কারাগারে যাওয়ার পর দলের অধিকাংশ সিদ্ধান্তের ব্যাপারেই ওয়াকিবহাল ছিলেন না বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দুই বছরের বেশি সময় জেল কেটে চলতি বছরের ২৫ মার্চ শর্তের বেড়াজালে কারামুক্তির পরও দলের কার্যক্রমে তাকে দেখা যাচ্ছে না। দীর্ঘ সময় রাজনীতিতে তার অনুপস্থিতি প্রভাব ফেলছে নেতাকর্মীদের মনোবলে। তাই দলকে আরও শক্তিশালী করতে চেয়ারপারসনের সক্রিয় নেতৃত্বে সামনে এগুতে চান নীতিনির্ধারক, সিনিয়র থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীরাও। রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চান খালেদা জিয়া নিজেও। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে গুলশান কার্যালয়ে বসার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। কারামুক্তির পর কয়েকজন দলীয় নেতার সঙ্গে একান্তে আলাপে বিএনপি নেত্রী এ পরিকল্পনার কথা জানান।
এদিকে ঈদুল আজহার দিন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট নিয়ে দলের চেয়ারপারসনের মন্তব্যের পর তৈরি হয়েছে নতুন চিন্তার খোরাক। খালেদা জিয়ার মন্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে অনেক নেতাই মনে করেন, সামনের দিনগুলো
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সব কার্যক্রম হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে দলের যে কোনো বিষয়েই তার সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন অধিকাংশ নীতিনির্ধারক। তবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে কেউ প্রকাশ্যে বিরোধিতা না করলেও খালেদা জিয়ার প্রতিই বেশি আস্থা নেতাকর্মীদের। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে তার নেতৃত্বে নতুনভাবে দলকে গোছাতে চান নীতিনির্ধারকরাও। তাদের অনেকেই বলছেন, বিএনপি বর্তমানে যে ধারায় রয়েছে, সেখান থেকে অবশ্যই ফিরতে হবে। কারণ বর্তমান ধারাটি জাতীয়তাবাদী ধারা নয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে বিএনপি চলতে পারে না। এখানে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
দলের একাধিক সিনিয়র নেতা আমাদের সময়কে জানান, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে দল কখন কোন সিদ্ধান্ত নেয় কিছুই তারা জানতে পারেননি। খালেদা জিয়ার মন্তব্যের পরই ভেতরের খবর কিছুটা জানতে পেরেছেন তারা। ঈদের দিন কয়েকটি বিষয়ে দলীয় প্রধানের মন্তব্যের পর জাতীয়তাবাদী শক্তিকে টিকিয়ে রাখতে হলে কী করতে হবে তার একটা গাইডলাইন পেয়েছেন বলেও নেতারা মনে করেন। তারা আরও বলেন, বিশ্ব রাজনীতির যেভাবে পটপরিবর্তন হচ্ছে, টিকে থাকতে হলে বিএনপিকেও সেদিকে নজর রাখতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনসহ গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে। কথা কাজের সঙ্গে মিল রেখে সে অনুযায়ী ঢেলে সাজাতে হবে দলের কূটনীতিক উইংকেও। ইতোমধ্যে সেটি করাও হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বর্তমান কূটনীতিক উইং ভেঙে পেশাদার ব্যক্তিকে এর দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে বলে জানান সিনিয়র নেতারা।
দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা জানান, সম্প্রতি চীনের পক্ষ থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিকে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। তাদের দিক থেকে বলা হয়, বর্তমান কূটনীতি বলবৎ থাকা অবস্থায় দেশটি বিএনপিকে নিয়ে কিছু ভাববে না। দলও চাইছে, এন্টি ইন্ডিয়ান রাজনীতিতে সক্রিয় হতে। কেননা এতদিন ভারতের মন জোগাতে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও পারেননি তারা।
