ক’দিন আগে রাজধানীতে ও-লেভেলের এক ছাত্রী বন্ধুর বাসায় ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা যায়। অভিযোগ আছে, গ্রুপ স্টাডির কথা বলে মেয়েটিকে ডেকে নেয়া হয়। বিকৃত যৌনাচারের শিকার মেয়েটি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে হাইপোভোলেমিক শকে মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মেয়েটি অচেতন হয়ে পড়লে ধর্ষক বন্ধুই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওখানে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ বাসায় ওই মুহূর্তে অভিযুক্ত ছেলেটির আরো কিছু বন্ধু ছিল। ওরাও ধর্ষণে জড়িত ছিল কি না এখনো স্পষ্ট নয়। আদালত ডিএনএ টেস্টের নির্দেশ দিয়েছেন।
এ ঘটনায় যথারীতি সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অপরাধীর কঠোর শাস্তি দাবিতে মাঠে নামে বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধন, মোমবাতি প্রজ্বলন, বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এরূপ কোনো ঘটনা ঘটলে যা হয় আর কি! একেকটি ঘটনা ঘটে আর চার দিকে হইচই পড়ে যায়। প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধী ধরাও পড়ে। বিচার-আচার হয় এবং শেষাবধি অপরাধীর প্রাপ্য শাস্তি কখনো নিশ্চিত হয়, বেশির ভাগ সময় হয় না। এখানেও হয়তো তেমনই কিছু হবে। মামলা হয়েছে, তদন্ত চলছে। আশা করা যায়, বিচারও হবে। এতে হয়তো ভিকটিমের বাবা-মা, আত্মীয়-পরিজন, সতীর্থ-শুভানুধ্যায়ী এবং সর্বোপরি দেশের সাধারণ মানুষ একধরনের মানসিক সান্ত্বনা পাবে। কিন্তু, যে মেয়েটি তার সম্ভ্রম হারাল, অব্যক্ত যন্ত্রণার শিকার হয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল সে কি আর ফিরে আসবে? আরো বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ব্যবস্থা নেয়াতে কি এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ হচ্ছে বা হবে? না হয়ে থাকলে কেন?
এ দেশে যখনই কোনো কিশোরী-তরুণী যৌন নিপীড়নের শিকার হন, কিছু লোক অতি সহজে এ অন্যায়ের দায়-দায়িত্ব চাপানোর জন্য দুটো সহজ টার্গেট বেছে নেন। এক, ভুক্তভোগী মেয়ে ও তার অভিভাবক। দেখবেন, মেয়ের চরিত্র ভালো নয়, অভিভাবকরা মেয়েকে দেখেশুনে রাখেননি কেন- এ ধরনের কথাবার্তা মুখে মুখে ফিরছে। দুই, সরকার, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ। এদের অকমর্ণ্যতাই যে সব নষ্টের মূল, আমাদের কিছু বন্ধু প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে অতি দ্রুত এ রায় দিয়ে ফেলেন।
বিষয়টি একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। আমার মনে হয়, বাড়ন্ত বয়সের মেয়েদের সাবধানে চলা এবং তাদের প্রতি অভিভাবকদের সতর্ক দৃষ্টি রাখা যে জরুরি, এ বিষয়ে কেউই দ্বিমত পোষণ করবেন না; কিন্তু এটা বলার সময়ে আমরা অনেকেই এ বয়সী ছেলে-মেয়েদের সুপথে রাখতে ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সমাজ এবং রাষ্ট্রেরও যে বিরাট দায়িত্ব রয়েছে, সেটি বেমালুম ভুলে যাই। বেপথু ছেলে-মেয়ে এবং তাদের অভিভাবক ও পরিবার-পরিজনের সমালোচনা করেই আমাদের দায় সেরে ফেলি। সামগ্রিক পরিবেশের সুস্থিতি নিশ্চিতে আমাদের যে একটি কার্যকর সামষ্টিক ভূমিকা রাখা প্রয়োজন তা নিয়ে আমরা কতটুকু ভাবছি কিংবা কতটুকু করতে পারছি সে দিকে আমাদের বিশেষ মনোযোগ দেয়ার সময় এসেছে। আধুনিক যুগে আমরা যখন ছেলে-মেয়েদের সবাইকে স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছি, এ ছেলে-মেয়েগুলো কতক্ষণই বা মা-বাবার চোখের সামনে থাকে? বাসার বাইরে কোনো ছেলে বা মেয়েকে যদি সমাজের চোখে অগ্রহণযোগ্য কর্মে ব্যাপৃত হতে দেখা যায় তাকে নিবৃত করা এবং প্রয়োজনে বিষয়টি অভিভাবকদের গোচরে আনা কি সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না?
