করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ার পর থেকেই পলাতক আছেন রাজধানীর রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম। গ্রেপ্তারের ভয়ে এর মধ্যে তিনি যোগাযোগ করেননি স্বজনদের সঙ্গে। এমনকি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত বৃহস্পতিবার মারা যাওয়া বাবা সিরাজুল ইসলামকে শেষ দেখা দূরের কথা, তার দাফনেরও খোঁজ নেননি। সাহেদকে গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি ইউনিট তার স্বজনদের ফোনসহ বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নজরদারি চালিয়ে এই তথ্য পেয়েছে। গত ৪ জুলাই রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে অসুস্থ বাবাকে ভর্তি করান সাহেদ। এর আগে সিরাজুল ইসলামকে
তিনবার কোভিড-১৯ পরীক্ষা করানো হলেও ফল নেগেটিভ আসে; কিন্তু ইউনিভার্সেলের পরীক্ষায় রিপোর্ট আসে পজিটিভ। এর পরই ওই হাসপাতালে বাবাকে ভর্তি করেন সাহেদ। নিজের প্রতিষ্ঠানে করোনা চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কেন বাবাকে অন্য হাসপাতালে ভর্তি করেছেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে ওই সময় সাহেদ বলেছিলেন, তার হাসপাতালে চিকিৎসার তেমন ভালো ব্যবস্থা নেই; কিন্তু রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের অভিযানের পরই বেড়িয়ে আসে সাহেদের জালিয়াতি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, বাবা সিরাজুল ইসলাম মারা যাওয়ার খবর পেয়ে সাহেদ হয়তো পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেÑ এমন ধারণা ছিল তাদের। এ জন্য সাহেদের সম্ভাব্য যোগাযোগ তালিকার ব্যক্তিদের নজরদারিতে আনা হয়। কারণ সাহেদকে গ্রেপ্তারে এটা একটি সমাধানের পথ হতে পারত; কিন্তু গোয়েন্দাদের হতাশ করে সাহেদ তার বাবার মৃত্যুর পরও পরিবারের কারও সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করেননি।
তদন্ত সূত্র জানায়, সাহেদ যে কোনো মূল্যে অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে দেশ ত্যাগের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন বলে খবর পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এ জন্য তাকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা জরুরি। এ বিষয়ে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম আমাদের সময়কে বলেন, ‘তাকে ধরতে আমাদের একাধিক টিম কাজ করছে। আমরা দ্রুত ভালো খবর দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
এই মধ্যে করোনা পরীক্ষা না করে ভুয়া রিপোর্ট দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় গ্রেপ্তার সাহেদের অন্যতম সহযোগী তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক শিবলীর ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। সাত দিনের রিমান্ড আবেদনের শুনানি শেষে গতকাল শুক্রবার ঢাকা মহানগর হাকিম মোর্শেদ আল মামুন ভূঁইয়া আদেশ দেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার পরিদর্শক মো. আলমগীর গাজী এদিন আসামিকে আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানিকালে আসামি তারেক শিবলীর পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। গত বৃহস্পতিবার ভোরে শিবলীকে রাজধানীর নাখালপাড়া থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
এর আগে রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের সময় গ্রেপ্তার ৮ জনকে একই মামলায় গত ৮ জুলাই আদালতে হাজির করা হলে সাত জনের ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। কামরুল ইসলাম নামে অপর আসামি কিশোর হওয়ায় তাকে সংশোধনকেন্দ্রে পাঠান আদালত।
এদিকে সাহেদকে গ্রেপ্তারসহ তার নানা অনিয়ম নিয়ে গতকাল নিজের ধানম-ির বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি বলেন, ‘যত বড় ক্ষমতাবানই হোক না কেন, অপরাধ প্রমাণ হলে সাহেদকে ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি ফোন দিয়ে তার হাসপাতালে রোগী ভর্তি করি, সেই সুবাধে তিনি আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। বলেছিলেনÑ হাসপাতাল সিল করে দিচ্ছে। আমি বলেছি, আপনি নিশ্চই কোনো অন্যায় কাজ করেছেন, এ জন্য সিল করছে। বিনা কারণে তো সিল করে না। সে বলল, আমি তা হলে কী করব? আমি বললাম, হয় আপনি ফেস করেন, নতুবা আপনার কিছু বলার থাকলে কোর্টে যান। তাকে ধরার জন্য অনুসন্ধান চলছে। র্যাব এবং পুলিশ উভয়েই খুঁজছে। আমরা মনে করি খুব শিগগিরই তথ্য দিতে পারব।’
গত সোমবার রাজধানীর উত্তরার কোভিড ডেডিকেটেড রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালান র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় উঠে আসে রিজেন্ট হাসপাতালের অনিয়মের ভয়াবহ সব তথ্য। জানা যায়, করোনা পরীক্ষা না করেই হাসপাতালটি হাজার হাজার মানুষকে ভুয়া পজিটিভ/নেগেটিভ রিপোর্ট দিত। পরে করোনা চিকিৎসার নামে প্রতারণাসহ নানা অভিযোগে সাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করে র্যাব। এ ঘটনায় ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও সাহেদ পলাতক রয়েছেন।
বেনাপোল ইমিগ্রেশন ও সীমান্তে সতর্কতা জারি
বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, করোনা রিপোর্ট জালিয়াতি মামলায় রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদ যেন দেশ ত্যাগ না করতে পারে সেজন্য বেনাপোল ইমিগ্রেশনে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সীমান্তেও সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। গতকাল সতর্কতার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ ও বিজিবি কর্তৃপক্ষ।
বেনাপোল ইমিগ্রেশনের ওসি আহসান হাবিব জানান, রিজেন্টের সাহেদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আমাদের কাছে বার্তা এসেছে। কোনো কৌশলে যেন তিনি ভারতে পালাতে না পারেন তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
৪৯ ব্যাটালিয়ন বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সেলিম রেজা বলেন, এমনিতেই তারা সব ধরনের অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে সতর্ক থেকে কাজ করছেন। আর এ ধরনের পরিস্থিতিতে আরও সতর্ক থেকে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে।