বাংলাদেশের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে এখন যা ঘটছে, আমার কাছে তা ঈশান কোণে কালো মেঘের ধীর সঞ্চারণ বলে শঙ্কা হচ্ছে। আমার মনের শঙ্কাটা সমমনা কয়েকজন বন্ধুর কাছে প্রকাশ করেছিলাম। তারা হেসে কথাটা উড়িয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, শেখ হাসিনা নিজের ব্যক্তিগত ক্যারিশমার জোরে দেশ শাসন করছেন। তার শক্তিশালী দল, প্রশাসন কোনো কিছুর দরকার নেই। তিনি একটি শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী গঠন করেছেন। সেনাবাহিনীকে প্রাপ্যের অধিক দিয়ে খুশি রেখেছেন। বিগ বিজনেসের বড় অংশই তার সমর্থক। মিডিয়াও আর আগের মতো হাসিনা প্রশাসনের প্রতি বিরূপ নয়। সরকার তাদের বিরূপতাকে বশ্যতায় পরিণত করতে পেরেছেন। মৌলবাদীদের মধ্যে মিলিট্যান্ট অংশটিও এখন আগের মতো সক্রিয় নয়। ভাস্কর্য প্রশ্নে সরকার পাঁচ পা পিছিয়েছে, হেফাজতিরাও পাঁচ পা পিছিয়েছে। সেখানে আপাতত এক ধরনের একটি স্থিতাবস্থা বিরাজ করছে।
এতগুলো কারণ দর্শানোর পর আমার বন্ধুরা পরম নিশ্চয়তার সঙ্গে বলেছেন, হাসিনা যতদিন আছেন, আর কারও নির্বাচনে জেতা বা ক্ষমতায় বসার সম্ভাবনা নেই। আমরা নিশ্চিন্তে নাকে নস্যি ঢুকিয়ে ঘুমাতে পারি। বন্ধুদের যুক্তিগুলো এতই বাস্তব এবং শক্তিশালী যে, তা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে এবং করিও। কিন্তু মাঝে মাঝে ভয় পাই। ঘটনা প্রবাহ দেখে ভাবি এত সুখ আমাদের কপালে সইবে তো?
১৯৭৫ সালের আগেও এমন একটি ভাবনা আমাকে পেয়ে বসেছিল। তখনো আমি বিদেশে। দেশে ফিরে লিখেছিলাম, ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’। তখনো দেশে ঝড়ের আগের প্রশান্তি বিরাজ করছিল। কোনো বিরোধী দল নেই। দু-চারজন যারা ছিলেন, তারা বিবরে আশ্রয় নিয়েছেন। উত্তরবঙ্গে মৌলবাদীদের এবং দক্ষিণবঙ্গে সিরাজ শিকদার ও হক পন্থীদের সন্ত্রাস দমন করা হয়েছে। ঢাকার ঐতিহাসিক হর্সরেস বন্ধ করে দেওয়া, মুসলমান নাগরিকদের জন্য প্রকাশ্যে মদ্যপান নিষিদ্ধ করা, মাদ্রাসা শিক্ষায় বিরাট অর্থ সাহায্য মঞ্জুর করা, লাহোরে ইসলামী সম্মেলনে যোগ দেওয়া ইত্যাদি কাজ দ্বারা সাধারণ মুসলমানদের মনেও স্বস্তির ভাব জাগানো হয়েছে। ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা, ’৭৩ সালে ৭৩ জাতি জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের স্তরে উঠে আসা ইত্যাদির ফলে দেশের বেশির ভাগ লোক ভাবতে শুরু করেছিলেন, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ছাড়া কোনো বিকল্প নেতৃত্ব নেই। এবং বঙ্গবন্ধু যতদিন বেঁচে আছেন, ততদিন বাংলাদেশে আর কারও পক্ষে নির্বাচনে জয়লাভ অথবা ক্ষমতায় বসা সম্ভব নয়।
সেই ১৯৭৫ সালে, যখন সমুদ্রের জল নিস্তরঙ্গ, আকাশ নির্মেঘ ঠিক তখনই ১৫ আগস্টের নির্মম ঘটনা। জাতির পিতাকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। পরবর্তী ঘটনা তো ইতিহাস। পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। প্রশ্ন, সুদীর্ঘ কয়েক বছর পর ২০২১ সালে কি বাতাসে বারুদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে? না, পাওয়া যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক অবস্থাও বাংলাদেশের জন্য ভালো। বঙ্গবন্ধুর আমলে তো মার্কিন সিআইএ শত্রুতা ছিল বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে। পাকিস্তান ও সৌদি আরব প্রকাশ্যেই চক্রান্ত পাকাচ্ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে। চীনও ছিল বাংলাদেশবিরোধী শক্তি।
