বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১২টি ভূকম্পন ফাটল আছে। একটি বিষয় লক্ষণীয়, প্রতি ১০০ বছর পরপর ফাটল থেকে বড় ধরনের ভূকম্পন হয়ে থাকে। সাধারণত বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে প্লেট বাউন্ডারির মধ্যে। যদিও বাংলাদেশ প্লেট বাউন্ডারির মধ্যে নয়, তবু ভূপ্রাকৃতিক অবস্থান ও বিন্যাসের স্বকীয়তা বাংলাদেশকে ভূকম্পন মণ্ডলের আশপাশেই ফেলেছে। অতীতে ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে আমাদের দেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। সময়ের ব্যবধান আমলে নিলে আরেকটি বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছি আমরা। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউটের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ কেভিন ক্রাজিকের নিবন্ধে দক্ষিণ এশিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্প ঝুঁকির তালিকায় বাংলাদেশকে রাখা হয়েছে। স্থানীয় বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি। একই কারণে ঢাকা থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে রিখটার স্কেলে সাড়ে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূকম্পনের আশঙ্কা রয়েছে।
দেশীয় এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, রাজউকের এলাকায় থাকা ১২ লাখ এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের আওতার প্রায় চার লাখ ভবনের ৭০ শতাংশই ভূমিকম্প সহনীয় নয়। অর্থাৎ রাজধানীতে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৭২ হাজার ভবন তাৎক্ষণিকভাবে ধসে পড়বে। অক্ষত থাকবে খুব কমসংখ্যক ভবন। রাজধানী শহরে অনিয়ন্ত্রিত, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ ও গ্যাস-বিদ্যুতের বিপজ্জনক সংযোগের কারণেই বড় ধরনের ভূমিকম্পে জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইনে বিস্ফোরণ ঘটে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। ঘটবে মানবিক বিপর্যয়। ফলে বড় কোনো ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে ঢাকা মহানগরী। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির সমীক্ষাতেও একই সংখ্যক ভবন ধসে পড়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এই যদি হয় দেশের রাজধানী শহরের অবস্থা, তাহলে বাংলাদেশের অন্য নগরীগুলোর ব্যবস্থাপনা কী রকম, তা না বললেও বুঝতে বুদ্ধিসম্পন্ন কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এখন প্রশ্ন হলোÑ বড় ধরনের ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় আমাদের কতটুকু প্রস্তুতি রয়েছে। যদিও ২০১৬ সালে দেশে দু’টি ভূকম্পন অনুভূত হলে ভূমিকম্পের দুর্যোগ মোকাবেলায় দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকার একাধিক প্রকল্প নিয়েছে সরকার। তবে সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে ধীরগতিতে। বাংলাদেশ আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পটির আওতায় দুর্যোগ মোকাবেলায় বেশ কিছু যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে ঢাকা ও সিলেটে ভবন পরিদর্শন এবং চিহ্নিত করে ভূমিকম্প সহনীয় করে তোলার কাজের অগ্রগতি খুব আগায়নি।
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, এখন যদি ঢাকা বড় মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে তাহলে তিনটি বড় বিপর্যয় ঘটবে। প্রথমত, অবিন্যস্ত, অপরিকল্পিত ও অপরিবীক্ষণকৃত ভবনগুলো বিধ্বস্ত হবে। ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে যেসব দেশ থাকে, সেসব দেশকে বহুতল ভবন নির্মাণ এবং নগর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ঝুঁকি মোকাবেলায় অনেক বেশি সচেতন থাকতে হয়। অথচ বাংলাদেশে বিশেষত ঢাকার ক্ষেত্রে এটি একেবারেই গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে ঢাকায় প্রথমত, যারা গৃহহীন হবেন তাদের আশ্রয় দেয়ার মতো খালি জায়গা নেই এই নগরীতে। উদ্ধার কাজে দক্ষ জনবল এবং যন্ত্রপাতি নেই। আর চিকিৎসাসেবার কথা যত কম বলা যায়, ততই ভালো। এবারের করোনাকালে আমাদের চিকিৎসা খাতের সক্ষমতা কতটুকু তা স্পষ্ট হয়েছে। তা ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতাও নেই। তাই ভূমিকম্পের সময় কী কী করণীয়Ñ সে সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। তাই সম্ভাব্য বিভীষিকাময় এমন চিত্র বিবেচনায় নিয়েই আমাদের প্রস্তুতি নেয়া উচিত। একই সাথে প্রয়োজন বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করা। এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের ব্যাপারে যৌক্তিক সময়ের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।