একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গড়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ক্রমেই গুরুত্ব হারাচ্ছে। শরিক দলগুলোর এ জোটের প্রতি এখন কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচনের পর বিবৃতি ছাড়া তেমন কোনো তৎপরতা নেই ঐক্যফ্রন্টের।
করোনা ও বন্যার মতো দুর্যোগেও অসহায় ও দুস্থ মানুষের পাশে দেখা যায়নি অধিকাংশ নেতাকে। এমনকি গত পাঁচ মাসে জোটের কোনো বৈঠকও হয়নি। তাই এই জোটের কর্মকাণ্ড নিয়ে শরিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
জোটের নেতৃত্বে থাকা বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সময়ই দলের একটি বড় অংশ এর বিরোধিতা করে। তখন বিএনপির আরেক জোট ২০ দলের নেতারাও এই জোট গঠনকে ভালোভাবে নেননি। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর ঐক্যফ্রন্ট গঠন সঠিক হয়েছিল কি না-এখন অনেকেই তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
জানতে চাইলে ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক দল নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কাগজ-কলমে আছে, কিন্তু বাস্তবে তো নেই। যে আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে জোট গঠন করা হয়েছিল, সেটা ঐক্যফ্রন্ট ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু তা যে শুধু ড. কামাল হোসেনের জন্য, তা তো নয়। এর জন্য বেশিরভাগ দায়ী বিএনপি। ঐক্যফ্রন্টে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে কিছু হয়নি, সব হয়েছে যৌথ নেতৃত্বে। কোনো ব্যাপারে ড. কামাল হোসেন তো সিদ্ধান্ত দেননি।
তিনি বলেন, আমাদের ঐক্য নির্বাচনের ছিল না, আন্দোলনের ছিল। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আমরা যে সংলাপে গেলাম, সেখানে যাওয়ার কোনো যুক্তিই ছিল না। যে সংলাপে ওরা (সরকার) আমাদের ডাকেনি, ড. কামাল হোসেন নিজে একটা চিঠি লিখেছিলেন। পরে এক বৈঠকে বললাম যে, বুঝতে পারলাম না আমরা কেন উদ্যোগী হয়ে এত কিছু করতে গেলাম। আমাকে বলা হল, রাখো না; উনি মুরুব্বি হিসেবে চিঠি দিতে পারেন না? চুপ করে ছিলাম। তখন এ ব্যাপারে বিএনপিও কিছু বলল না যে, ওই সংলাপে আমরা যাব কেন?
ডাকসুর সাবেক এই ভিপি আরও বলেন, নির্বাচনের আগে যে জোয়ারটা তৈরি হয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের অত্যাচার বেড়ে গিয়েছিল। তখন আবার আমরাই বললাম ২৬ ডিসেম্বরের পর থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে। কেন? পরের বৈঠকে আমি বলেছিলাম, কেউ কি আমাদের বলেছে, পক্ষে নামবে। নির্বাচন কেন্দ্র করে গায়েবি মামলা হচ্ছে, নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, কর্মীরা এলাকায় নামতে পারছে না, নির্বাচনে নামতে পারছে না-সবই তো দেখেছে। তাহলে তুমি সেটার বিরুদ্ধে আগে দাঁড়াবে না? এখানে মূল ভূমিকা তো বিএনপির হওয়া দরকার ছিল। বিএনপি যদি বলত নির্বাচন করব না, এর প্রতিবাদে আগামী ২৪ ঘণ্টা হরতাল। তখন একটা অন্যরকম ব্যাপার হতো। আসলে এসব লিডারশিপ নিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ছাড়া করানো যাবে না।
আরেক শরিক দল বিকল্পধারা বাংলাদেশের (একাংশ) সভাপতি অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারি বলেন, শুধু ঐক্যফ্রন্ট নয়, নির্বাচনের পর থেকে কোনো দলেরই কোনো কর্মকাণ্ড নেই। ঐক্যফ্রন্টকে দোষারোপ করে তো লাভ নেই। মূলত এখানে বিএনপি হচ্ছে পাওয়ার। তাদের অনেক জনসমর্থন রয়েছে। তার সঙ্গে যদি আরও কয়েকটি দল এক হয় আরও শক্তি বাড়ে-এটাই স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনে না গিয়েই বা কী করত। ড. কামাল হোসেন সাহেবরা নির্বাচন বাতিলের দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য হরতাল ডাকার জন্য বিএনপিকে বলেছিলেন। তখন মির্জা ফখরুল সাহেব সবার সামনে স্বীকার করেছেন, তাদের সেই শক্তি নেই। ঐক্যফ্রন্টের অন্য শরিকদের তো আন্দোলনের শক্তি নাই। শক্তি তো বিএনপির। তখন কর্মসূচি দিলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারত। বিএনপি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
গণফোরামের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু বলেন, যে আশা নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। নির্বাচনের পর থেকে জোটের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। কারণ, আমাদের ভেতরে কিছু ভুল বোঝাবুঝি ছিল বা আমরা কিছু নিজেরাই ভুল বুঝেছি।
বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে নির্বাচনের অনিয়মের বিষয়টি দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করা, ঐক্যফ্রন্ট ও জোট টিকিয়ে রাখা, খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্ত করা এবং ভাঙন ঠেকিয়ে নেতাকর্মীদের ধরে রাখার বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় বিএনপি। এ বিষয়গুলো মোকাবেলায় ঐক্যফ্রন্টকে সামনে রেখেই এগোতে চেয়েছিল। কিন্তু বিএনপি যেভাবে সামনে যেতে চেয়েছে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা সেভাবে বিএনপিকে সহযোগিতা করেননি। সঙ্গত কারণে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা এর প্রতিবাদও করেছিলেন। তখন দলের হাইকমান্ড সেই দুই নেতার মতামতের চেয়ে ঐক্যফ্রন্টের ঐক্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। যে কারণে জোটের কার্যক্রম থেকে ওই দুই নেতা নিজ থেকে সরে এসেছিলেন।
এ ছাড়া নির্বাচনের পরপরই কঠোর আন্দোলনে না গেলেও সাদামাটা কর্মসূচি দিয়ে হলেও রাজনীতির মাঠে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়ার পক্ষে ছিল বিএনপি। কিন্তু তাতেও ফ্রন্টের সায় ছিল না। ফলে নির্বাচনের আট দিন পর যে কর্মসূচি দিয়েছিল ঐক্যফ্রন্ট, তা আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এরপর যে কয়েক দফা ঐক্যফ্রন্ট কর্মসূচি দিয়েছে তাও করতে পারেনি পুরোপুরি। তুচ্ছ কারণে মানববন্ধন, নাগরিক সংলাপের মতো নিরীহ কর্মসূচি স্থগিতে বাধ্য হয়েছে।
কর্মসূচি নির্ধারণে ঐকমত্য না হওয়ার পাশাপাশি খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়কে সবচেয়ে গুরুত্ব না দেয়া এবং জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে ঐক্যফ্রন্টের বলিষ্ঠ স্বীকৃতি না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ দলের নেতাকর্মীরা। এর পরও দলের ঐক্যফ্রন্টপন্থী কয়েকজন সিনিয়র নেতা ফ্রন্টকে সামনে রেখেই অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তৃণমূলের নেতারা ঐক্যফ্রন্টের কর্মসূচিতে কর্মী না আনার কারণে পরে জোটের পক্ষ থেকে কর্মসূচি দিতে পারেনি। এরপর মার্চ থেকে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে বিবৃতি ছাড়া কোনো তৎপরতাই দেখা যায়নি এই জোটের। সব মিলিয়ে বিএনপির কর্মীরা ঐক্যফ্রন্ট থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় গুরুত্ব হারাচ্ছে।
জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল যুগান্তরকে বলেন, আগে আমিও ঐক্যফ্রন্টের অনেকগুলো সভায় গিয়েছি। এখন তো বন্ধুসুলভ ভাববিনিময় ছাড়া আর কোনো কার্যকলাপ আমি দেখছি না। কিন্তু অবস্থানগতভাবে একই আছে যেটা সরকারের অনাচার-অবিচারের বিপক্ষে কথা বলা এবং গণতন্ত্রের জন্য কাজ করা। যেদিক থেকে এক আছে, কিন্তু পারস্পরিক কোনো যোগাযাগ তেমনটা নেই।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, আমরা শুরু থেকেই ঐক্যফ্রন্ট গঠনের বিরুদ্ধে কথা বলে আসছি। কিসের ঐক্যফ্রন্ট? এদের কোনো অস্তিত্ব আছে নাকি। বিএনপি সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় একটি রাজনৈতিক দল। আমরা কেন অন্যের করুণায় তাদের নেতৃত্ব মেনে নেব। যে দলের নেতারা বিএনপির মহাসচিবকে স্থান দেয় পেছনে, স্থায়ী কমিটির সদস্যদের স্থান দেয় পেছনে। ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে বিএনপি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও মনে করেন দলটির কেন্দ্রীয় এই নেতা।
অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন আরেক জোট ২০ দলের শরিকরাও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের শুরু থেকেই প্রকাশ্যে এর সমালোচনা করছেন। জানতে চাইলে বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বের হয়ে আসার জন্য একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপিকে আলটিমেটামও দিয়েছিলাম। মূলত একটা প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়নের জন্য বিএনপির সঙ্গে এই জোট হয়েছিল। বিএনপিকে নির্বাচনে নেয়া, ভোটে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রাখা এবং সরকারকে বৈধতা দেয়াই ছিল ঐক্যফ্রন্টের লক্ষ্য।