বাংলাদেশের রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা অনিয়ম-দুর্নীতি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লগামহীন, তাদের প্রায় কারোই কোনো জবাবদিহিতা নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনেকে গুম খুন হয়ে যাচ্ছেন। এগুলো এখন লুকোছাপার কিছু নয়, যার চূড়ান্ত নজির দেখলাম কক্সবাজারের টেকনাফে। এক সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার পরই জানার সুযোগ হলো কেবল একজন ওসি ২০৪টি হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছেন। অন্য দিকে, করোনা মহামারী আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা কতটা দায়দায়িত্বহীন। জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষার বদলে তাদের সৃষ্ট অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে স্বাস্থ্য খাতের বারোটা বেজে গেছে। এভাবে সরকারি প্রশাসনের প্রত্যেকটি বিভাগে বেপরোয়া অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে। এই অবস্থায় বল্গাহীন সরকারি প্রশাসনকে লাগাম টেনে ধরাই সবেচেয় বড় চ্যালেঞ্জ। জনগণের সেবার বিষয়টি কার্যকর করা এখন সবচেয়ে প্রয়োজন। এ অবস্থায় জানা যাচ্ছে, সরকারি অনুমতি ছাড়া সরকারের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা গ্রহণ করা যাবে না। অধিকারহারা জনসাধারণ সরকারের এ ধরনের অবস্থানের কারণে আরো অধিকার হারাবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সম্প্রতি আইন ও বিচার বিভাগের সচিবের কাছে একটি চিঠি পাঠায়। সরকারি দায়িত্ব পালনসংক্রান্ত কাজের জন্য কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো মামলা গ্রহণ করা যাবে না মর্মে ওই চিঠিতে পদক্ষেপ নিতে বলেছে। এ ধরনের সরকারি নির্দেশনা জারির কারণ বোঝা যায়। এর পক্ষে সরকারের অনেক যুক্তি রয়েছে। অনেক জনহিতকর কার্যক্রম চালাতে গিয়ে সরকার বাধার মুখে পড়ে। বিশেষত ভ্রাম্যমাণ আদালত চালাতে গিয়ে অন্যায়কারীরা এমন মামলার আশ্রয় নিয়ে কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে। কিংবা কোনো একটা ভালো কার্যক্রম মামলার সুযোগ নিয়ে ধীর করে দেয়। উপজেলা ও জেলা প্রশাসন পরিচালনায় এমন বাধা অহরহ দেখা যায়। সরকারি বিচার কার্যক্রমও এর মাধ্যমে বাধার সম্মুখীন হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ বর্তমান সময় যেসব সঙ্কটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে এগুলো সে তুলনায় নগণ্য বলতে হবে। জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো বাধাগ্রস্ত করছে প্রজাতন্ত্রের কমকর্তা-কর্মচারীর বড় একটি অংশ। সে ক্ষেত্রে তারা বরং প্রজাতন্ত্রের আইনের আশ্রয়ে থেকে জনগণের অধিকার ুণœœ করছে।
সরকারের স্থানীয় প্রশাসনের অনিয়ম-দুর্নীতি অনেকটাই খোলামেলা। উপজেলা, জেলা প্রশাসন এমনকি আরো স্থানীয় পর্যায়ে ঘুষের হার সবার জানা। নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ ছাড়া কাজ হবে না। জমির কেনাবেচা, খাসজমি বণ্টনে বিপুল অনিয়ম, ঘুষ-দুর্নীতি ক্রমবর্ধমানহারে এ দেশে হচ্ছে। এর সাথে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমে জমি অধিগ্রহণ। যারা জমি হারিয়েছেন তারা এর উপযুক্ত মূল্য পাবেন; কিন্তু এ অর্থ সংগ্রহ করার জন্য তাদের ঘুষ দিতে হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের সরকারি সাহায্য কর্মসূচিতে কী পরিমাণ দুর্নীতি হচ্ছে তা সবার জানা। এখন এসব কাজ কারা করছেন। প্রজাতন্ত্রের নিয়োগ করা কর্মকর্তারা কি এসব করছেন না? প্রজাতন্ত্রের সেবকদের দায়িত্ববান করার জন্য জোরদার কর্মসূচি দরকার ছিল। একটা বার্তা এমন থাকা দরকার ছিল, কেউ যদি জনগণের অধিকার হরণ করে তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাহলে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ বা কমপক্ষে সীমিত হতো। সরকার দেখা যাচ্ছে বিপরীত নীতি গ্রহণ করছে।
সরকার প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এটা যদি প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের আসল সুরক্ষা হতো তাতে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়; কিন্তু এ ধরনের ‘সুরক্ষা’ বর্তমানে চলা অনিয়ম-দুর্নীতিকে আরো লাগামহীন করবে। বাংলাদেশের সংবিধানের চেতনায় এ দেশের মালিক জনগণ। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের সেবা দেয়ার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত। বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, জনগণ সেবা পাচ্ছে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে তাদের অধিকার লুণ্ঠিত হচ্ছে। এমনকি তাদের জান-মালও লুণ্ঠিত হচ্ছে। এখন দরকার ছিল জনগণের অধিকারের সুরক্ষা দেয়া। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য সরকারের অনুমতি নতুন করে যুক্ত হলে এ দেশে অনিয়ম-দুর্নীতি আরো বাড়বে। সে ক্ষেত্রে বর্তমানে চলা জনগণের অধিকারহীনতা আরো বেগবান হবে। বিষয়টি সরকারকে অবশ্যই ভাবতে হবে। বিশেষ করে জনগণের অধিকারের বিষয়ে সরকারকে আরো যতœবান হওয়া দরকার বলে আমরা মনে করি।