মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৫০ পূর্বাহ্ন

‘ইউরোপে যেতে না পারায় পরিবার আমাকে ত্যাজ্য করেছে’

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৯
  • ২৮৩ বার

পশ্চিম আফ্রিকা থেকে বহু মানুষ সাহারা মরুভূমি আর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপদজনক এই পথে অনেকেই এই চেষ্টা করেছে বহু বার। কিন্তু সফল হয় খুব সংখ্যক মানুষ।

যারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে, বাড়িতে তাদের জন্যে অপেক্ষা করে কঠিন বাস্তবতা। অনেক পরিবার তাদেরকে ফিরিয়ে নিতে দ্বিধা করে। অনেক সময় তাদেরকে ত্যাজ্যও ঘোষণা করা হয়।

আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবরা তাদের সঙ্গে আগের মতো মিশতে চায় না। তাদের চোখে তারা ব্যর্থ মানুষ।

ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার খরচ যোগাতে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ ধার-দেনা করে ও জমিজমা বিক্রি করে তারা তখন একেবারেই নিঃস্ব হয়ে পড়েছে।

এরকমই এক নারী ফাতমাতা। নিজের গল্প বলার সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। সাহারা মরুভূমি পার হওয়ার সময় এক তুয়ারেগ যাযাবরের খপ্পরে পড়েছিলেন তিনি। ছ’মাস তাকে তার স্ত্রী হিসেবে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল।

“তার নাম ছিল আহমেদ। সে ছিল খুবই শয়তান ধরনের লোক। সে বলতো, আমি নাকি তার দাসী। কারণ আমি কৃষ্ণাঙ্গ। আমরা নাকি নরক থেকে এসেছি।”

তিনি জানান, আহমেদ তাকে বলতেন একজন দাসীর সাথে তার প্রভু যা ইচ্ছে তা করতে পারে। শুধু তিনি নন, চাইলে তার বন্ধুরাও পারেন।

“তিনি তাদেরকে বলতেন, বাড়িতে যা আছে চাইলে তুমি তারও স্বাদ নিতে পারো। তারা প্রত্যেক দিন আমার ওপর নির্যাতন চালাতো।”

২৮ বছর বয়সী ফাতমাতা থাকতেন সিয়েরা লিওনের রাজধানী ফ্রিটাউনে, যখন তার জীবনের দুর্বিষহ এই অভিজ্ঞতার গল্প শুরু । তিনি চেয়েছিলেন ইউরোপে পাড়ি জমাতে।

আহমেদের হাত থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এর পরেই তিনি পড়ে যান কয়েকজন দালালের খপ্পরে, যারা তাকে আলজেরিয়ায় তাদের নিজেদের কারাগারে তাকে আটকে রেখেছিলেন।

এক পর্যায়ে তিনি ইউরোপে নতুন জীবনের স্বপ্ন পরিত্যাগ করেন। ফিরে যেতে চান ফ্রিটাউনে – যেখান থেকে তিনি তার এই যাত্রা শুরু করেছিলেন।

অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে এরকম একটি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন বা আইওএমের সাথে যোগাযোগ করেন ফাতমাতা। দেশে ফিরে যেতে তার যে খরচের প্রয়োজন – তা চেয়ে সংস্থাটির কাছে আবেদন করেন তিনি।

গত বছরের ডিসেম্বর মাসে তিনি মালি থকে বাসে করে ফ্রিটাউনে ফিরে গেছেন। প্রায় দু’বছর বাড়ির বাইরে থাকার পর।

কিন্তু বাড়িতে তার জন্যে কেউই অপেক্ষা করছিল না। কেউ তাকে স্বাগতও জানায়নি। বরং সবাই তাকে ফিরে যেতে দেখে অনেকটা বিরক্তই হয়েছে।

ফাতামাতা এতদিন তার মাকে দেখেন নি, দেখা হয়নি পেছনে ফেলে যাওয়া মেয়ের সাথেও, যার বয়স এখন আট বছর।

“বাড়িতে ফিরে আসবো বলে আমি খুব খুশি ছিলাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার ফেরা উচিত ছিল না।”

