ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র এহসান রফিকের ওপর নির্যাতনের বিচার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন তার বাবা। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন ভবিষ্যতে যেন আর কোনো বাবাকে তার সন্তানকে এভাবে নির্যাতিত হতে দেখতে না হয়।
এহসান রফিকের বাবার ভাগ্য ভালো যে, তার সন্তান প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছিল হল থেকে। কিন্তু বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারের বাবাকে বহন করতে হয়েছে সন্তানের লাশ।
আবরার হত্যার মতো ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত শুক্রবার রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শামসুজ্জোহা হলে সোহরাব হোসেন নামে এক ছাত্রকে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়েছে ছাত্রলীগের কর্মীরা। হল শাখা ছাত্রলীগের কর্মীরা সোহরাবকে রুমে ডেকে নিয়ে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার মাথায় ১৫টি সেলাই করতে হয়েছে। সোহরাবের রক্তাক্ত ছবি প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র এহসান রফিক হলের ছাত্রলীগ কমিটির কয়েকজন সদস্য কর্তৃক অমানবিক নির্যাতনের শিকার হন গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে। ছাত্রলীগের এক নেতা এহসানের কাছ থেকে একটি ক্যালকুলেটর ধার নিয়েছিলেন। সেই ক্যালকুলেটর ফেরত চাওয়ায় এহসানকে রুমে ডেকে নিয়ে হল শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা তাকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। পেটানোর একপর্যায়ে এহসান অজ্ঞান হয়ে পড়লে রাত সাড়ে তিনটার দিকে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়।
হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে হলে এনে আটকে রাখা হয়। সকালে তার অবস্থার অবনতি হলে তাকে আবার হাসপাতালে নেয়া হয়। এবারো এহসানকে হাসপাতাল থেকে হলে এনে আটকে রাখা হয়। এরপর একপর্যাযে ভাগ্যক্রমে এহসান হল থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। এরপর এহসানের চোখে মুখে গুরুতর জখমের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হতে এহসানের দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়। পরে এহসান রফিক মনের দুঃখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান।
দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল প্রশাসন অকার্যকর হওয়ায় একের পর এক ঘটছে এ ধরনের মর্মান্তিক আর শোকাবহ ঘটনা। প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণে যুগের পর যুগ সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে মেধাবী অনেক শিক্ষার্থীর ওপর চলছে অমানবিক নির্যাতন। দেশসেরা মেধাবী সন্তানেরা দেশসেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তাদের অনেককে শিকার হতে হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, লাঞ্ছনা আর অবমাননার।
কেবল মাত্র আবরারের মতো বেদনাদায়ক ঘটনার পরই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে বছরের পর বছর ধরে চলে আসা নীরব নির্যাতনের কিছু কিছু ঘটনা দেশবাসীর সামনে আসে গণমাধ্যমের সূত্র ধরে। এ ছাড়া যুগ যুগ ধরে চলা অগণিত নির্যাতনের ঘটনা থেকে যাচ্ছে আড়ালে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক অনেক আবাসিক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানিয়েছেন, নোংরা ছাত্ররাজনীতি না থাকলে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল প্রশাসন কার্যকর হলে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটত না। আবাসিক প্রশাসন দায়িত্বশীল আর কার্যকর হলে র্যাগিংয়ের মতো বিকৃত কালচার গড়ে উঠত না। গেস্টরুম গণরুম কেন্দ্রিক অবমাননাকর সংস্কৃতিও গড়ে উঠত না। ঘটত না মেধাবী শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন আর লাঞ্ছনার ঘটনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন আবাসিক ছাত্র দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, কত সম্মানিত, সচ্ছল পরিবারের কত মেধাবী ছাত্র ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী তাদের এলাকায় পরিচিতজনের কাছে হন সম্মান আর ভালোবাসার পাত্র। কিন্তু তাদেরকে যখন তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এভাবে সহপাঠীদের হাতে নির্যাতন আর লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়, হত্যার শিকার হতে হয় তখন মনের দুঃখ রাখার আর কোনো জায়গা থাকে না। যে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরের পর বছর ধরে শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষার্থী খুনের ঘটনা ঘটে সে জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে কিভাবে। সে বিশ্ববিদ্যালয় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে কিভাবে। এ ব্যর্থতার দায়ভার কি কেউ কোনো দিন নেবে না? এসব কি কোনো দিন বন্ধ হবে না?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক অনেক আবাসিক শিক্ষার্থী ক্ষোভের সাথে জানান, প্রতিটি আবাসিক হলে রয়েছেন একজন করে প্রভোস্ট। এ ছাড়া প্রতিটি হলে রয়েছেন ১০ থেকে ১২ জন করে হাউজ টিউটর বা আবাসিক শিক্ষক। কোনো কোনো হলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনুযায়ী ১৫ থেকে ২০ জন পর্যন্ত হাউজ টিউটর থাকেন। কিন্তু আবাসিক হলে বিশাল এই প্রশাসনের আসলে তেমন কোনো ভূমিকা নেই। সেখানে প্রশাসনের কোনো রাজত্ব চলে না। আবাসিক হলে যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের রাজত্ব। আর এ রাজত্ব বড় ভয়ঙ্কর আর অন্ধকার এক রাজত্ব। পুরো হলের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে।
