পর্যায়ক্রমে দেশের সকল নাগরিকের হাতে জাতীয় পরিচয়পত্র তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। তারই অংশ হিসেবে ১০ বছর বয়সীদের তথ্য সংগ্রহ করার কাজে হাত দিচ্ছেন তারা। ২০১১ সালের পরে যারা জন্মগ্রহণ করেছে, এমন নাগরিকদের নিবন্ধনের ঘোষণা শিগগিরই আসছে। অর্থাৎ ১০ বছরের নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি দেওয়া হবে। বর্তমানে ১৬ বছরের বেশি বয়সীদের নিবন্ধনের সুযোগ রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দায়িত্বশীল সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
ইসি সূত্র জানায়, বাড়ি বাড়ি গিয়ে নতুন ভোটার তল্লাশির কাজ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে চাইছেন তারা। দীর্ঘদিনের রেওয়াজ ভেঙে নতুন ভোটার নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বিতরণ, ভোটার তালিকায় ঠিকানা স্থানান্তর, জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম সংশোধনসহ সব ধরনের কাজ অনলাইনে শুরু করেছে তারা। আগামী এক মাসের মধ্যে ইসি একটি নতুন অ্যাপস তৈরি করতে যাচ্ছে, যাতে এনআইডির সব ধরনের সেবা পাওয়া যাবে।
ইসির এনআইডি উইংয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে এবার হালনাগাদে মাঠে নামার সুযোগ নেই। তাই চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল থেকে তারা অনলাইনে সব সার্ভিস দেওয়া শুরু করেছেন। এই কাজে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। জনগণের ভোগান্তিও অনেকাংশে কমে যাচ্ছে। তাই মাঠে নেমে হালনাগাদের কর্মসূচি বাতিল করে অনলাইনেই সব কাজ চালানোর পথে হাঁটছে ইসি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘এনআইডি এবং ভোটার তালিকার সব কাজ অনলাইন সার্ভিসে চালু করা হয়েছে। এটা অব্যাহত থাকবে। এ থেকে ভালো ফলও পাওয়া যাচ্ছে।’ তবে মাঠপর্যায়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তল্লাশির কাজ এখনই পুরোপুরি তুলে দেওয়া সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি বলেন, একটা বিশেষ গোষ্ঠী বা কোনো অংশের জন্য পুরোপুরি অনলাইন সার্ভিস চালু করা হয়তো সম্ভব। কিন্তু পুরো দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কথা বিবেচনায় নিলে এখনই মাঠে গিয়ে হালনাগাদের কাজ পুরোপুরি তুলে দেওয়ার বিষয়টি কতটুকু বাস্তবভিত্তিক হবে, তা চিন্তাভাবনা করতে হবে।
ইসির এনআইডি উইংয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভোটার তালিকার বিদ্যমান আইনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হালনাগাদের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আইনে বলা আছে, ইসির নির্ধারিত পদ্ধতিতে ভোটার তালিকা হালনাগাদের পর খসড়া তালিকা জনগণের সামনে প্রকাশ করতে হবে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে কারও কোনো দাবি বা আপত্তি থাকলে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। পরে পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা যাবে।
ইসি-সংশ্নিষ্টরা জানান, তারা শিগগিরই একটি নতুন অ্যাপস তৈরি করতে যাচ্ছেন। আগামী এক মাসের মধ্যে এটি ব্যবহারের উপযোগী হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই অ্যাপস ব্যবহার করে যে কোনো নাগরিক ভোটার তালিকা বা এনআইডি সংশোধন, হারানো কার্ড উত্তোলন, ঠিকানা স্থানান্তর এবং নতুন ভোটার হওয়ার কাজ ঘরে বসেই করতে পারবেন। শুধু ছবি তোলা, ১০ আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ দেওয়ার জন্য সংশ্নিষ্ট থানা নির্বাচন অফিসে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে থানা/উপজেলা অফিসগুলোতে লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়াতে হবে।