নিজের বাড়িতে ফিরে ফাতমাতা প্রথমে ভাই এর সাথে দেখা করতে গেলেন। কিন্তু তার আচরণ দেখে ভয় পেয়ে গেলেন তিনি।

“সে আমাকে বললো তোমার ফিরে আসা উচিত হয়নি। তুমি যেখানে গিয়েছিলে সেখানেই তোমার মরে যাওয়ার দরকার ছিল। কারণ তুমি তো বাড়িতে কিছু নিয়ে আসতে পারো নি।”

ফাতমাতা বলেন, এর পরে তার আর মায়ের সাথে দেখা করার সাহস হয়নি।

ইউরোপে যাওয়ার জন্যে দালালদের যে অর্থ দিতে হয়েছিল সেটা জোগাতে তিনি তার এক খালার কাছ থেকে কাপড়ের ব্যবসা করার নামে ২,৬০০ ডলার চুরি করেছিলেন।

“আমি শুধু ভাবছিলাম, কিভাবে আমি কিছু অর্থ জোগাড় করতে পারি – যা দিয়ে আমি ইউরোপে যেতে পারবো। আমি ভাবতাম, যদি ইউরোপে যেতে পারি তাহলে আমি এর তিন গুণ অর্থ ফেরত দিতে পারবো। তখন আমি আরো ভালোভাবে আমার মা ও খালার দেখাশোনা করতে পারবো।”

ওই চুরির পর খালার সাথে তার ও তার মায়ের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। খালা মনে করেন যে এসব কিছুর পেছনে ছিলেন ফাতমাতার মা।

ফাতমাতার মা বলেন, “এসব নিয়ে আমার মনে খুব কষ্ট ছিল। খুবই কষ্ট। একারণে আমার মেয়েকে যদি কখনো জেলে যেতে হয়, কষ্টে আমি মরেই যাবো।”

সিয়েরা লিওনে ফাতমাতার মতো প্রায় ৩,০০০ মানুষ গত দু’বছরে ইউরোপে পাড়ি জমাতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরে এসেছে।

দেখা গেছে, আগে এই পরিবারগুলো তাদের একজনকে ইউরোপে পাঠাতে অর্থ সংগ্রহ করতো।

কিন্তু এখন আর কোন পরিবার সেটা করতে চায় না। কারণ তারা দেখেছে, এভাবে দেশ ছাড়তে গিয়ে তাদের অনেককে জেলে যেতে হয়েছে, কিম্বা নৌকা ডুবে সমুদ্রেই মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে।

সেকারণে অনেকে তাদের ইউরোপে যাওয়ার ইচ্ছা বা পরিকল্পনা গোপন রাখেন। অর্থ ধার না করে তারা তখন নিজেদের জমি বিক্রি করেন দেন। অথবা বাড়ি থেকে অর্থ চুরি করে সেখান থেকে পালিয়ে যান।

আলজেরিয়ায় পাচারকারীদের জেল থেকে ফাতমাতার সাথে পালিয়েছিলেন আরো একজন নারী, ২১ বছর বয়সী জামিলাতু।

তার মা যখন বাড়ির বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন তখন তিনি মায়ের টাকা রাখার প্লাস্টিকের ব্যাগ চুরি করেন। সেখানে ছিল প্রায় ৩,৫০০ ডলার।

এই অর্থ জামিলাতুর মায়ের নিজের ছিল না। তিনিও ক্ষুদ্রঋণের আওতায় সেটা তারই এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার করেছিলেন।

বাড়ি থেকে জামিলাতু চলে যাওয়ার পর এক পর্যায়ে ঋণদাতা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং তার মায়ের বাড়ি দখল করে নেন। এমনকি তিনি যদি ঋণের অর্থ ফেরত না দেন, তাহলে তাকে হত্যারও হুমকি দেন।

এরকম অবস্থায় তিনি তার বাকি তিন সন্তানকে তাদের পিতার কাছে রেখে ফ্রিটাউন থেকে তিন ঘণ্টা দূরের শহর বো-তে পালিয়ে যান।

