করোনা-বিপর্যস্ত বিশ্বে খ্রিস্টীয় ২০২১ সালের কাছে মানুষের প্রত্যাশা মঙ্গল ও সুসংবাদের। বিভিন্ন দেশে করোনা প্রতিরোধী ভ্যাকসিনের কার্যক্রম শুরু হওয়ার সংবাদ মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারির মধ্যে করোনার টিকা দেয়া শুরু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
বিগত বছরটিতে করোনা মহামারী জাতীয় জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে আঘাত হেনেছে। সে আঘাত ছিল এতটাই অস্বাভাবিক ও আকস্মিক যে, তা মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুতির সময় পাওয়া যায়নি। এর ফলে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পে খুব বড় সংকট হতে পারত; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত কিছু প্রণোদনার ব্যবস্থা করায় তেমন সমস্যা হয়নি। তা সত্ত্বেও হাজার হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। ছোট ছোট অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অসংখ্য প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাই হয়। যেসব প্রবাসী শ্রমিক করোনা মহামারীর আগে ছুটিতে দেশে এসেছিলেন, তাদের অধিকাংশের পক্ষে কর্মস্থলে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে কয়েক লাখ শ্রমিক কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে আসেন।
সামগ্রিকভাবে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা পূর্ববর্তী কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে বিদায়ী বছরটিতে। প্রায় দুই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। এ বছর যদি করোনা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে, তাহলে কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সরকারের একার পক্ষে কঠিন হবে।
করোনা মহামারীর মধ্যেই বিগত বছরে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা বন্যাকবলিত হয়। সে বন্যাও ছিল দীর্ঘস্থায়ী। বাড়িঘরের তো বটেই, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরকার সাধ্যমতো ত্রাণ তৎপরতা চালিয়েছে। পাঁচ হাজার কোটি টাকা স্বল্প সুদে কৃষিঋণের প্রণোদনা দেয়া হয়। কিন্তু অতি অল্পসংখ্যক কৃষকই সেই ঋণের সুবিধা পেয়েছেন। সেই ঋণের প্রায় পুরোটাই কৃষকের ঘরে না গিয়ে পড়ে রয়েছে ব্যাংকে।
বিদায়ী বছরের একেবারে শেষ সময় বাজারে চালের দাম কমাতে সরকার ১০ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বেসরকারি খাতে আরও ১০ লাখ টন চাল আমদানির সুযোগ দেয়া হবে। কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে চাল, গম, ডাল, পেঁয়াজ ইত্যাদি আমদানির চেয়ে কৃষককে প্রণোদনা দিয়ে উৎপাদন বাড়ানোই হবে সুবিবেচনার কাজ। নতুন বছরে করোনা পরিস্থিতির উন্নতিই হোক বা অবনতিই ঘটুক, কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে।
এ বছরই শুরু হচ্ছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এ অর্থের ৮৮.৫ শতাংশ আসবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। বৈদেশিক উৎস থেকে আসবে ১১.৫ শতাংশ অর্থ। করোনা যে খুব শিগগিরই নির্মূল হবে সে সম্ভাবনা কম। করোনা মহামারীর সমস্যা শুধু একা বাংলাদেশের সমস্যা নয়। উন্নয়ন সহযোগী ও দাতা দেশগুলোরও সমস্যা। সেসব বিবেচনায় রেখেই এ বছর কাজ শুরু করতে হবে। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রথম বছরেই যদি হোঁচট খেতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালে শেষ বছরে গিয়ে বাস্তবায়ন নিয়ে সমস্যা হবে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দলিলে গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ধরা হয়েছে। প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমার সম্পর্ক বিশেষ নেই। প্রবৃদ্ধির সুবিধা যেন সব মানুষের কাছে পৌঁছে সে ব্যবস্থা করতে হবে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্ধারিত সময়ে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে ১ কোটি ১৩ লাখ মানুষের। তাই যদি হয় তাহলে সেটা খুশির কথা; কিন্তু যদি এ সংখ্যা দলিলেই আবদ্ধ থাকে তাহলে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে না।
সব মিলিয়ে সময়টি চ্যালেঞ্জের, বছরটি চ্যালেঞ্জের। সংক্রামক রোগতত্ত্ববিদরা মোটামুটি নির্ভরযোগ্য ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন। তবে গত এক বছরের বৈশ্বিক অবস্থার অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করা যায়, খুব শিগগির মানুষকে ছাড়বে না করোনাভাইরাস। এ অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গেই আমাদের বসবাস করতে হবে। সেভাবেই জীবনযাপন ও জীবিকার পরিকল্পনা করতে হবে। সরকারকেও পরিকল্পনা করতে হবে সেভাবেই। অপচয় ও দুর্নীতি যদি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই সাফল্য অর্জন সম্ভব হবে।
বিগত বছরটি আমাদের জীবনে এসেছিল অভিশাপের মতো। অনেকেই অকালে হারিয়েছেন তাদের প্রিয়জন। সেই সব শোকসন্তপ্ত পরিবারকে জানাই গভীর সমবেদনা। এমন সব কৃতী ব্যক্তিও চলে গেছেন, যাদের আকস্মিক মৃত্যুতে জাতীয় জীবনের বহু ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে শূন্যতার। সে শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
খ্রিস্টীয় নববর্ষে শুভকামনা রইল সবার জন্য।
সৈয়দ আবুল মকসুদ : লেখক ও গবেষক