দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা অনিয়মের প্রকাশ ঘটতে শুরু করেছে নানাভাবে। একের পর এক নামকরা বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে চলছে অনাকাক্সিক্ষত আর দুঃখজনক ঘটনা। মাসের পর মাস অচলাবস্থায় নিমজ্জিত বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। সব মিলে তীব্র ইমেজ সঙ্কটের মুখে পড়েছে বর্তমানে দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগে অতিমাত্রায় দলীয়করণ, শিক্ষক রাজনীতি, ছাত্র রাজনীতি, প্রশাসনের ওপর সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য ও প্রশাসনিক ব্যর্থতাসহ নানা কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমান এ সঙ্কটের কারণ। যেসব কারণে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্কট ঘনীভূত হয়েছে, তা যদি অব্যাহত থাকে তা হলে ভবিষ্যতে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের করুণ পরিণতি বরণ করতে পারে বলে মর্মে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকে। একই সাথে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক উচ্চশিক্ষার মান তলানিতে পৌঁছতে পারে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণের পাশাপাশি কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটছে আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগের ঘটনা। শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ আর আর্থিক দুর্নীতির কারণে প্রায় ক্ষেত্রেই বাদ পড়ছে মেধাবী প্রার্থীরা। প্রায় ক্ষেত্রেই যোগ্য আর মেধাবীদের বাদ দিয়ে তুলনামূলক কম যোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের ধারা দীর্ঘ দিন ধরে অব্যাহত থাকায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে নানা ক্ষেত্রে নানাভাবে। শিক্ষার মানের অবনতি ছাড়াও প্রায়ই বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষক কর্তৃক কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটছে। ব্যাহত হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। সম্প্রতি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কর্তৃক সরকারদলীয় একটি অঙ্গ সংগঠনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের আকাক্সক্ষা প্রকাশ করায় তীব্র প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়ায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের মর্যাদার বিষয়টি। এ ঘটনার মাধ্যমে প্রকাশ হয়ে পড়ে কতটা অন্ধ দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যার ঘটনার পর ভিসির বিতর্কিত অবস্থান, তার বিরুদ্ধে পদত্যাগের দাবি এবং তার পদত্যাগ করতে না চাওয়ার ঘটনায় তিনি যেমন সমালোচিত হয়েছেন বিভিন্ন মহলে তেমনি মানুষ অভিযোগ তুলেছেন সর্বত্র ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত দলীয়করণ করা বিষয়ে। সর্বশেষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কর্মকাণ্ডে মর্মাহত হয়েছেন সচেতন দেশবাসী। এত কিছুর পরও তার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ না নেয়ায় অধিকতর বিস্মিত হয়েছেন অনেকে।
বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে যেমন নানা ধরনের দুর্নীতি অনিয়মের খবর অনেক দিন ধরে প্রকাশ পাচ্ছে, তেমনি প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনৈতিকতার খবর। দলীয় আর তুলনামূলক অযোগ্যদের শিক্ষক নিয়োগের কুফল হিসেবে এটিকে দেখছেন অনেকে। উচ্চশিক্ষা অঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ কলুষিত হওয়ার জন্যও একে দায়ী করছেন অনেকে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণসহ বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা ঘটছে অনেক দিন ধরে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এটি ন্যক্কারজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আগে দলীয়করণের অভিযোগ থাকলেও টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ তেমন একটা শোনা যায়নি। কিন্তু এখন বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশাল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগের খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। আর কোনো বিভাগে প্রথম, দ্বিতীয় স্থান অর্জনসহ মেধাবীদের বাদ দিয়ে মেধা তালিকায় অনেক পেছনের প্রার্থীদের দলীয় ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। এমনকি বিভাগের অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম স্থান অধিকারী স্বর্ণপদক বিজয়ী প্রার্থী যাতে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারে, সে জন্য ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী কর্তৃক প্রার্থী অপহরণের ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। গত ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে এ আলোচিত ঘটনা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের স্নাতকে সিজিপিএ-৪-এর মধ্যে ৩ দশমিক ৮৮ এবং স্নাতকোত্তরে ৩ দশমিক ৯৬ অর্জন করেন এমদাদুল হক। এ ধরনের নম্বর অর্জনসহ দুই পরীক্ষায়ই প্রথম স্থান অধিকার করায় তিনি লাভ করেন ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক’।
গত ২৭ মার্চ বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার দিন তাকে অপহরণ করে মারধর শেষে শিবির আখ্যায়িত করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। ফলে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি তিনি। পরবর্তীতে অবশ্য এ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কিছু ছাত্রলীগ নেতাকর্মী কর্তৃক এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে মর্মে খবর প্রকাশিত হয়।
বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দিন ধরে সৃষ্ট নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা আর অচলাবস্থার কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, ভবিষ্যৎ পরিণতি নিয়ে বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
আন্দোলনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়কে বিপথে পরিচালিত করা হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক সরকারি অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়ার হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। গত ৯ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় শ্রমিক লীগের ১২তম জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ আর অনিয়ম বিষয়ে তীব্র হতাশা প্রকাশ করে একজন শিক্ষক বলেন, কথায় আছে মাছের পচন ধরে মাথা থেকে। আর জাতির পচন ধরে শিক্ষার মাধ্যমে। আর শিক্ষার পচন ধরে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে।
কয়েক বছর ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় গোটা দেশবাসীর সামনে প্রকাশ হয়ে পড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, আবাসিক হল প্রশাসন কিভাবে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছে সরকারি ছাত্র সংগঠন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ছাত্র সংগঠনের ইচ্ছায় যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চলে তা হলে সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কখনো উন্নত হতে পারে না। সেখানে নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তারই ফল এখন জাতি দেখছে। ওই সব বিশ্ববিদ্যালয় কখনো আন্তর্জাতিক কোনো র্যাঙ্কিংয়ে স্থান পেতে পারে না। তিনি বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল মূলত নিয়ন্ত্রণ করছে সরকারি ছাত্র সংগঠন। নামে মাত্র থাকা হল প্রশাসন কিছু কাগজপত্রে স্বাক্ষর করা ছাড়া তাদের আর কোনো ভূমিকা নেই হল প্রশাসন পরিচালনায়। আর অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তো সম্পূর্ণরূপে ঘেরাও হয়ে আছেন সরকারি ছাত্র সংগঠন কর্তৃক। উপরন্তু অনেক ভিসি তো নিজেই চরম দলবাজের ভূমিকায় অবতীর্ণ।
তিনি বলেন, একসময় দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা ছিলেন দেশের অন্যতম সম্মানিত আর জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি। কিন্তুকয়েক বছর ধরে দেখা গেছে একের পর এক বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের দুর্নীতি, অনিয়মের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। যে দেশে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অনৈতিকতার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে সে দেশর উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কী ভয়াবহ দুর্দিন চলছে তা সহজে বোঝা যায়। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ খুবই করুণ অবস্থায় পৌঁছবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যেসব অনিয়ম আর অনৈতিকতার খবর প্রকাশিত হচ্ছে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব কারণে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকও বিব্রত। অনেকে শঙ্কিত দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ আর উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য সব ক্ষেত্রে দলীয় সঙ্কীর্ণ চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে যোগ্য ভিসি ও শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন অনেক শিক্ষক।