ডিসেম্বরের শীতে বাংলাদেশে করোনার সেকেন্ড ওয়েভ (দ্বিতীয় ঢেউ) আসবে বলে জনস্বাস্থ্যবিদদের একটি অংশ দীর্ঘ দিন থেকে বলে আসছেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকেও বেশ কয়েকবার বলা হয়েছে, দ্বিতীয়বার সংক্রমণ শুরুর কথা। তবে এ নিয়ে অনেক জনস্বাস্থ্যবিদ ও এপিডেমিওলজিস্ট বলছেন, দ্বিতীয় ঢেউয়ের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই এবং শীতের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে কেউ কেউ দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে এমন যুক্তিও দেখাচ্ছেন।
তিনি বলেন, মহামারীর ওয়েভ বা ঢেউ হচ্ছে সংক্রমণ বিস্তারের একটি ভিজুয়াল রিপ্রেজেন্টেশন বা চিত্র। তথ্যের দিকে না তাকিয়ে শুধু গ্রাফ বা চিত্রের দিকে তাকিয়েই বলে দেয়া যায় একটা নির্দিস্ট সময় ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে নাকি কমছে।
তিনি বলেন, প্রতিদিন ক’জন নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে এর উপর ভিত্তি করে যে গ্রাফ অঙ্কন করা হয়, তা দিয়ে ওয়েভের ধরনটি বোঝা যায়। ওয়েভ প্রকাশের গ্রাফে সংক্রমণের সংখ্যা অবশ্যই লিনিয়ার বা প্রকৃত সংখ্যা হতে হবে, লগারিদমে রূপান্তরিত সংখ্যা দিয়ে ওয়েভ বোঝা যাবে না। সুতরাং কোনো গ্রাফে সংক্রমণের ওয়েভ প্যাটার্ন বুঝতে হলে প্রথমে লক্ষ্য করতে হবে গ্রাফটি কি ‘লিনিয়ার স্কেলে’ নাকি ‘লগারিদমিক স্কেলে’ আছে।
একটি মহামারীর ওয়েভে তিনটি অংশ থাকে : আপ স্লোপ বা উন্নতির ঢাল, পিক বা চূড়া এবং ডাউন স্লোপ বা অবনতির ঢাল। প্রতিদিন যখন সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন তা ‘উন্নতির ঢাল’ তৈরি করে। এভাবে বাড়তে বাড়তে একটা সময় সংক্রমণ আর বাড়ে না, তখন গ্রাফের ওই অবস্থাকে বলা হয় চূড়া। এরপর প্রতিদিন সংক্রমণের সংখ্যা আবার কমতে থাকলে ‘অবনতির ঢাল’ তৈরি হয়। এভাবেই তৈরি হয় মহামারীর একটি পূর্ণ ওয়েভ।
ড. মেহেদী আকরাম বলেন, যুক্তরাজ্যের করোনা মহামারীর ওয়েভের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রথম এবং দ্বিতীয় ওয়েভ ভালোভাবেই দৃশ্যমান। প্রথম ওয়েভটি শুরু হয় মার্চের মাঝামাঝিতে এবং শেষ হয় জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে। এরপর দ্বিতীয় ওয়েভ শুরু হয় আগস্টের শেষে যা পিকে পৌঁছে মধ্য নভেম্বরে। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় ওয়েভের অবনতির ঢাল। ২ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারের আদেশে লকডাউন করার কারণে এমনটি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, সেখানে করোনার তিনটি ওয়েভ দৃশ্যমান। প্রথম ওয়েভটি বিস্তৃত মধ্য মার্চ থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত। দ্বিতীয় ওয়েভের শুরু হয় ১৮ জুনে এবং শেষ হয় ৯ সেপ্টেম্বর। তৃতীয় ওয়েভটি শুরু হয় অক্টোবরের শুরুতে, যা এখন চূড়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই তৃতীয় ওয়েভেই এযাবৎকালের সর্বোচ্চ দৈনিক মৃত্যু তিন হাজার ১০০ জন রেকর্ড করা হয় গত ৪ ডিসেম্বর।
বাংলাদেশে করোনার গ্রাফের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে প্রথম ওয়েভই শেষ হয়নি, তাহলে দ্বিতীয় ওয়েভ এলো কোথা থেকে? বাংলাদেশে প্রথম ওয়েভের সূচনা ১০ এপ্রিল। এরপর থেকে প্রতিদিন সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে তাকে সমানুপাতিক হারে, যা পিক বা চূড়ায় পৌঁছে ২ জুলাই এবং তার পর থেকে সংক্রমণ ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। সেপ্টেম্বরের শেষে গিয়ে সংক্রমণের এই ক্রমাবনতি স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছে। আর এভাবেই প্রথম ওয়েভটি সম্পন্ন হয়।
