রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩০ পূর্বাহ্ন

মৃত মেয়েটিকে তিনবার ধর্ষণ না করলেও চলতো!

ডা. আলী জাহান
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২১
  • ১৯৪ বার

ঢাকার কলাবাগান থানা এলাকায় ইংরেজি মাধ্যমের এ লেভেলের ছাত্রী আনুশকা নুর আমিনকে নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা এখন তুঙ্গে। বাংলাদেশের মানুষ সব সময় কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসেন। আপাতত সেই ব্যস্ততার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে আনুশকা নূর আমিনের মৃত্যুর ঘটনা। পুলিশ, ডাক্তার, আদালত থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও এই মহাযজ্ঞে আনন্দের সাথে যোগদান করছেন। রাষ্ট্রের ছোট কর্তা, বড় কর্তা, মাঝারি কর্তা সবাই মতামত দিচ্ছেন। প্রজারাও বাদ যাচ্ছেন না।
আনুশকার সাথে তার বন্ধু দিহানের কী সম্পর্ক ছিল তা কিছুটা অনুমান করা যায়। বাংলাদেশে ধর্ষণের একটি সংজ্ঞা দেয়া আছে। মেডিকেল সাইন্সে Forensic Medicine সাবজেক্ট যখন আমাদের পড়ানো হতো তখন থেকেই আমরা সেই সংজ্ঞা ঠোঁটস্থ করেছি, আত্মস্থ করেছি।

সাধারণ মানুষ সেই সংজ্ঞা না জানলেও, ডাক্তার, পুলিশ এবং আদালত তা নিশ্চয়ই জানেন বা জানা উচিত। সেই সংজ্ঞাকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে আনুশকার ঘটনাটিকে ধর্ষণ বলা একটু কঠিন। আমি সেই বিশ্লেষণে এখন যাচ্ছি না। ধর্ষণ হয়েছে কিনা তা ফরেনসিক পরীক্ষা, পুলিশ এবং আদালতের শুনানি এবং রিপোর্টে পরিষ্কার হবার কথা। রায়ের আগে সবগুলো ব্যাপার গোপনীয়ভাবে হবার কথা। চূড়ান্ত মতামত জানার জন্য আমাদের আদালতের রায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের সেই ধৈর্য নেই। আমাদের কর্তাব্যক্তিরা নিজস্ব উদ্যোগে মতামত দিয়ে চলেছেন। আনুশকা ধর্ষিতা হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে একবার। আর মারা যাবার পর মেয়েটিকে এবং মেয়ের পরিবারটিকে মোট কয় বার ধর্ষণ করা হয়েছে?

