করোনার সংক্রমণের কারণে বৈশি^ক বাণিজ্য স্থবির। এ কারণে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানিও থমকে দাঁড়িয়েছে। সদ্যবিদায়ী অর্থবছরে রপ্তানি কমেছে ১৭ শতাংশ। তবে এই মন্দা অবস্থার মধ্যেও পাট রপ্তানি বেড়েছে। আর নতুন পণ্য হিসেবে যুক্ত হয়েছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী। এ দুটি পণ্য ছাড়া অন্যান্য কিছু পণ্যে রপ্তানি আদেশ আসতে শুরু করেছে। এটি সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট না হলেও কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত জুন মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ২৭১ কোটি ৪৯ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এ অঙ্ক মে মাসের চেয়ে ৮৫ শতাংশ বেশি। রপ্তানি খাতে করোনার ধাক্কা লাগতে শুরু হয় এপ্রিল থেকে। এপ্রিল মাসে রপ্তানি হয় মাত্র ৫২ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে গোটা ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ৪০ লাখ (৩৩.৬৭ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে। এ অঙ্ক আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যের চেয়ে কম ২৬ শতাংশ। তার আগে বছর রপ্তানি আয় হয় ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলার। যা তার আগের বছরের তুলনায় সাড়ে ১০ শতাংশ বেশি। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয় ৩ হাজার ৬৬৭ কোটি ডলার।
গত অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। লক্ষ্য ছিল ৩৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তৈরি পোশাক থেকে আয় হয়েছিল ৩৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে গত অর্থবছরে রপ্তানি কমেছে ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে এ খাতে আয় কমেছে ২৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয় ১৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। আগের বছরের চেয়ে আয় কমেছে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ওভেন পোশাক থেকে আয় হয়েছে ১৪ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে চীনে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পরই বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে বড় ধাক্কা আসে। তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামালের প্রায় ৭০ শতাংশ আমদানি হয় চীন থেকে। চীনে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে একের পর এক ক্রেতারা আদেশ বাতিল করতে শুরু করে। যা তলানিতে ঠেকে। মার্চ মাসে মাত্র ২২৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়, যা আগের বছরের মার্চের চেয়ে ২০ শতাংশ কম ছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরের
প্রথম নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) মধ্যে সেটিই ছিল বড় ধাক্কা।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, এপ্রিল মাসে গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছিল ৮৫ শতাংশ। মে মাসে কমে ৬১ শতাংশ। আর সর্বশেষ জুনে কমেছে ২.৫ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের রপ্তানি আগের মুখ্য ভূমিকা থাকে তৈরি পোশাক শিল্পের। কিন্তু তৈরি পোশাক শিল্পে বড় আঘাত আসে সার্বিক রপ্তানি থেকে তলানিতে। তবে মে মাসে পোশাক কারখানাগুলোয় যা উৎপাদন হয়েছে তা ছিল আগের অর্ডার। ইউরোপের দেশগুলোর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় রপ্তানিও কিছুটা বেড়েছে।
তবে নতুন ‘অর্ডার’ না আসার পাশাপাশি অনেক ক্রেতা ‘অর্ডার’ বাতিল করেছে বলে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা জানিয়েছেন। ফলে সামনের দিনগুলোয় পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার শঙ্কা জানিয়েছেন পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ। জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহ-সভাপতি ফয়সাল সামাদ আমাদের সময়কে বলেন, বর্তমানে কারখানা যে পণ্য তৈরি হচ্ছে তা ক্রেতাদের আগের অর্ডার। অনেক অর্ডার ক্যানসেল করেছিল, আবার কেউ কেউ স্থগিত করেছিল। সেগুলোর কাজ চলছে। নতুন করে কোনো অর্ডার আসছে না।
এদিকে নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ক্রেতারা নতুন করে অর্ডার দিচ্ছে না। তাই আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। অর্ডার না এলে কারখানা চলবে কীভাবে? আর রপ্তানিই বা কী হবে?
এদিকে রপ্তানিতে কিছুটা হলেও আশা জাগিয়েছে পাট শিল্প। এই সংকটেও পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার আয় করেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ৭ শতাংশ। ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের নয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-মার্চ পর্যন্ত পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে ২৫ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি ছিল। সঙ্গে ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে। মহামারীকালে ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে সাড়ে ৪ শতাংশ।
এ ছাড়াও রপ্তানি বেড়েছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা পোশাক পিপিই। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে স্বাস্থ্য সুরক্ষা পোশাক (পিপিই) রপ্তানি হয়েছে ৪৪ কোটি ৬৭ লাখ ৬০ হাজার ডলারের। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় এসেছে পুরো শরীর আবরিত করার প্লাস্টিক জাতীয় পরিধেয় পোশাক থেকে। দুই ক্যাটাগরিতে পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য আলাদাভাবে তৈরি এ পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৩২ কোটি ৬২ লাখ ৩০ হাজার ডলারের।
পিপিই রপ্তানির পরের অবস্থানে আছে চিকিৎসা প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম (মেডিক্যাল প্রটেকটিভ গিয়ার)। চারটি বিশেষ ক্যাটাগরিতে এ খাতে রপ্তানি হয়েছে ৮ কোটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার ডলারের পণ্য। এ ছাড়া ১ কোটি ৫২ লাখ ৬০ হাজার ডলারের তিন লেয়ারের সার্জিক্যাল মাস্ক, ১ কোটি ১৫ লাখ ৮০ হাজার ডলারের অন্য মাস্ক ও সার্জিক্যাল আইটেম এবং ৬৮ লাখ ৪০ হাজার ডলারের মেডিক্যাল ও সার্জিক্যাল ব্যবহারের সুরক্ষা গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি হয়েছে।