এবার অন্য একটি দিক ভেবে দেখা যাক। বাবা-মা দু’জনই যখন চাকরিজীবী, তাদের স্কুলগামী ছেলে-মেয়েদের দেখভাল করবে কে? গাঁওগেরামে একান্নবর্তী পরিবারে এটুকু সাপোর্ট দেয়ার জন্য কাউকে না কাউকে পাওয়া যায়। শহরাঞ্চলে ফুলটাইম কাজের বুয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। কাজের বুয়া পাওয়াও এখন অনেক মুশকিল। চাইল্ড কেয়ার টাইপের কিছু গড়ে ওঠেনি। মা-বাবার কেউ একজন চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর ঘরে থাকতে পারেন; কিন্তু আজকালকার দিনে একজনের বেতনে সংসার চালানো খুব সহজ নয়। তা ছাড়া একজন উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবীকে যদি ঘর পাহারা দিতে বলা হয়, এটা কি তার প্রতি সুবিচার হবে? আসলে, আধুনিক সমাজে যে বিষয়টি আমরা প্রায়ই ওভারলুক করে যাচ্ছি তা হলো- সন্তান জন্মদান থেকে শুরু করে বাড়ন্ত বয়সে তার দেখভাল করার যে বিশাল ও কঠিন কর্মযজ্ঞ তা কর্মজীবী বাবা-মায়েরা, বিশেষ করে উভয়েই যখন চাকরি করছেন, কিভাবে ম্যানেজ করবেন। এ বয়সের ছেলে-মেয়েদের জীবনের তিক্ত ও কঠিন দিকগুলোর অভিজ্ঞতা না থাকায় হুজুগ ও আবেগের বশে ভুল পথে পা বাড়ানোর আশঙ্কা থেকে যায়। এ জন্য সার্বক্ষণিক পরিচর্যা ও নজরদারির প্রয়োজন। এ অবস্থায়, বাবা-মা দু’জনই যদি চাকরিতে থাকেন আর ঠিকমতো সন্তানের খোঁজখবর রাখতে ব্যর্থ হন, সে ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে বেপথু হলে অবাক হওয়ার কিছু আছে কি?
আজকের দিনে নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে সমাজ ও রাষ্ট্র অনেক সোচ্চার। নারী নির্যাতন ও নারী নিগ্রহের বিরুদ্ধেও উচ্চকণ্ঠ; কিন্তু এতে করে কর্মজীবী নারীদের সংসার নির্বাহ ও পারিবারিক ব্যবস্থাপনায় যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে, তা নিরসনে আমরা কতটুকু দৃষ্টি দিচ্ছি? আমরা কি রাষ্ট্রীয়/সামাজিক ব্যবস্থাপনায় তাদের সন্তান-সন্ততিদের দেখভালের একটি ব্যাপকভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কি নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে এই ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে পারে? কর্মজীবী নারীদের এ অসুবিধার কথাটি বিবেচনায় নিয়ে তাদের কর্মঘণ্টা কি কমিয়ে দেয়া যেতে পারে? তাদের অফিসে উপস্থিতির বিষয়ে কি একটু নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা যেতে পারে? পারিবারিক প্রয়োজনে মাঝে মধ্যে অফিসের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার বিষয়টি কি সহৃদয়তার সাথে বিবেচনা করা যেতে পারে? যেখানে প্রযোজ্য, নারীদের জন্য কি ডিজিটাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ‘ওয়ার্কিং ফ্রম হোম’ সিস্টেম চালু করা যেতে পারে?