সেখানে তাদের ইচ্ছাই সব কিছু। একেকটি আবাসিক হলে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠন যে এক ভয়াবহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে, তাদের হাতে কিভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা দিনের পর দিন জিম্মি অবস্থায় নিগৃহীত হচ্ছে তা যে হল প্রশাসন একেবারেই জানে না তা বিশ্বাস করা ঠিক নয়। অনেকেই সব কিছু জেনে শুনে চোখ বন্ধ করে থাকেন। জেনেও না জানার, দেখেও না দেখার ভান করে আছেন অনেকে। দীর্ঘদিন ধরে আবাসিক হলের শুধু প্রভোস্ট নয় বরং হাউজ টিউটর পর্যন্ত নিয়োগে বিবেচনা করা হয় দলীয় আনুগত্য।
শিক্ষার্থীরা জানান, প্রত্যেকটা হলে একেকজন হাউজ টিউটরের অধীনে বিভিন্ন ব্লক ও রুম ভাগ করে দেয়া থাকে। হাউজ টিউটরদের দায়িত্ব তার অধীনে থাকা রুমের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার খোঁজ খবর নেয়া, আবাসিক হলে তাদের সুবিধা অসুবিধা দেখা। এ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রভোস্টসহ হাউজ টিউটররা বেশ কিছু সুবিধা পেলেওে তাদের অনেকেই তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন না বলে অভিযোগ করলেন অনেক শিক্ষার্থী। উপরন্তু অনেকে আরো অভিযোগ করলেন তাদের অনেকে বরং তোয়াজ করে চলেন সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের।
অনেক সাবেক আবাসিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, পাঁচ থেকে ছয় বছর হলে কাটিয়েছি কিন্তু কোনো দিন কোনো হাউজ টিউটর চোখে দেখিনি। কাউকে কখনো কোনো দিন রুমে আসতেও দেখিনি।
অনেকে জানিয়েছেন কখনো কখনো হলে পুলিশের রেইড দেয়ার সময় দেখিছি কোনো কোনো হাউজ টিউটরকে আসতে। আবার কেউ কেউ জানিয়েছেন তারা কখনো কখনো দুয়েকজন শিক্ষককে দেখেছেন মাঝে মধ্যে শিক্ষার্থীদের রুমে আসতেন। বস্তুত প্রকৃত অর্থে দায়িত্ব পালন বলতে যা বোঝায় তা এর মধ্যে পড়ে না। তারা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রশাসনের ব্যর্থতা আর শিক্ষার প্রকৃত পরিবেশ প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে কেউ কেউ বনে যাচ্ছে খুনি, চাঁদাবাজসহ ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীতে যা খুবই দুঃখজনক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান আবাসিক শিক্ষার্থীদের মতে হল প্রশাসন অকার্যকর হওয়ার প্রধান কারণ হলো ছাত্ররাজনীতি, শিক্ষকরাজনীতি আর চূড়ান্ত দলীয়করণ। ছাত্ররাজনীতির কারণে গত কয়েক যুগ ধরে দেশে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠন কর্তৃক হল দখলের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এভাবে হল দখলের মাধ্যমে সত্যিকারার্থেই হলের সব কর্তৃক চলে যায় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে। বর্তমানে এটা এক চরম দুর্বিষহ অবস্থায় পৌঁছেছে।
সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের নেতা কর্মীরাই সত্যিকারার্থে আবাসিক হলের রাজা বাদশা। আর হল দখলে নেয়ার পর প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনের কাউকে চিহ্নিত করতে পারলে তাদেরকে হল থেকে বের করে দেয়া, পিটিয়ে হাত- পা ভেঙে দেয়া, বিছানাপত্র পুড়িয়ে দেয়া, কখনো কখনো বন্দুকযুদ্ধ আর হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। কখনো কখনো সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের নিজেদের মধ্যে মারামারিতেও হত্যার ঘটনা ঘটে। আবাসিক হলে প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মী সমর্থক ছাড়াও সাধারণ শিক্ষার্থীরাও নিরাপদ নয় সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে। তার সর্বশেষ নজির বুয়েটের আবরার।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলে নতুন শিক্ষার্থী ওঠানো, পুরনো শিক্ষার্থী নামানোর কাজটি দীর্ঘদিন ধরে পুরোপুরিভাবে পালন করে আসছে ছাত্রসংগঠন। আবাসিক হলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নানা কারণে নানাভাবে শারীরিক মানসিক নির্যাতন ছাড়াও সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা নানা ধরনের অপকর্ম পরিচালিত করে আসছে। চাঁদাবাজি, মাদক, ধর্ষণ, নারী কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম সংঘটিত হচ্ছে দেশের মেধাবীদের বিচরণক্ষেত্র উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রলীগ নেতা কর্তৃক ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালনের মতো কলঙ্কজনক ঘটনার কথা আজো ভোলেনি অনেকে। নোংরা ছাত্ররাজনীতির কারণে শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটছে অহরহ। বর্তমানে বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া বেদনাদায়ক আর লজ্জাকর ঘটনার কারণে এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা অনেক প্রবীণ জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গ নিজেদের এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী বলে পরিচয় দিতে বিব্রত বোধ করছেন। অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের আবাসিক হলে থাকার ব্যাপারে আতঙ্কিত।