আনুশকা হত্যাকাণ্ডের এবং তথাকথিত ধর্ষণের একটি রগরগে বর্ণনা দিয়েছেন আমাদের পুলিশ বিভাগ। মৃত মেয়েটিকে প্রথমবার ধর্ষণ করা হলো। সেই সাথে তার পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধবীদের মান সম্মানকে ধর্ষণ করা হলো। বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন কি এই ধর্ষণকে সমর্থন করে? মেয়েটি ধর্ষিতা হয়ে অথবা অ্যাডভেঞ্চারে গিয়ে মৃত্যু বরণ করেছে। কিন্তু মরে গিয়েও মেয়েটি আবারও ধর্ষিতা হচ্ছে। তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবরাও একই সাথে ধর্ষিত হচ্ছে।
যে ডাক্তার প্রাথমিক ময়নাতদন্ত করেছেন তিনি ধর্ষণের একটি গ্রাফিক বর্ণনা দিয়েছেন। মিডিয়াকে ডেকে এনে চমৎকার ব্রিফিং করেছেন! ধর্ষণের আলামত থেকে শুরু করে ধস্তাধস্তির কোন প্রমাণ আছে কিনা তাও তিনি বলেছেন। আনুশকা ওখানে আবার ধর্ষিতা হয়েছে। তার সাথে তার পরিবারও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ফরেনসিক মেডিসিনের রিপোর্ট হবে গোপনীয়। সেই গোপনীয় রিপোর্ট আদালতে যাবে। আদালতে শুনানি হবে। তারপর সিদ্ধান্ত হবে আসলেই ধর্ষণ কার্য সংগঠিত হয়েছে কিনা। বাংলাদেশে কি এই আইন চালু আছে? ফরেনসিক ডাক্তারকে কে এই অধিকার দিয়েছে যে, তিনি মিডিয়াকে ডেকে এনে ধর্ষণের আলামতের বর্ণনা দেবেন? বাংলাদেশে কি ব্যক্তি বা পরিবারের গোপনীয়তা বলতে কিছু নেই? সবকিছু উদোম?
মৃত মেয়েটিকে তৃতীয়বার ধর্ষণের মহান কাজটি সম্পাদন করেছে আমাদের কিছু মিডিয়া! মানুষকে বিনোদন দেবার জন্য কিছু কিছু মিডিয়া মেয়েটিকে নিয়ে অনেক কাহিনী ছাপিয়েছে। পরিবারের পরিচয় প্রকাশ করেছে। মেয়েটির ছবি প্রকাশ করেছে। কোথায় রক্ত পাওয়া গেছে, বিছানার চাদর বা সোফায় শারীরিক সম্পর্কের আলামত পাওয়া গেছে- সেই খবরও কোন কোন মিডিয়া প্রকাশ করেছে। মৃত আনুশকার ধর্ষণ কার্য আবার সম্পাদিত হয়েছে। আমি যতদূর জানি যে বাংলাদেশে এই ধরনের একটি আইন রয়েছে যে ধর্ষিতা মেয়ের ছবি বা পরিচয় পত্রিকায় বা মিডিয়ায় প্রকাশ করা যাবে না। কে শুনে কার কথা? শুধু ছবি প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হয়নি পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলগুলো। পরিবারের চৌদ্দগুষ্টির খবর পর্যন্ত প্রকাশ করেছে। কী তামাশার ব্যাপার!
আনুশকা ধর্ষণ এবং হত্যাকাণ্ডের খবরের মাঝখানে আমাদের এক বড় পদের শাহেনশাহ নতুন একটি প্রশ্ন করেছেন। তিনি আনুশকার মা-বাবাকে প্রশ্ন করেছেন, ছেলেমেয়েরা কোথায় যায় এই খবর যদি না রাখতে পারেন তাহলে তাদের জন্ম দিয়েছেন কেন? খবরটি পড়ে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। বাচ্চা জন্ম দেয়ার নতুন এই শর্ত বাংলাদেশ কখন চালু হয়েছে? এই শাহেনশাহ কি সরকারের কর্মকর্তা? জনগণ কি ট্যাক্সের টাকা দিয়ে এই রাজপুত্রকে তাদের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য নিয়োগ দিয়েছে? সম্ভবত ওনার খেয়াল ছিল না। বাংলাদেশ কথা বললে সেই কথার জন্য কোন ট্যাক্স দিতে হয় না এবং পরিণতি ভোগ করতে হয় না। সেজন্যই আমাদের কথাগুলো লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষমতার আশেপাশে থাকলে আপনার ক্ষমতা অসীম। আপনি যা ইচ্ছা তা বলতেই পারেন। যা ইচ্ছা তা করতে পারেন। 
কোন মা-বাবাই চায়না তাদের ছেলেমেয়েরা এভাবে মৃত্যুবরণ করুক। কোন মা-বাবাই চায়না তাদের ছেলেমেয়েরা তাদের পরিবারের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠুক। তারপরেও ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে যায়। আমরা বলতে পারি কিছুটা হলেও মা-বাবাকে তার দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। রাষ্ট্রের কোনো দায়িত্ব নেই? ট্যাক্স দিয়ে যাদের মাসিক বেতন আমরা সরবরাহ করি তাদের কোনো দায়দায়িত্ব নেই? কেউ কেউ বলতে পারেন যে পিতা-মাতারা তাদের দায়িত্ব সেভাবে পালন করেননি। কিন্তু তাই বলে তাদেরকে সমাজে প্রকাশ্যে মানহানি করার অধিকার নিশ্চয়ই পুলিশ, মিডিয়া বা ডাক্তারের নেই। ১৮ বছর হয়ে গেলে সেই সন্তানের দায়-দায়িত্ব কি মা-বাবার উপর চাপানো যায়?
বাংলাদেশের যে রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে একটি মেয়ের গ্রুপ স্টাডির কথা বলে ছেলে বন্ধুর বাসায় সময় কাটানোকে অনেকেই মানতে চাইবেন না। বাংলাদেশের ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতি এই ব্যাপারটিকে সমর্থন করবে না। সে কারণে অনেকেই সেই ছেলে মেয়ের অভিভাবক দের উপর হয়তো ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। তাদের সেই রাগের যৌক্তিকতা আছে। তবে কিশোর-কিশোরী তরুণ-তরুণীদের মনের খবর যারা রাখেন তারা নিশ্চয়ই জানেন এই সময়ে তারা প্রচুর অনুকরণ ও অনুসরণ করে। বাংলাদেশের নাটক সিনেমায় এ ধরনের দৃশ্য দেখানো হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এই কিশোর-কিশোরীরা সেই নাটক এবং সিনেমার কাহিনী গুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। এর দায় দায়িত্ব নেবে কে? যারা এই কাজকে নাটক সিনেমায় সমর্থন করছেন তারাই আবার উল্টা বলছেন ধর্ষককে ফাঁসি দেয়া হোক। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, যদি প্রমাণিত হয় (আমার ব্যক্তিগত অভিমত) আইনের সংজ্ঞায় যাকে ধর্ষণ বলে বর্ণনা করা হয়েছে তা আসলে এ ক্ষেত্রে ঘটেনি এবং মেয়েটি নিরেট অ্যাডভেঞ্চারে গিয়ে মারা পড়েছে তাহলে তারা কী করবেন? যদি প্রমাণিত হয় দুজনের সম্মতিতে এ ধরনের কর্ম সম্পাদিত হতে গিয়ে হঠাৎ করে একজনের মৃত্যু হয়েছে তাহলে উনারা কী বলবেন? যারা এই কাজগুলোকে প্রমোট করেছেন তাদের বক্তব্য জানার বড় ইচ্ছে। তখন কাকে ফাঁসি দেবার জন্য উনারা দাবী করবেন?
যে মেয়েটি মারা গেছে সে তো কারো সন্তান। পরিণত বয়সি সন্তান। মেয়েটিকে কীভাবে মারা গেছে তা নির্ধারণের দায়িত্ব আদালতের ওপর আছে। আদালতের চূড়ান্ত রায় আসার আগে মৃত মেয়েটিকে আর ধর্ষণ করবেন না। এই ছেলে এবং মেয়ের পরিবারের অধিকার আছে বেঁচে থাকার। তাদেরকে বাঁচতে দিন। মৃত মেয়েটিকে ধর্ষণের সাথে সাথে তাদের পরিবারকে ধর্ষণ করবেন না। যদি আপনাদের রাগ প্রকাশ করতেই হয় তাহলে যে বা যারা এ ধরনের কাজকে বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রমোট করছেন তাদেরকে জবাবদিহিতার অধীনে নিয়ে আসুন।
ডা. আলী জাহান
কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট এবং প্রাক্তন পুলিশ সার্জন (Forensic Medical Examiner), যুক্তরাজ্য।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com