জনশক্তি রফতানির বাজার দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। একমাত্র সৌদি আরবে শ্রমিক যাওয়ার গতি এখন পর্যন্ত ঠিক থাকলেও অন্যান্য দেশে কর্মী পাঠানোর হার দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ ধনী দেশ কাতার সরকারও হঠাৎ করেই বাংলাদেশীদের নামে ভিসা ইস্যু করা বন্ধ করে দিয়েছে। এ অবস্থায় মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনের কূটনৈতিক তৎপরতায় শ্রমবাজার যখন খোলার দ্বারপ্রান্তে, তখন আবারো পুরনো সিন্ডিকেটের সদস্যরা শ্রমবাজার নিজেদের দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠছেন বলে জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে।
গত সপ্তাহে বায়রার প্যাডে মালয়েশিয়ার হিউম্যান রিসোর্স মিনিস্টারসহ দু’জন প্রভাবশালী মন্ত্রীর কাছে দেয়া চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, পুরনো সিন্ডিকেটের (বেস্টিনেট) সদস্যরা যাতে কোনোভাবে ‘সিন্ডিকেট’ করে শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে সে ব্যাপারে মালয়েশিয়া সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে জোর দাবি জানানো হয়েছে। চিঠিতে শ্রমবাজার নিয়ে কিছু পরামর্শও দেয়া হয়েছে। আগামী ৬ নভেম্বর মালয়েশিয়ার রাজধানী পুত্রাজায়ায় দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
মালয়েশিয়ার মন্ত্রীদের কাছে দুই পৃষ্ঠার চিঠি পাঠানোর সত্যতা স্বীকার করে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সেক্রেটারি জেনারেল শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘আমি যে চিঠি মালয়েশিয়ার মন্ত্রী মহোদয়দের কাছে দিয়েছি তাতে একটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছি, সেটা হচ্ছে গতবারের মতো মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কেউ যাতে সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। এই চিঠি দেয়ার কারণে শুনেছি কেউ কেউ নাকি মনোক্ষুণœœ হয়েছেন। এতে এমনকি ক্ষতি হলো? বায়রার সাধারণ ১২ শ’ সদস্যও আর শ্রমবাজারে কোনো সিন্ডিকেট দেখতে চাচ্ছেন না। সবাই সমানভাবে ব্যবসা করতে চান। আমি সদস্যদের মনোভাবের কথাই শুধু ওই চিঠিতে তুলে ধরেছি। বায়রা শ্রমবাজারে সিন্ডিকেট নামক কোনো শব্দ শুনতে চায় না।
এ দিকে ৬ নভেম্বর কুয়ালালামপুরের পুত্রাজায়ায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ সভায় অংশ নিতে আগামী ৪ নভেম্বর (সোমবার) প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করার কথা রয়েছে। কোন পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে, একজন কর্মীর মালয়েশিয়া যেতে কত টাকা খরচ হবে তা নির্ধারণ করাসহ বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে কিভাবে সুষ্ঠুভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়া শুরু হতে পারে সেসব জটিল হিসাব-নিকাশই এবারের বৈঠকের এজেন্ডায় চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ৬ নভেম্বরের বৈঠকেই এক বছরের বেশি সময় ধরে স্থগিত থাকা শ্রমবাজার খুলে দেয়ার ব্যাপারে একটি পজিটিভ ঘোষণা আসার ইঙ্গিত আসতে পারে বলে অভিবাসন বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৩১ অক্টোবর প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মনির হোসেন চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক আদেশে বলা হয়েছে, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান ইমরান আহমদের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঁচ দিনের সরকারি সফরে মালয়েশিয়া যাবে। প্রতিনিধিদলের অপর সদস্যরা হচ্ছেন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: সেলিম রেজা, অতিরিক্ত সচিব ড. আহমদ মুনিরুস সালেহিন, জয়েন্ট সেক্রেটারি ফজলুল করিম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ডাইরেক্টর জেনারেল (ডিজি) মো: আজিজুর রহমান এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক (এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং) মো: নুরুল ইসলাম।
গতকাল জনশক্তি রফতানি ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত একজন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ নয়া দিগন্তকে বলেন, এবার মালয়েশিয়া সরকার জি টু জি প্লাস পদ্ধতিতে শ্রমিক নেবে নাকি অন্য কোন পদ্ধতিতে নেবে সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে এবারো সিন্ডিকেট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ওই ব্যবসায়ী মালয়েশিয়া সরকারের মনোভাবের কথা জানিয়ে বলেন, এবার মালয়েশিয়া সরকার চাচ্ছে এক লাখ ৬০ হাজার টাকার মধ্যে কর্মী নিতে। তারা এই কথার গ্যারান্টি চাচ্ছে লিখিতভাবে। তিনি অভিবাসন ব্যয় সম্পর্কে বলেন, অভিবাসন ব্যয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যেভাবে আলোচনা হচ্ছে তাতে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার মধ্যে একজন কর্মী মালয়েশিয়ায় পাঠানোর পরও রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতি কর্মী বাবদ লাভ থাকবে ২০-২৫ হাজার টাকা। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এবার কর্মীর টাকা নেয়া হবে প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে। মধ্যস্বত্বভোগী বলতে কিছু থাকবে না। প্রতারিত হওয়ারও সুযোগ থাকছে না। সিন্ডিকেট হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের দেশ থেকে কেউ সিন্ডিকেট চাচ্ছে না। এখন মালয়েশিয়া কিভাবে কী চাচ্ছে সেই ইচ্ছাকেই এখন বেশি প্রাধান্য দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
গতকাল বায়রার একাধিক নেতা নয়া দিগন্তকে বলেন, বর্তমানে মালয়েশিয়া সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা পড়া কোম্পানির মধ্যে চারটি সফটওয়্যার কোম্পানি নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে দু’টি কোম্পানি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এবং দু’টি মালয়েশিয়ান বাই বর্ণ কোম্পানি। এর মধ্যে থেকেই একটি সিস্টেম চূড়ান্তভাবে মনোনীত হবে। এখন অপেক্ষা করতে হবে মালয়েশিয়া সরকার কোন সিস্টেমটা বেছে নেয়। আর সিস্টেম চূড়ান্ত করবে মালয়েশিয়ার কেডিএন (স্বরাষ্ট্র) মিনিস্ট্রি। তবে অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, মালয়েশিয়ান (সফটও্যয়ার) সিস্টেমের সাথে শ্রমিক পাঠানোয় তৈরি হওয়া সিন্ডিকেটের কোনো সম্পর্ক নেই।