“মা আমার সাথে কথা বলতে চান না, এই অর্থের কারণেই। আমি ফিরে আসার পর তার সাথে আমার দেখাও হয়নি। দুই বছরেরও বেশি হয়ে গেছে আমি তাকে দেখিনি,” বলেন জামিলাতু।

এই মায়ের নাম মারিয়াতু। অনেক কথাবার্তা চালাচালির শেষ পর্যন্ত তিনি মেয়ের সাথে দেখা করতে রাজি হন।

যখন দেখা হয় তখন তারা দু’জনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। তার পর একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন।

এক পর্যায়ে জামিলাতু তার মায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন এবং মায়ের কাছে তিনি তার কৃতকর্মের জন্যে ক্ষমা চান। কিন্তু তখনও কেউ কারো চোখের দিকে তাকান নি।

জামিলাতু পরে আবার ফ্রিটাউনে ফিরে যান। “আমি এখন এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ, কারণ আমি আমার মাকে দেখেছি।”

কিন্তু তারপরেও জামিলাতুকে খুশি দেখাচ্ছিল না, কারণ তার মা তাকে বলে দিয়েছেন – ঋণের অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের পক্ষে একই ছাদের নিচে বসবাস করা সম্ভব নয়।

কিন্তু জামিলাতু ও ফাতমাতার পক্ষে এটা করা কঠিন। কারণ তাদের কোন চাকরি নেই। তারা দুজনেই একটি অভিবাসন সংস্থার অর্থ সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল।

ওদের দুজনের মতোই ইউরোপে যেতে ব্যর্থ এক ব্যক্তি শেকু বাঙ্গুরা এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর নাম এডভোকেসি নেটওয়ার্ক অ্যাগেইনস্ট ইরেগুলার মাইগ্রেশন।

ফিরে আসা অভিবাসন-প্রত্যাশীদের সাহায্য করতে সিয়েরা লিওনের সরকার যাতে আরো এগিয়ে আসে, সেজন্যে কাজ করছে সংস্থাটি। তারা নিজেরাও অল্প বিস্তর সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে থাকে।

যাদের থাকার জায়গা নেই তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়, পুলিশের সাথে কারো সমস্যা হলে তাদেরকে সাহায্য দেওয়া হয়, ব্যবস্থা করা হয় মানসিক কাউন্সেলিং-এরও।

“আমার এখানে এরকম অনেকে আছেন যাদের মানসিক সমস্যা রয়েছে। এরা বয়সে তরুণ। রাস্তায় থাকে।”

তাদের একজন ৩১ বছর বয়সী আলিমেমি। বছর তিনেক আগে তার চাচার কাছ থেকে অর্থ চুরি করে সাহারা মরুভূমি পার হয়ে তিনি ইউরোপে যেতে চেয়েছিলেন।

এসময় তার সঙ্গে থাকা দুজনের একজন মরুভূমি পার হওয়ার সময় ক্ষুধায় মারা গেছেন। আর অন্যজন ডিঙ্গি নৌকাতে করে ভূমধ্যসাগর পার হওয়ার সময় ডুবে মারা যান।

আলিমেমি বেঁচে গেলেও তার জায়গা হয় লিবিয়ার একটি বন্দী শিবিরে। পরে আইওএমের লোকেরা তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে সিয়েরা লিওনে ফেরত পাঠান।

প্রথমে তিনি ফিরতে রাজি ছিলেন না। কারণ তিনি জানতেন বাড়ির লোকজন তার এই ফিরে যাওয়াকে ভালোভাবে নিতে পারবেন না। এই ভয়ে তিনি ভীতও ছিলেন।

সিয়েরা লিওনে ফিরে যাওয়ার পর থেকে আলিমেমি তার বন্ধুদের সাথে ছিলেন। তার একজন ভাই শেখ উমর, যিনি একসময় পেশাদার ফুটবল খেলতেন, বলেছেন, “আমরা শুনতে পাচ্ছি যে সে নাকি ফ্রিটাউনে আছে। সে কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু তারপরেও পরিবারের কারো সাথে দেখা করতে সে সাহস পাচ্ছে না।”