এরপর অক্টোবরের শেষ থেকে সংক্রমণের সংখ্যা আবার ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে এবং সূচনা করে দ্বিতীয় ওয়েভটির। বাংলাদেশে করোনা মহামারীটি এখন দ্বিতীয় ওয়েভের ‘উন্নতির ঢালে’ অবস্থান করছে।
এ ব্যাপারে ড. মেহেদী আকরাম বলেন, ঠিকমতো টেস্টের সংখ্যা বাড়ানো গেলে হয়ত দ্বিতীয় ওয়েভটি পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে। অন্য দিকে ভারতে মহামারীটি এখনো প্রথম ওয়েভেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। অতএব নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বাংলাদেশে এখন করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ওয়েভের (ঢেউয়ের) সূচনালগ্নে রয়েছে।
করোনায় ২৪ ঘণ্টায় ৩১ জনের মৃত্যু : দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরো ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৬ হাজার ৮৩৮ জনে। গতকাল রোববার বিকেলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
সংস্থার অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা: নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো উল্লেখ করা হয়, এ দিন সুস্থ হয়েছেন দুই হাজার ৫৫২ জন। মোট সুস্থ হয়েছেন তিন লাখ ৯৫ হাজার ৯৬০ জন। গত শনিবার দেশে আরো ১ হাজার ৮৮৮ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়। এ ছাড়া আক্রান্তদের মধ্যে মারা যান আরো ৩৫ জন।
নেত্রকোনায় এক ব্যক্তির মৃত্যু
নেত্রকোনা সংবাদদাতা জানান, নেত্রকোনার বারহাট্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মুকতুল হোসেন (৮৫) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। তিনি উপজেলার সিংধা ইউনিয়নের সিংধা গ্রামের মৃত মধু শেখের ছেলে।
মুকতুল হোসেনের ছেলে রুবেল জানান, গত ২৮ নভেম্বর আমার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তাররা বিভিন্ন বিভন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আমাদের জানানো হয় তার ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে। মেডিক্যাল হাসপাতালে ভর্তির পর নেত্রকোনা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে জানানো হয় বাবার করোনা শনাক্ত করা হয়েছে। করোনা ওয়ার্ডে স্থানান্তর করার পর গত বৃহস্পতিবার রাতে তার মৃত্যু হয়।
চট্টগ্রামে একদিনে দুইজনের মৃত্যু
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামে একদিনে করোনায় আক্রান্ত হয়ে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় করোনা পজিটিভ হয়েছেন আরো ১৪৭। নতুন শনাক্তদের মধ্যে ১৩৩ জন নগরীর ও ১৪ জন বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। গতকাল রোববার চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা: শেখ ফজলে রাব্বি বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় এক হাজার ২৫৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয় ১৪৭ জনের।
সিভিল সার্জন জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত চট্টগ্রামে করোনা শনাক্ত হয়েছে ২৬ হাজার ৪১০ জনের। এর মধ্যে ২০ হাজার ৫৬ জন নগরীর ও ৬ হাজার ৩৫৪ জন বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ের বাসিন্দা। একই সময়ে করোনায় মারা গেছেন মোট ৩২২ জন। এর মধ্যে ২২৭ জন নগরীর ও ৯৫ জন উপজেলার বাসিন্দা।
সিভিল সার্জন জানান, ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষায় ১৭ জন, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ১১১ জন, আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে পাঁচজন, আরটিআরএলতে ১৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।