কারামুক্ত হয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বাসায় থাকলেও বিদেশ থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এরই মধ্যে তিনি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উত্তরসূরি খোঁজা শুরু করেছেন। সারাদেশে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি পুনর্গঠনে নিজ বলয়ের নেতাকর্মীদের তারেক রহমান যেভাবে ‘জায়গা’ করে দিচ্ছেন, তাতে দলের ভেতরে এ নিয়ে নানা কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে।
মহাসচিব পদে পরিবর্তন এলে তাতে তারেক তার ‘একান্ত পছন্দের’ কাউকে নিয়োগ দেবেন বলে সবার ধারণা। করোনার মতো এমন দুর্যোগকালে তিনি কেন এ বিষয়টি আলোচনায় আনলেন তা নিয়ে নানা প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।
অবশ্য মির্জা ফখরুলের অনুসারীদের দাবি, তার বিকল্প কেউ তৈরি হয়নি। দেশে এবং দেশের বাইরে তার যে ইজেম তৈরি হয়েছে, তা এ মুহূর্তে অন্য কারো নেই। কূটনীতিকদের কাছেও তার ভাবমূর্তি বেশ উজ্জ্বল। তা ছাড়া দলের মধ্যে যে দ্বিধাবিভক্তি, তাতে এখন মহাসচিব পরিবর্তন করলে তা আরও তীব্র হবে।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তারেক রহমানের পছন্দের তালিকায় প্রথমে ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এখন তাতে নতুন করে যোগ হয়েছেন স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। তবে কেউ কেউ বলছেন, আমীর খসরু ও টুকুকে আলোচনায় আনলেও বরিশাল অঞ্চলের সাবেক এক ছাত্রনেতাকে মহাসচিব করতে চান তারেক রহমান।
জোট সরকারের সময় আলোচনা হয়েছিল, তারেক রহমান চেয়ারম্যান হলে মহাসচিব হবেন জহির উদ্দিন স্বপন। রাজনৈতিকভাবে পটু এই সাবেক ছাত্রনেতা ওয়ান-ইলেভেনের সময় সংস্কারপন্থিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় সমালোচিত হন। তবে গত ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে তারেক রহমানের প্রতিনিধি হয়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন তিনি। খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর আমীর খসরুকে বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের দায়িত্ব দেন তারেক রহমান, স্থায়ী কমিটির সদস্য হন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। বন্যা ও করোনাকালীন দলের জাতীয় ত্রাণ কমিটির দায়িত্বও পান টুকু।
অন্যদিকে চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, মহাসচিব হিসেবে সিনিয়র কয়েকজন নেতাকে পছন্দ খালেদা জিয়ার। স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে মহাসচিব করতে একটি বলয় সব সময়ই সক্রিয়। এর বাইরে মহাসচিব হওয়ার তালিকায় বিশ্বস্ততার দিক থেকে সব সময় আলোচনায় আছেন যুবদলের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বরচন্দ্র রায়। তারা দুজনই এখন দলের স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য।
স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের মধ্যেও মহাসচিব হওয়ার মতো যোগ্যতা রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। এর আগের দুই কাউন্সিলেও মহাসচিব হওয়ার দৌড়ে আলোচনায় ছিলেন তিনি। তিন নেতাই খালেদা জিয়ার বিশ্বস্ত। এ ছাড়াও নেতাকর্মীদের আলোচনায় আছেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। ভারতের শিলংয়ে আইনি জটিলতায় আটকেপড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের নামও কয়েক বছর ধরে শোনা যাচ্ছে। তিনি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানÑ উভয়ের বিশ্বস্ত। তবে আইনি জটিলতা কাটিয়ে তার দেশে ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ। দেশে ফিরতে না পারলে মহাসচিব হওয়ার সম্ভাবনাও নেই।
জানতে চাইলে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু আমাদের সময়কে বলেন, মহাসচিব কে হবেন সে বিষয়টি আমার জানা নেই। এ বিষয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা হয়নি। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতি কেটে গেলে জাতীয় কাউন্সিলসহ সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এখন দুর্যোগকাল, তাই আপাতত সাংগঠনিক কার্যক্রমও বন্ধ আছে।
ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান বলেন, এখন করোনায় বিপর্যস্ত দেশ। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অসুস্থ। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এবং বেগম জিয়া সুস্থ হওয়ার পর এ সব নিয়ে নিশ্চয় আলোচনা হবে। তিনি বলেন, মহাসচিব নিয়োগের এখতিয়ার খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের। এ বিষয়ে অন্য কারও কথা বলার সুযোগ নেই।
আলাপকালে দলের একাধিক নেতা বলেন, মহাসচিব পরিবর্তন করতে হলে অনেক বিষয় সামনে রাখতে হবে। দলের নেতাদের মধ্যে তার অবস্থান কেমন, দলে তার অবদান, বিশ্বস্ততা, প্রভাবশালী কিছু দেশ তাকে কীভাবে দেখে এগুলোসহ নানা বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। অন্য দলের রাজনীতি থেকে বিএনপিতে এসেছেন এমন কাউকে দলের নেতারা মেনে নিতে চান না।
এক নেতা বলেন, সিনিয়র নেতাদের প্রায় সবাই খালেদা জিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনীতি করে আসছেন। তবে তাদের অধিকাংশকেই তারেক রহমান তার নিজের লোক মনে করেন না। অনেককে বিশ্বাসও করেন না। এ জন্য এমন কাউকে মহাসচিব করতে চান, যিনি তার ‘বলয়ে’র ও তার বিশ্বস্ত; যাতে দলে নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃক পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠরা মনে করেন, খালেদা জিয়ার যুগের রাজনীতি প্রায় শেষ। তিনি ভবিষ্যতে পূর্ণ সক্রিয় হবেন কিনা তাতেও সন্দেহ আছে। তারেক রহমান যেখানেই থাকুন, তার নেতৃত্বেই দল চলবে। সে জন্য দলের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো তার মতো করেই সাজানো উচিত। এতে তারা দোষের কিছু দেখেন না।
২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, জাতীয় নির্বাহী কমিটি তিন বছরের জন্য নির্বাচিত হবে এবং পরবর্তী কমিটি দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত এ কমিটিই দায়িত্ব পালন করবে। এরই মধ্যে কমিটির মেয়াদ পার হয়ে ১ বছর ৫ মাস অতিবাহিত হয়েছে। ২০১৬ সালে ৬ আগস্ট দুটি পদ ফাঁকা রেখে ১৭ সদস্যের জাতীয় স্থায়ী কমিটির নেতাদের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। খালেদা জিয়া কারাগারে থাকা অবস্থায় দলের দুই ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে পদোন্নতি দিয়ে স্থায়ী কমিটিতে জায়গা দেন তারেক রহমান।
যদিও তরিকুল ইসলাম, আ স ম হান্নান শাহ, এমকে আনোয়ারের মৃত্যু ও মাহবুবুর রহমানের পদত্যাগের কারণে এখনো স্থায়ী কমিটির চারটি পদ ফাঁকা রয়েছে। সম্প্রতি দলের ভেতরে চাউর হয়েছে শূন্যপদে খুলনা বিভাগ থেকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী বা শামসুজ্জামান দুদুর মধ্যে যে কোনো একজন, বাকি তিন পদের জন্য ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, বরকত উল্লাহ বুলু, মো. শাজাহান, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনের নাম আলোচনায় আছে।
দলের একটি সূত্র বলছে, ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে হলেও একটি কাউন্সিল করার চিন্তা করা হচ্ছে। কাউন্সিল করা সম্ভব হলে এখনই শূন্যপদ পূরণের কথা ভাবা হবে না। কাউন্সিল হলে স্থায়ী কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্য বাদ পড়তে পারেন। দলের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা মনে করেন, সিনিয়র নেতারা তারেক রহমানের সঙ্গে রাজনীতি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না। সে ক্ষেত্রে কাউন্সিল হলে স্থায়ী কমিটিতে নতুনদের মধ্যে আরও দেখা যেতে পারে ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন আহমেদ, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে।
স্থায়ী কমিটির পাশাপাশি জাতীয় নির্বাহী কমিটিও তারেক নিজের মতো করে সাজাতে চাইছেন। এ কমিটির যুববিষয়ক সম্পাদক এবং ছাত্রবিষয়ক ও সহ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদকসহ ৩০টির বেশি পদ শূন্য রয়েছে। নির্বাহী কমিটির আকারও ছোট করতে চান তারেক রহমান। সেখানে ৩৩ শতাংশ নারী রাখতে চান তিনি। সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তও হয়েছে। স্থায়ী কমিটির এক নেতা জানান, দলে নিষ্ক্রিয়দের পদ থেকে অব্যাহতি দিতে তারেক রহমানকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এটি কার্যকর হলে ভাইস চেয়ারম্যান থেকে নির্বাহী কমিটির সদস্য পর্যন্ত আরও শতাধিক নেতার নির্র্বাহী কমিটি থেকে বাদ পড়তে পারেন।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, কাউন্সিল হলে খালেদা জিয়াকে স্বপদে রেখে তারেক রহমানকে কো-চেয়ারম্যান করা যায় কিনা তা নিয়ে তার অনুসারী বিএনপি নেতা ও আইনজীবীদের মধ্যে কথা চালাচালি শুরু হয়েছে। সবশেষ কাউন্সিলের আগে গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটির প্রধান প্রয়াত তরিকুল ইসলামের কাছে একই ধরনের প্রস্তাব এসেছিল। তরিকুল তা প্রত্যাখ্যান করায় তারেকপন্থিরা সন্তুষ্ট হতে পারেননি।