সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪২ অপরাহ্ন

মেগা প্রকল্পের চাপ সামলে রেলের মান উন্নয়ন কতটা হচ্ছে?

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৯
  • ২৫৯ বার

বাংলাদেশে রেলের যাত্রীসেবা, দুর্নীতি কিংবা অব্যবস্থাপনা নিয়ে সমালোচনা দীর্ঘদিনের। গত সপ্তাহে পরপর বড় দুইটি দুর্ঘটনার পর এখন রেলের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অথচ প্রতিবছরই রেলের জন্য বড় অংকের বাজেট বরাদ্দ এবং বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়ার কথা শোনা যায়। কিন্তু এরপরও রেলের কাঙ্খিত উন্নয়ন কেন হচ্ছে না?

যাত্রী সেবা নাকি ভোগান্তি?

ঢাকার অদূরে টঙ্গী রেল স্টেশন। বিকট শব্দে হুইসেল বাজিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকার কমলাপুরগামী তিতাস কমিউটার ট্রেনটি প্লাটফর্মে এসে থামে। পুরো ট্রেন যাত্রী বোঝাই। গেটের হাতল ধরেও যাত্রীদের ঝুলতে দেখা গেলো। ছাদেও প্রচুর যাত্রী। এই ট্রেনটিতে করেই কমলাপুরে ফেরার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু আগে থেকেই যাত্রীতে ঠাসা ট্রেনটিতে ওঠা সম্ভব হলো না।

বিকল্প উপায় তুরাগ এক্সপ্রেস। নির্ধারিত সময়ের প্রায় দুই ঘণ্টা দেরিতে আসা এই ট্রেনে উঠেও অবশ্য খুব একটা স্বস্তি নেই। দেরির বিড়ম্বনার পর এবার দেখা গেলো এই ট্রেনে ঠিকমতো দাঁড়ানোরও জায়গা নেই। বগিতে কোনমতে দাঁড়িয়েই কথা বলা হয় কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে। তারা অবশ্য এভাবেই যাতায়াত করে অভ্যস্ত।

জানতে পারা যায়, এই ট্রেনে যাত্রীদের একটা বড় অংশই টিকেট ছাড়া ভ্রমণ করেন। টিকেট আছে কি-না, তা যাচাই করতেও টিকেট চেকারদের এই ট্রেনে দেখা যায় না বলেই জানাচ্ছেন এক যাত্রী।

তিতাস কমিউটার স্বল্প দূরত্বের ট্রেন। যাত্রীসেবার আরো চিত্র বুঝতে বিমান বন্দর রেল স্টেশনেই নেমে পড়ি। উঠি সিলেটগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসে। সেখানে শোভন শ্রেণির বগিতে কথা হয় সিলেটগামী এক পরিবারের সঙ্গে। তারা টিকেট নিয়ে ভোগান্তির কথাই বেশি বললেন।

‘চেয়েছি এসি টিকেট। ওরা বলে নাই। শোভন চেয়ারও নাই। পরে শোভন সাধারণ শ্রেণিতে টিকেট পেলাম।’ বলছিলেন জালাল উদ্দীন নামে ঐ যাত্রী। তার বক্তব্য অনেকসময় টিকেট না পেলে কালোবাজারে বেশি দামেও টিকেট কিনতে হয়। এছাড়া বগিতে অচল ফ্যান, চেয়ার কোচের হাতল কিংবা ফ্লেক্সিবিলিটি সিস্টেম কাজ না করা, নোংরা টয়লেট, পানি না থাকা এবং সর্বোপরি যাত্রায় বিলম্ব নিয়ে অভিযোগের যেনো শেষ নেই যাত্রীদের।

রেলে নিরাপত্তা কতটা আছে?

দেখা যাচ্ছে, রেলে সেবার মান নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে যেমন প্রবল অসন্তুষ্টি আছে তেমনি নিরাপদ যাত্রা নিয়েও শংকা তৈরি হচ্ছে। যার মূল কারণ গেলো সপ্তাহেই বড় দুটি রেল দুর্ঘটনা। যার একটিতে মৃত্যু ঘটেছে ১৬জন যাত্রীর। পরিসংখ্যানেও দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে নিরাপদ বাহন হিসেবে পরিচিত রেলে গত ১০ বছরে দুর্ঘটনা ঘটেছে প্রায় আড়াই হাজার। যার নব্বই শতাংশই ঘটেছে লাইনচ্যুতির কারণে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৯৪ জন।

মঞ্জিলা আক্তার নামে সিলেটগামী এক যাত্রী বলছেন, তিনি দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকাতেই সড়ক পথে ভ্রমণ না করে রেলে যাতায়াত করেন। কিন্তু রেলে দুর্ঘটনা এবং নানা অব্যবস্থাপনার খবরে এখন তার মনেও ‘ভয়’ ঢুকে গেছে।

রেলে উন্নয়ন আটকে আছে কোথায়?

বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরে রেলের জন্য বাজেটে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। প্রতিবছর বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচও হচ্ছে। কিন্তু এসবের ছাপ কি রেলসেবায় দেখা যায়?

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক মনে করেন, রেলের উন্নয়নের যে পরিকল্পনা সেখানেই ঘাটতি আছে। তিনি বলছেন, রেলে নতুন বগি, ইঞ্জিন দরকার। নতুন বিনিয়োগ, অবকাঠামোও দরকার। কিন্তু সবার আগে দরকার দক্ষ জনবল। রেলে এখন জনবলেরই ঘাটতি আছে। এছাড়া বিদ্যমান রেল সেবাকে কতটা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সেই প্রশ্নও আছে।

তিনি বলছেন,‘আমরা এখন যে দুর্ঘটনাগুলো দেখি, সেগুলো কিন্তু পরিচালনা কিংবা রক্ষণাবেক্ষণ ঘাটতির কারণে দুর্ঘটনা। চালকের ভুল কিংবা সিগন্যাল সিস্টেমের ত্রুটির কথাও উঠে আসছে। এই সবকিছুই কিন্তু পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়, অবকাঠামো নয়। তারমানে এখানে দক্ষ জনশক্তি দরকার। কিন্তু সেখানে বিনিয়োগ নেই। বিনিয়োগ আছে অবকাঠামোতে।’

মি. হক বলছেন, এই মুহূর্তে রেল লাইনের সংস্কার, ঝুঁকির্পণূ ব্রিজ মেরামত ইত্যাদি কাজে নিয়মিত ব্যস্ত থাকার কথা। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের এসব কাজে বাজেট কম।

‘আপনি যদি ঘণ্টায় ৫০ কি.মি. এর পরিবর্তে ঘণ্টায় ১শ কি.মি. বেগে ট্রেন চালাতে পারেন তাহলেই তো এক ট্রেন দিয়েই দুই ট্রেনের ট্রিপ দেয়া যায়। তখন আর এতো বগি, ইঞ্জিন, ড্রাইভার লাগে না। এর জন্য তো রেললাইনের সংস্কার, সিগন্যালের উন্নতি করতে হবে। কিন্তু সেখানে নজর কম। মেগা প্রজেক্টে টাকা বেশি, সবার নজরই সেখানে।’

রেল কর্তৃপক্ষ কী বলছে?

রেলে যে বড় বড় প্রকল্প আছে এবং সেসব প্রকল্পেই যে বাজেটের বরাদ্দ টাকার সিংহভাগ ব্যয় হচ্ছে সেটা রেল কর্তৃপক্ষ স্বীকার করছে। তবে তারা বলছে, দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে এসব প্রকল্প সরকার থেকেই নেয়া হচ্ছে এবং এগুলোর প্রয়োজনীয়তাও আছে।

এখন চেষ্টা করা হচ্ছে মেগা প্রকল্পের চাপ সামলে রেলের নিয়মিত কার্যক্রমের মান উন্নয়নের জন্য।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: মোফাজ্জেল হোসেন বলছেন,‘মানুষ দেখছে যে রেলে হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ হচ্ছে। কিন্তু উন্নয়ন কোথায়? আসলে উন্নয়ন তো রাতারাতি হয় না। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যখন বাস্তবায়ন হবে, মানুষ যখন এর সুফল পেতে শুরু করবে, ৮ ঘণ্টার যাত্রা চার ঘণ্টায় নেমে আসবে তখনি কিন্তু উন্নতিটা দৃশ্যমান হবে।’

রেল সচিব জানাচ্ছেন, রেলে সেবার মান উন্নয়নে প্রচুর লোকবল দরকার। কিন্তু দীর্ঘদিন লোকবল নিয়োগ হয়নি। এখন নিয়োগ শুরু হয়েছে। কিন্তু রেল এমন একটি খাত যে এখানে দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠতে সময় লাগে। এখন চেষ্টা করা হচ্ছে, সেবার মান আরো বাড়ানোর। সূত্র : বিবিসি।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com