ইসি-সংশ্নিষ্টরা জানান, এখন ১৮ বছরের নিচে, অর্থাৎ ১৬ বছর বয়সীদের এনআইডি কার্ড দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিনামূল্যে কার্ড পেয়ে যাচ্ছে তারা ঘরে বসে। ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত নাগরিকদের তথ্য ইসির কাছে রয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে ১০ বছরের বেশি বয়সীদের অনলাইনে নিবন্ধনের সুযোগ দেওয়া হবে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ২০১১ সালের আগে যারা জন্মগ্রহণ করেছেন, তারাই নাম-পরিচয় নিবন্ধনের সুযোগ পাবেন। তবে ফিঙ্গারপ্রিন্ট, আইরিশ সংগ্রহ এবং ছবি তোলার জন্য নিকটস্থ থানা ও উপজেলা অফিসে যেতে হবে। ইসির পরিকল্পনা, এ বিষয়টি শুধু উপজেলা পর্যায়েই নয়, ইউনিয়ন পর্যায়ে তথ্যসেবা কেন্দ্র নিয়ে যাওয়া হবে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত নয় এমন এলাকাগুলোতে বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হবে।
১৮ বছরের নিচে পাবে লেমিনেটেড কার্ড : এনআইডি উইংয়ের আইডিইএ প্রজেক্টের অফিসার ইনচার্জ (কমিউনিকেশন) স্কোয়াড্রন লিডার কাজী আশিকুজ্জামান জানিয়েছেন, ২৭ এপ্রিল থেকে অনলাইনে জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা সফলভাবে চলছে। এতে ভোটার তালিকা হালনাগাদ-২০১৯ কার্যক্রমে ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী নিবন্ধিত নাগরিকরাও জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন।
সর্বশেষ ভোটার তালিকা হালনাগাদে চার বছরের (২০০১-২০০৪ বছরের আগে যাদের জন্ম) প্রায় ৯৬ লাখ নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি যাদের বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি হয়েছে, এমন ৬৭ লাখের খসড়া প্রকাশ করে। বাকি ৩০ লাখের মতো নাগরিক, যাদের বয়স ১৬ বছর থেকে ১৮ বছরের নিচে ছিল, তাদের খসড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে ২০২১ ও ২০২২ সালে ভোটার উপযোগী হলেই প্রকাশ করবে ইসি।
বিনামূল্যে এনআইডি কপি : কাজী আশিকুজ্জামান জানান, ২০১৯ সালের ভোটার তালিকা হালনাগাদে নিবন্ধিত ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী নাগরিকরা ইসির এনআইডি ওয়েব পোর্টালে (যঃঃঢ়ং://ংবৎারপবং.হরফ.িমড়া.নফ) ‘অন্যান্য তথ্য’ ক্যাপশনের এনআইডি নম্বর লিঙ্কে ব্যক্তি ফরম নম্বর ও জন্মতারিখ দিয়ে এনআইডি নম্বর নেবে। এ পোর্টালে রেজিস্ট্রেশন করে নিজের প্রোফাইল দেখতে পাবেন তারা এবং ‘ডাউনলোড’ অপশন থেকে বিনামূল্যে জাতীয় পরিচয়পত্রের রঙিন কপি সংগ্রহ করতে পারবেন। তবে এ পোর্টাল থেকে নিবন্ধিত ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী নাগরিকরা শুধু একবারই তার জাতীয় পরিচয়পত্রটি ডাউনলোড করতে পারবেন। পর্যায়ক্রমে দেশের সব ভোটারের কাছে স্মার্টকার্ড দেওয়ার কথা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কোটি নাগরিকের হাতে স্মার্টকার্ড পৌঁছানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে সংস্থাটি। আগামী দুই বছরের মধ্যে সবার কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রাও রয়েছে বলে জানান এনআইডি উইং কর্মকর্তারা।
আট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইসির চুক্তি : এদিকে এনআইডি উইং থেকে জানানো হয়েছে, ইসির তথ্যভান্ডারের সহযোগিতা নিতে সরকারি-বেসরকারি আরও আটটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তারা চুক্তি করেছেন। সর্বশেষ ১২ জুলাই সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তাদের চুক্তি সই হয়।
অন্য চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল), ইন্টার ক্লাউড লিমিটেড, বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), প্রগতি সিস্টেমস লিমিটেড (শিওরক্যাশ), চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও ভূমি মন্ত্রণালয়। এসব প্রতিষ্ঠানের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় তথ্যভান্ডারে সংরক্ষিত ব্যক্তির নাম, ঠিকানাসহ বিভিন্ন তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে সঠিক ব্যক্তিকে শনাক্ত করে দেবে নির্বাচন কমিশন।