এবার আমি পুরো বিষয়টির অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সমাজে উঠতি বয়সের মেয়েদের পদে পদে অনেক বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়। এর মধ্যে একটি হলো- স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়ার পথে কিংবা ক্যাম্পাসে কিছু ছেলে তাদের পিছু নেয়। এদের মধ্যে আবার কিছু ছেলে পারিবারিক প্রতিপত্তি কিংবা রাজনৈতিক ছত্রছায়ার কারণে দুর্বিনীত হয়ে ওঠে। তারা স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে। কোনো মেয়েকে পছন্দ হলে তার কাছে প্রেমপ্রস্তাব পাঠায় এবং তা গৃহীত না হলে মেয়েটিকে নানাভাবে নিগ্রহ করে তার জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। আরেকটি অংশ থাকে যারা আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ গোছের। এরা প্রেম-ভালোবাসার চাহিদা মেটাতে সতত মেয়ে খুঁজে বেড়ায়। আসলে, বয়সটাই এমন। এ বয়সী ছেলে-মেয়েদের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রবল আকর্ষণ কাজ করে। কাজেই, এমন কিছু মেয়েও আছে যারা ছেলে পছন্দ হলে সোৎসাহে তার প্রস্তাবে সাড়া দেয়। এদের কেউ কেউ আবার নিজেই পছন্দমতো ছেলের সন্ধানে ব্যস্ত থাকে। নিঃসন্দেহে এটি সহজাত মানবীয় প্রবৃত্তিরই অংশ। কাজেই, এটাকে বাঁকা চোখে দেখলে মানব প্রকৃতিকেই অস্বীকার করা হবে। সমস্যা দেখা দেয়, একটি মেয়ে যখন এমন কারো সাথে জড়িয়ে পড়ে যার নীতিবোধ দুর্বল, যার চরিত্রে মিশে আছে প্রতারণা ও লাম্পট্য। সব হারিয়ে একটি মেয়ে যখন বিষয়টি বুঝতে সমর্থ হয়, দেখা যায় অনেক দেরি হয়ে গেছে।
বিষয়টি আরো একটু বিস্তৃতভাবে দেখা যাক। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত, আলোচিত ও দামি শব্দটি মনে হয় ‘ভালোবাসা’। যদিও ভালোবাসার ব্যাপ্তি অনেক বড়, সাধারণভাবে বয়ঃপ্রাপ্ত নারী-পুরুষের পারস্পরিক ভালোবাসার বিষয়টিই সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। বঙ্গীয় মুসলিম সমাজ রক্ষণশীল। এ সমাজ ছেলে-মেয়েদের বিয়ে-পূর্ব প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্কে উৎসাহ জোগায় না। কিন্তু তার পরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা সমাজের বৃহত্তর পরিসরে ছেলে-মেয়েরা অনায়াশে মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছে। তা ছাড়া, এ বয়সী ছেলে-মেয়েদের গান-বাজনা, সিনেমা-থিয়েটার, গল্প-উপন্যাস ইত্যাদির প্রতি বিশেষ আগ্রহ কাজ করে, যাদের বেশির ভাগেরই অন্যতম প্রধান উপজীব্য হলো নর-নারীর প্রেম-ভালোবাসার রসায়ন। সুতরাং পরস্পরের সাথে অবাধ মেলামেশার সুবাদে কিছু ছেলে-মেয়ের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ব্যাপারটা এ পর্যন্ত হলে হয়তো অনেকেই তেমন কিছু মনে করতেন না। তবে মনে রাখা দরকার, এটি ইন্টারনেট ও আকাশ সংস্কৃতির যুগ। সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন। বাটনের এক চাপে যেখানে ইচ্ছে ঢুকে পড়া যায়, এমনকি নারী-পুরুষের বেডরুমেও। ফলত বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রবল সহজাত আকর্ষণ, এন্টারটেইনমেন্ট শিল্পের নিরন্তর ‘ভালোবাসা-ভালোভাসা’ গুঞ্জরণ এবং ‘অজানাকে জানা, অদেখাকে দেখার’ প্রচণ্ড ঔৎসুক্য এই সম্পর্ককে অনেকসময় এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যায় যাকে এ সমাজ কোনোভাবেই অনুমোদন দিতে প্রস্তুত নয়। বিপত্তির শুরুটা হয় এখানেই। ছেলে-মেয়ে অভিভাবকদের অগোচরে এমন সম্পর্ক গড়ে তোলে, যা এ সমাজ কেবল বিবাহিত নারী-পুরুষের ক্ষেত্রেই অনুমোদন দেয়। বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলছে, সমাজে লুকিয়ে নানাবিধ যৌন উত্তেজক মাদকের প্রাপ্যতা, যা সহজেই তাদেরকে অন্ধকার জগতে হারিয়ে যেতে সাহায্য করে। অনেকসময় এসব সম্পর্ক টেকে না। শুরু হয় অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, হুমকি-ধমকি, মামলা-মোকাদ্দমা এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা আত্মহত্যা কিংবা হত্যা পর্যন্তও গড়ায়।
আমাদের বিশ্বাস, উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, সমস্যাটা যতটা না প্রশাসনিক বা বিচারিক, তার চেয়ে বেশি সামাজিক। এখানেই ফের চলে আসে সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়দায়িত্বের প্রশ্ন। আগে যেমনটি বলা হয়েছে, এ সমস্যার এমন অনেক দিক রয়েছে যেগুলোর সমাধান ব্যক্তি বা পরিবারের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। ব্যক্তি/পরিবার বড়জোর গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করতে পারে। সমাধান করতে হলে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সমস্যার প্রতিটি দিক নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তবে এটাও ঠিক, একটি সমাজে যখন কোনো অনাচার ছড়িয়ে পড়ে, তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের একার পক্ষে খুব বেশি কিছু করা সম্ভব হয় না। কাজেই রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রক ভূমিকার পাশাপাশি ব্যাপক পরিসরে সমাজ ও সাধারণ্যের ইতিবাচক অংশগ্রহণেই কেবল বিদ্যমান সমস্যার নিষ্পত্তি হতে পারে। তবে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের কাছ থেকেই আসতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি