শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪৩ অপরাহ্ন

এমাজউদ্দীন আহমদ : সবার কাছে মানবিক মানুষ

মোস্তফা কামাল
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১৮ জুলাই, ২০২০
  • ২৫৮ বার

করোনা মৌসুমে চলে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদও। গতকাল শুক্রবার ভোরে হৃদরোগ না ফেরার দেশে নিয়ে গেল এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজচিন্তককে। বার্ধক্যজনিত কিছু রোগে ভুগলেও সবসময় থাকতেন পরিপাটি ও গোছানো। চলনে-বলনেও মার্জিত। সেই সঙ্গে নিজস্ব একটি স্টাইল। জীবদ্দশায় মেধা ও নানা গুণে-মানে, বিশেষ করে শিক্ষকতায় নিজের একটা ভিন্ন উচ্চতা তৈরি করেছেন। নিজের যোগ্যতা-বৈশিষ্ট্যে এ অর্জন তার। মহান ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে, ১৯৫২-এর পরবর্তী সময়ে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতা। তখন কারাবরণও করতে হয় তাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইংরেজি সাহিত্যে ¯œাতকোত্তর করে পরে তিনি এই বিদ্যাপীঠেরই শিক্ষক হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে ছিলেন সমাদৃত। পরে বিভাগের চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, প্রো-ভিসির দায়িত্বে ছিলেন সর্বজন সম্মাননীয়। আরও পরে রাজনৈতিক সম্পৃক্তায় ভিসির দায়িত্ব পাওয়ার পরও সেটা ধরে রাখতে পেরেছেন। ১৯৯২ সালে উপাচার্যের দায়িত্ব পান তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের (ইউডা) উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য ’৯২ সালে একুশে পদক পান এমাজউদ্দীন আহমদ। তার যাপিত জীবন ছিল সাদামাটা। অমায়িক ব্যবহার, বিনয়, অগাধ পা-িত্য থাকলেও জ্ঞানের বড়াই না করার মতো বৈশিষ্ট্যের সুবাদে রাজনীতির ভিন্ন মতাদর্শীরাও তার প্রতি বরাবরই ছিলেন তুলনামূলক শ্রদ্ধাশীল।

অন্দরে নয়, সদরেই বিএনপির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ। ছিলেন বহুল আলোচিত শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক। বিএনপিসহ জাতীয়তাবাদী ও দক্ষিণপন্থি সমর্থিত বুদ্ধিজীবীদের এ ফোরামটি তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিতে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে চিঠি দিয়েও আলোচিত এ সংগঠনটি। এমাজউদ্দীন আহমদই ঢাকায় জাতিসংঘের কার্যালয়ে পৌঁছে দেন চিঠিটি। বছর কয়েক আগে তার রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে গুলি করেছিল অজ্ঞাতরা। গুলি তার বেডরুমের জানালার কাচে লাগে। এ নিয়ে তার কোনো অভিযোগ ছিল না। বলেছিলেন, কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবেন?

বিএনপির নীতিনির্ধারণে তার বেশ প্রভাবের কথা বহুল প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু দলান্ধ ছিলেন না। নিজের চিন্তাচেতনা, ভাবনায় নিজস্বতা ধরে রেখেছেন। চর্চাও করেছেন। কখনো কখনো তার বক্তব্য-পরামর্শ মনমতো হয়নি তার দলের কাছে। ভিন্নমতের লোকজনের কাছে তিনি উদার জাতীয়তাবাদী। আবার কারও কারও কাছে মধ্যম পন্থার দক্ষিণপন্থি। মুক্ত মত ও বিবেকবোধের স্বাতন্ত্র্যের কারণে তার আলাদা আমল ছিল প্রতিপক্ষ মতের কাছেও। সবার কাছে মানবিক মানুষ বিবেচিত হওয়া এমাজউদ্দীনের বিশেষত্ব এখানেই। বাংলাদেশের রাজনীতির এমন টানা পর্যবেক্ষণসম্পন্ন দ্বিতীয়জন নেই বললেই চলে। জীবনের ৫০টি বছর মন-মনে-মগজে তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন দেশ, সমাজ ও রাজনীতি চর্চায়। রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যপন্থা এবং উচিত কথার লেখনীর কারণে পাঠকমহলে এমাজউদ্দীনের একটা কদর তৈরি হয়েছে। আর তাকে পাওয়া যাবে না রাজনীতির কথা শোনানোর জন্য। মিলবে না আর তার রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা। কোনো সংবাদপত্রের বিশেষ সংখ্যায় থাকবে এমাজউদ্দীনের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ।

রাজনীতির শত দুরবস্থায়ও সবসময় তাকে দেখা গেছে আশাবাদী হিসেবে। প্রতিটি লেখায়ই দেখতেন-দেখাতেন রাজনীতির সুবাতাসের দিশা। বলতেন, এই অসুস্থতা কেটে যাবে। দেখা দেবে উজ্জ্বল আলোক রশ্মি। দেশে স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক দুটি দলকে সহিষ্ণুতার তাগিদ দেওয়া থেকে বিরত হননি কখনো। উসকানি বা অসিষ্ণুতার লেশমাত্র কখনো দেখা যায়নি তার স্বভাবে। গণতন্ত্রের প্রতি ছিল অগাধ শ্রদ্ধাবোধের কারণে একটি দলের সঙ্গে সম্পৃক্তার পরও এমন সব মতামত ও বিশ্লেষণ তিনি প্রকাশ করেছেন, যা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। সেই মানবিক ও উচিতবোধের কারণেই লিখতে পেরেছেনÑ ‘দলীয় স্বার্থের কারণেই দেশে হিংসাত্মক কার্যক্রমের মাত্রা আজ উচ্চতর হয়েছে। …হিংসা-বিদ্ধেষ পরিহার করে উদার হোন, মানুষের কথা ভাবুন, দেশের কথা ভাবুন। সংবাদপত্রকে, গণমাধ্যমকে তার সৃষ্টিশীল ¯্রােতধারায় এগিয়ে যেতে দিন।’