শেখ উমর জানান যে তিনি তার ভাইয়ের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু এখন যদি ভাই এর সাথে দেখা হয় তাহলে তিনি চান তাকে যাতে গ্রেফতার করার পর তাকে বিচার করে শাস্তি দেওয়া হয়।

“সে যদি জেলখানায় মরেও যায় আমার খারাপ লাগবে না। আমি নিশ্চিত যে পরিবারের কেউই এজন্য কষ্ট পাবে না। কারণ আমাদের সবাইকে সে বড় ধরনের লজ্জায় ফেলে দিয়ে গেছে।”

আলিমেমি নিজেও তার ভাগ্যের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ ও হতাশ। মা অসুস্থ হয়ে ফিরে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। চাচার সাথে যে ব্যবসা করার কথা ছিল – সেটাও লাটে উঠেছে তার অর্থ চুরির কারণে।

“আমি বাড়িতে ফিরেছি ঠিকই কিন্তু এর ফলে কিছু পরিবর্তন হয়নি। আমি একটা শূন্যের মতো। যেখানে আছি আমার কাছে সেটা একটা নরকের মতো। লোকজন যেভাবে আমার দিকে তাকায় আমার ভালো লাগে না। তারা এমনভাবে তাকায় যেন আমি মানুষও না।”

যেসব অভিবাসন-প্রত্যাশী নিজেদের বাড়িতে ফিরে যেতে চান আইওএমের পক্ষ থেকে তাদেরকে ১,৫০০ ইউরো অর্থ সাহায্য দেওয়া হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রকল্প থেকে দেওয়া হয় এই অর্থ। অথবা এই সাহায্য কিন্তু নগদ অর্থে দেওয়া হয় না।

আত্মীয় স্বজন কিম্বা বন্ধু বান্ধবের কাছে করা ঋণ পরিশোধ করা হয় এই সাহায্য থেকে। তারা যদি কোন ব্যবসা করতে চান তাহলে সেটা প্রতিষ্ঠা করতেও আইওএম তাদেরকে সাহায্য করে।

আলিমেমিকে যে অর্থ সাহায্য দেওয়া হয়েছে সেটা দিয়ে তিনি একটি মোটর সাইকেল কিনেছেন। এটি তিনি অন্য চালকদের ভাড়া দেন ট্যাক্সি হিসেবে ব্যবহারের জন্য।

কিন্তু চার মাস পরেই একজন চালক মোটরসাইকেলটি নিয়ে পালিয়ে যায়। আলিমেমির বিরুদ্ধেই তখন এটি চুরির অভিযোগ ওঠে।

ফাতমাতা ও জামিলাতু এধরনের কোন সাহায্য পাননি। কারণ কেউ কেউ মালি থেকে বাসে করে ফ্রিটাউনে এসে মিথ্যা তথ্য দিয়ে দাবি করছিল যে তারাও ইউরোপে যেতে ব্যর্থ হয়েছে। তার পর থেকে এই প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

ফাতমাতা, জামিলাতু এবং আলিমেমি – এই তিনজনই এখন লোকজনকে সচেতন করার কাজ করছেন, যাতে তারা অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা না করে। তরুণদেরকে তারা বোঝাতে চেষ্টা করেন যে এভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেয়ে সিয়েরা লিওনে থেকে যাওয়াই বেশি ভাল।

কিন্তু তাদের বেলায় কিন্তু নিজেদের দেশ সেরকম থাকেনি।

ফাতমাতা বলছেন: “আমার তো দেওয়ার কিছু নেই। আমার মেয়েকেও আমি দেখতে পারি না। শুধু তার ছবি দেখে বেঁচে আছি। তাকে দেওয়ার মতো আমার কাছে কিছু নেই।”

আলিমেমি বলছেন, তিনি যে লজ্জা পেয়েছেন সেজন্যে তিনি কাউকে মুখ দেখাতে পারেন না। তিনি বরং ইউরোপে যাওয়ার জন্যে আরও একবার চেষ্টা করে দেখতে আগ্রহী।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com