দলের ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাজাহান আমাদের সময়কে বলেন, ‘বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে খালেদা জিয়াই একমাত্র ভরসা। সামনে যা কিছু হবে তাকে ঘিরেই হবে। তার নেতৃত্বেই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে, দেশের মানুষ ফিরে পাবে তার ভোটাধিকার। এর বিকল্প এই মুহূর্তে দেখছি না। রাজনীতিবিদদের স্বার্থেই দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও জনগণের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশে যে ফ্যাসিবাদ চলছে, সরকার যে ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করেছে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে আমাদের। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এই যুদ্ধে কে ডানপন্থি বা কে বামপন্থি, সেটি আমাদের ভাবনায় নেই। এই ফ্যাসিবাদকে কেউ সরাতে যুদ্ধে মাঠে নামতে চাইলে আমরা তাদের সঙ্গে আছি।’
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক এলডিপির সভাপতি ড. অলি আহমদ বলেছিলেনÑ ড. কামালের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে যে জোট গঠন করা হয়েছিল, সেটা ছিল মূলত বিএনপিকে নির্বাচনে নেওয়ার জন্য। তাদের মিশন ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটকে চিরতরে ক্ষমতার বাইরে রাখা। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ‘ম্যাও ম্যাও’ করা কিছু বিএনপি নেতা। অলি বলেছেন, ‘আমাকে যখন ঐক্যফ্রন্টে থাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তখন আমি সরাসরি না করে দিয়েছিলাম। কারণ ড. কামাল হোসেন একজন নামকরা আইনজীবী। তার সঙ্গে আইন পেশা মানায়, রাজনীতি নয়। যেখানেই সভা-সমাবেশ হয়েছে, সেখানেই জয় বাংলা বলে শুরু করেছেন ড. কামাল হোসেন, জয় বঙ্গবন্ধু বলে শেষ করেছেন। একটিবারও জিয়াউর রহমান কিংবা খালেদা জিয়ার নাম পর্যন্ত মুখে উচ্চারণ করেননি।’
অলি আহমদের এই বক্তব্যের সঙ্গে ঈদের দিন স্থায়ী কমিটির নেতাদের উদ্দেশে খালেদা জিয়ার দেওয়া মন্তব্য প্রায় মিলে গেছে। আলোচনার একপর্যায়ে নেতাদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘আপনারা কেন ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জোট করতে গেলেন? কেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে গেলেন? আবার গেছেন, আগে কেন এজেন্ডা ঠিক করলেন না? আপনারা ড. কামাল হোসেনকে জাতীয় নেতা বানালেন। তিনি কবে জাতীয় নেতা ছিলেন? তিনি গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কী করেছেন? তিনি তো জাতীয়তাবাদী শক্তির কেউ নন। তার সঙ্গে তো আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, আদর্শিক নয়। তিনি তো সব সময় তার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কথাই বলেন। ড. কামাল যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতেন তা হলে তো এই সরকার থাকত না।’
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিএনপি হচ্ছে দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের দল। আমি মনে করি, এই দলকে চলতে এখন কোনো জোটের প্রয়োজন নেই। জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতীক দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে একাই যথেষ্ট।’
বিএনপির দুজন ভাইস চেয়ারম্যান ও দুই যুগ্ম মহাসচিব আমাদের সময়কে বলেন, সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির নেতাদের সঙ্গে ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) যা বলেছেন এর সত্যতা নানা মাধ্যমে আমরা জেনেছি। এই নিয়ে গণমাধ্যমেও খবর প্রকাশিত হয়েছে। এখন আমরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে যে কোনো মাধ্যমে যোগাযোগ করে জানার চেষ্টা করব গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন বিষয়ে তিনি কারাগার থেকে কী নির্দেশনা দলের জন্য পাঠিয়েছিলেন। এ ছাড়া জামায়াত বিষয়ে তার বর্তমান মনোভাব কী সেটাও আরও স্পষ্ট হতে চাইছেন নেতাকর্মীরা। এ নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল উপায়ে আলোচনাও চালিয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ।
‘খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বিএনপি’Ñ সরাসরি এই মতের ব্যাপারে একমত হয়ে দলের নেতাকর্মীদের বড় অংশ গত নির্বাচনে যেতে অপরাগতা জানান। স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতা বলেন, তৃণমূলের শতভাগ এবং স্থায়ী কমিটির অর্ধেক নেতা ম্যাডামকে ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার মতামত দিয়েছিলেন। ওই সময়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য (দল থেকে পদত্যাগ করা) লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘ওই বৈঠকে আমি বলেছিলাম, আমি একজন সেনাপ্রধান। আমি আমার শত্রুপক্ষের গেইম প্ল্যানও জানি। কিন্তু আমার সৈনিক সেই অনুযায়ী প্রস্তুতও নয়। তাহলে কেন শত্রুপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াব। অতএব এই নির্বাচনী যুদ্ধে অংশ নেওয়া হবে বিএনপির জন্য আত্মহত্যার শামিল।’
এ বিষয়েও খালেদা জিয়ার মতামত জানতে চাইবেন তারা। নির্বাচনের ব্যাপারে খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্ত কী ছিল, তার মতামত নেওয়া হয়েছিল কিনাÑ এসব বিষয়ে পরিষ্কার হতে চান নেতাদের অনেকে। তাতে দল পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা শত্রু-মিত্র চিনতে পারবেন বলে মন্তব্য করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সংলাপ বিষয়ে জানতে চাইলে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না আমাদের সময়কে বলেন, ‘গণমাধ্যমে আমরা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মন্তব্য পড়েছি। তার একটা (খালেদা জিয়া) মূল্যায়ন থাকতেই পারে। আমরা সেদিন সুষ্ঠু একটা নির্বাচন অনুষ্ঠান যাতে হয় সেজন্যই সংলাপে গিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী আমাদের সে আশ্বাসও দিয়েছিলেন।’
কিন্তু বিএনপি নেতাকর্মীরা বলেন, নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পর নির্বাচনী মাঠে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বরচন্দ্র রায় ও ড. মঈন খানের মতো নেতাদের ওপর হামলা পরও বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকল কেন?
ওই সময়ে মওদুদ আহমদ ও বরকত উল্লাহ বুলুর মধ্যে একটা টেলিকনফারেন্স ফাঁস হয়। সেখানে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে থাকা মওদুদ আহমদকেও বলতে শোনা যায় তিনশ আসনের প্রার্থীদের নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সামনে অবস্থান নেওয়ার জন্য। কিন্তু তার কথা কেউ কর্ণপাত করেননি। নেতাদের ভাষ্য মতে, দিনের ভোট আগের রাতে হলেও বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টানি। এমনকি প্রতিবাদে দৃশ্যমান কোনো আন্দোলনও করেননি। নির্বাচনের পরে ২০ দলীয় জোটের শরিক অলি আহমদ তার দলীয় কার্যালয়ে বলেছিলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অনেক নেতা সরকারের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। কে কোথায় বসে কত টাকা নিয়েছেন তাও তার জানা। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি অলি আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি যা বলার বলেছি।
বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, দেশে কোনো আন্দোলন নেই, নির্বাচনও নেই। জামায়াতের সঙ্গে কোনো কর্মকা-ও নেই। সেখানে হঠাৎ করে জামায়াত ছাড়ার প্রশ্ন আসে কেন? এখানে কোনো ষড়যন্ত্র নেই তো?
ঈদের দিন শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে খালেদা জিয়ার কাছেও এ ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করে এক নেতা বলেছেন, আমরা শুনতে পাচ্ছি, নির্বাচনের সময়ও এই নিয়ে আমাদের দলের অনেক নেতার সঙ্গে প্রতিবেশী দেশটির বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে কথাও হয়েছে। তা হচ্ছে, জোট থেকে জামায়াত এবং দলের শীর্ষ পদ থেকে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দিলেই বিএনপিকে তারা (প্রতিবেশী দেশ) ক্ষমতায় নেবে। এখন ধরলাম আমরা জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দেব, এরপর যদি মাইনাস টু মানে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দেওয়ার কথা বলে তখন কী হবে।