চাঁদাবাজি, জুয়া ও ক্যাসিনোর পর এবার অনুপ্রবেশকারী আতঙ্ক জেঁকে বসেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে। অনুপ্রবেশকারী তালিকা প্রস্তুত- দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এমন ঘোষণার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে দলটির মাঠ নেতাকর্মীদের মধ্যে। এ তালিকায় কার কার নাম আছে বিভিন্ন মাধ্যমে তা জানার চেষ্টা করছেন উদ্বিগ্ন এসব নেতাকর্মী। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রায় দেড় হাজার অনুপ্রবেশকারীর তালিকা তৈরির কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
সম্প্রতি মাদক, জুয়া, টেন্ডার, চাঁদাবাজি ও ক্যাসিনোর সাথে দলের কেন্দ্রীয়সহ সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের জড়িত থাকার কথা উঠে আসে। ইতোমধ্যে কয়েক নেতাকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে অতীতে অন্য রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্টতার তথ্য প্রকাশ পায়। দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বিতর্কিত এসব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি নিয়ে দেশ-বিদেশে ইমেজ সঙ্কটে পড়ে ক্ষমতাসীন দলটি। এমন প্রেক্ষাপটে দলে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার বিষয়টি জোর আলোচনায় আসে। ইতোমধ্যে তা বই আকারে চূড়ান্ত করে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানায়, টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে দলকে সুসংগঠিত ও হাইব্রিডমুক্ত করতে বিভিন্ন সময়ে দলে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা তৈরির কথা আসে। বিষয়টি নিয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বারবার তাগাদা দিয়েও কাজ হয়নি। পরে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও নিজস্ব টিমের তত্ত্বাবধানে দলে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা প্রস্তুত করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেই। বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলের দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপের কাছে এ তালিকাটি হস্তান্তর করেন। এ সময় তিনি দলে অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের এই তালিকা অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ, এদের বিরুদ্ধে জোরেশোরে প্রচার চালানো এবং আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কোনো স্তরেই তারা যাতে স্থান না পায় সে ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ দেন।
জানা গেছে, দীর্ঘ ছয় মাস ধরে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব টিম এই অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা তৈরি করে। বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। পরে দলের আট বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের হাতে তালিকার কপি হস্তান্তর করা হয়।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা জানান, বিভিন্ন সময়ে অন্য রাজনৈতিক দল থেকে আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘটনা ঘটে। অতীতে বিষয়টি এক রকম স্বাভাবিক হিসেবেই মেনে নেয়া হতো। তবে ২০০৮ সালের পর সেই হার একটু বাড়তে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগে যোগদানের হিড়িক পড়ে। অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও এমপি-মন্ত্রীর হাত ধরেই আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগ দেন তারা।
তবে নির্বাচনের পর প্রায় সারা দেশে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন ক্ষমতাসীন দলটির নেতাকর্মীরা। এসব অভিযোগের সাথে দল পরিবর্তনকারী নেতাদের নামও আসে। ফলে বিভিন্ন সময় দলের হাইব্রিড নেতাকর্মীদের চিহ্নিত করার বিষয়টি আলোচনা হয়। সম্প্রতি ক্যাসিনোকাণ্ডের সাথে অনুপ্রেবেশকারী কিছু নেতার নাম জড়িয়ে পড়ার তথ্য উঠে এলে সেটি জোরেশোরে আলোচিত হয়। অবশেষে সেই তালিকা নিজেই তদারকি করে প্রস্তুত করেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। আগামী সম্মেলনকে ঘিরে তালিকায় থাকা নামগুলো যাতে কোনোভাবেই দলে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
এ দিকে, দলে অনুপ্রবেশকারী তালিকা প্রস্তুতের পর চরম আতঙ্ক জেঁকে বসেছে মাঠ নেতাকর্মীদের মধ্যে। তালিকায় কার নাম আছে আর কার নাম নেই তা জানতে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজখবর নিচ্ছেন তারা। এ ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্র করে দলের পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া হয়েছে কি না তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন দলটির বিভিন্নপর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ নয়া দিগন্তকে বলেন, বিভিন্ন সময়ে দলে অনুপ্রবেশকারী বিতর্কিতদের তালিকা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা হাতে পেয়েছেন। এটি মাঠপর্যায়ে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাদের কেউ দলের কোনো স্তরেই স্থান পাবে না। আর নির্ভরযোগ্য একাধিক মাধ্যমে এ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। সে জন্য তালিকা নিয়ে দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিতদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের যে তালিকা তৈরি করেছেন, তাতে দেড় হাজার জনের মতো লোকের নাম রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা জেলায় জেলায় তালিকা পাঠাচ্ছি। বিতর্কিত কেউ যাতে বিভিন্ন পর্যায়ের সম্মেলনে কমিটিতে স্থান করে নিতে না পারে, সে জন্য আমরা সতর্ক রয়েছি। নেতাকর্মীদের সেভাবেই দিকনির্দেশনা দেয়া আছে।