কয়েক বছর ধরে দেশে টানা অস্থিরতা ও রাজনৈতিক বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে তার বক্তব্য ছিলÑ দেশের রাজনীতিকে যদি সুস্থ করতে হয়, দেশে বর্তমানে যে অনৈক্য আছে তা থেকে পরিত্রাণ পেতে হয়, তা হলে দুই বড় দলকে কাছাকাছি আসতে হবে। তাই কে কাকে আগে দাওয়াত দিল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রধানমন্ত্রীও দাওয়াত দিতে পারেন, খালেদা জিয়াও পারেন। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি সবচেয়ে সুখী (হ্যাপিয়েস্ট পারসন) হব, যদি খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানান। গত নির্বাচনের আগে তার কিছু থিওরি বেশ আলোচিত হয়েছিল। এক রাজনৈতিক মূল্যায়নে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরকে নির্মূল করতে চাইলেও তারা কেউ তা পারবে না। আগামী ২৫-৩০ বছরের মধ্যে এই দল দুটিই সম্ভাবনাময় অবস্থানে থাকবে। বামপন্থি, রাজাকার বা স্বৈরাচারের পরিচয় যাদের আছে, তারা কেউ তাদের বিকল্প হবে না। বিএনপির আন্দোলনের নামে উত্তেজনার বিপক্ষে ছিলেন এমাজউদ্দীন। এক লেখায় বলেছিলেন, পঁচাত্তরের পর আওয়ামী লীগ বিএনপিকে সময় দিয়েছিল। এখন আওয়ামী লীগকে সময় দিলে ক্ষতি কী?Ñ বিএনপির প্রতি এমন পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে বলে স্বাধীন মত দিয়েছিলেন তিনি, যা বিএনপি-জামায়াতের অনেককে আহত করেছে। তবে প্রকাশ ঘটেনি। বিএনপি নেতা তারেক রহমানকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কটূক্তির অবস্থান থেকে সরে আসার সাহসী পরামর্শও তিনি দিতে পেরেছেন। কথা বলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা বিতর্ক নিয়েও। বলেছিলেন, শহীদের সংখ্যা নিয়ে তর্ক না তুললেই ভালো হতো। কিন্তু এর যুক্তির দিক হলো, মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকাটা করা। বিচক্ষণতা এটাই দাবি করে যে, ক্ষমতাসীন যারাই থাকুন, এর সংখ্যা নিরূপণ করা, যে উদ্যোগ খালেদা জিয়াও আগে নিতে পারতেন। কতজন শহীদ হয়েছেন, সে বিষয়ে তিনিও উদ্যোগী হতে পারতেন। কিন্তু তা নেওয়া হয়নি। আবার বর্তমান সরকারও নিতে পারে, তাও নেওয়া হয়নি। ইতিহাসকে সঠিকভাবে জানতে সত্য কোনটি সেটাও জানা দরকার। আমি এর ওপর জোর দিচ্ছি না। আবার এ বিষয়ে কথা বলা অন্যায় হয়েছে, তাও বলব না।

রাজনীতি, প্রশাসনব্যবস্থা, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক বাহিনী সম্পর্কে তার গবেষণাগ্রন্থ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কাছে সমাদৃত। তার লিখিত গ্রন্থের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। এগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা (১৯৬৬), মধ্যযুগের রাষ্ট্র চিন্তা (১৯৪৫), তুলানামূলক রাজনীতি : রাজনৈতিক বিশ্লেষণ (১৯৮২), বাংলাদেশে গণতন্ত্র সংকট (১৯৯২), সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৩), গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ (১৯৯৪), শান্তি চুক্তি ও অন্যান্য প্রবন্ধ (১৯৯৮), আঞ্চলিক সহযোগিতা, জাতীয় নিরাপত্তা (১৯৯৯), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০০০) উল্লেখযোগ্য। ইংরেজিতেও কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে তার।

কাউকে আহত বা অসম্মান না করেও যে সঠিক কথা বলা যায়, পরামর্শ দেওয়া যায়Ñ তা সবার পক্ষে আসলে সম্ভব নয়। এ জন্য মেধা-সততার সঙ্গে শালীনতা চর্চার বিষয়ও থাকে, যা ভরপুর ছিল তার মধ্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং শিক্ষক হিসেবে এ বিদ্যাপীঠকে নিয়ে বড়াই করতে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। বলতেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা দিয়ে যারা হেঁটেছে তারাও অনেক জ্ঞান রাখেন। বিভিন্ন লেখায় সুযোগ পেলেই লিখে বসতেনÑ ‘এ সমাজে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু গৌরবের তার সবকিছুতেই রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোঁয়া।’

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক-কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com