওয়া ট্রাম্প ও মোদির পক্ষে ঘুরে যেতে পারে। এমন সম্ভাবনাকে কেউ উড়িয়ে দিচ্ছেন না। কিন্তু বেশির ভাগ পশ্চিমা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের ধারণা, করোনার বিপর্যয় বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার মতো রাজনৈতিক মন্দা ঘটাবে। আমেরিকা ও ভারতের মতো বিশ্বের বৃহত্তম দুটি দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটবে এবং তার ছায়া পড়বে ছোট-বড় অনেক দেশেই।
ব্রিটেনে বরিস জনসনের ভাগ্য অনেকটা ট্রাম্পের ভাগ্যের ওপর নির্ভর করছে। তিনি টোরিদের নীতি কিছুটা বর্জন করে তরুণ প্রজন্মকে ভ্যাট হ্রাস, চাকরি ও গৃহের লোভ দেখিয়ে আগামী নির্বাচনে ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে থাকা নিশ্চিত করতে চান। কিন্তু ইউরোপীয় কমিশনের সঙ্গে কোনো সাফল্যজনক ব্রেক্সিট চুক্তি করতে না পারলে তাঁর ও তাঁর দেশ ব্রিটেনের অবস্থা অনিশ্চিত হয়ে যাবে।
করোনা পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশকে আরো কিছুদিন ভুগতে হবে—এ কথা সত্য। এই ভোগান্তির সমস্যা দীর্ঘ হতে পারে। প্রাণহানির সংখ্যাও দুঃখজনকভাবে বাড়তে পারে। সে জন্য বর্তমান সরকারকে সাধারণ মানুষ প্রবলভাবে দোষারোপ করবে মনে হয় না। হাসিনা সরকারের জন্য যে আসল চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে তা হলো, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ থেকে করোনা পরিস্থিতিতে কর্মচ্যুত যে ৮ থেকে ১০ লাখ (অনুমিত) বাংলাদেশি দেশে ফিরে আসছে তাদের কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসন। শেখ হাসিনা সাত-আট লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে পুনর্বাসনে সাফল্য দেখিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশংসা অর্জন করেছেন। এবার নিজ দেশের কয়েক লাখ মানুষকে দেশে ফিরিয়ে এনে এই করোনা বিপর্যয়ের মধ্যেও তাদের পুনর্বাসনে সাফল্য দেখাতে পারবেন কি? আমার আশা, তিনি পারবেন।