এখন সেই অবস্থা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত। মার্কিন সিআইএ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো চক্রান্তে লিপ্ত নয়। পাকিস্তান এখন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। সৌদি আরব ও চীন হাসিনা সরকারের বড় বন্ধু। হাসিনা সরকার সৌদি অর্থে বাংলাদেশে মসজিদ-সভ্যতা গড়তে চান বলেও খবর রটেছিল। এই অবস্থায় বিএনপি যতই ঝুলন্ত গোঁফ খাড়া করার চেষ্টা করুক আর জামায়াতিরা যতই তাবিজ বানাক এবং সুশীল সমাজ যতই আস্তিন গোটাক, হাসিনা সরকারের কোনো ভয়ের কারণ আছে বলে কেউ মনে করেন না। আমিও মনে করি না।
বিনা বাতাসে ঝড় হয় না। বিনা মেঘে বজ্র গর্জায় না- এসব প্রবাদ জানা থাকা সত্ত্বেও এবং করোনা-নিয়ন্ত্রণসহ দেশের অতীতের কয়েকটি সংকট মোকাবিলায় সরকারের প্রশংসনীয় সাফল্য সত্ত্বেও ইদানীং সরকার ও আওয়ামী লীগের নতুন সংকটগুলো মোকাবিলায় হঠাৎ মূক ও বধির হয়ে যাওয়ার ঘটনায় আমি আবার শঙ্কাবোধ করতে শুরু করেছি। আমার এই শঙ্কাটাও সমমনা বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করেছি। অবশ্য তারা বলেছেন, আমি বিদেশে থাকি এবং দেশের খবর ভালোভাবে রাখি না বলেই আমার মনে এই শঙ্কার ভাব বাসা বেঁধেছে। আমি অতীতের ঘরপোড়া প্রাণী বলেই সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাচ্ছি। তাদের এই স্বস্তিবাণী আমাকে স্বস্তি দেয়নি। তাই তৃতীয় মতের পাঠকদের সঙ্গে শঙ্কাটা শেয়ার করছি। আশা করি, তাদের কাছ থেকে শঙ্কামুক্তির অভয় পাব।
প্রথম লক্ষ করলাম, ঢাকার ধোলাইখাল এলাকায় জাতির পিতার ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হবে বলে হেফাজতি এক নেতা হুঙ্কার দেওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার ও সংগঠন আশ্চর্য রকম নীরব। দু-একজন নেতা কথা বলেননি তা নয়, কিন্তু তা দরজির সংযত কাঁচিতে কাটছাঁট করা। এরপর যখন তারা সত্য সত্যই কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর নির্মীয়মাণ ভাস্কর্য ভাঙচুর করল তখন ভেবেছিলাম, এবার হেফাজতিদের রক্ষা নেই। ছাত্রলীগ, যুবলীগ সিংহনাদে মাঠে নামবে এবং মৌলবাদীদের হুঙ্কার থেমে যাবে। না, হিংস্র মৌলবাদীদের দমনে এবং জাতির পিতার মর্যাদা পুনরুদ্ধারে আওয়ামী লীগ বা ছাত্র ও যুবলীগের কোনো তৎপরতা দেখা গেল না। শোনা গেল, অপরাধীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের আপস-রফার বৈঠক বসেছে এবং তারা ভাস্কর্যের বদলে দেশে দশটি মুজিব মিনার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছেন। এরপর যুদ্ধরত দুই পক্ষকেই আর কোনো তৎপরতায় যুক্ত হতে দেখা যায়নি। মানুষ ভাবছে, আপসরফা হয়ে গেছে। দেশে স্থিতিস্থাপকতা তৈরি হয়েছে। জাতির পিতার যারা হাত ভাঙল, নাক ভাঙল, তারা হয়তো বিচার এড়িয়ে দেশের সুনাগরিক হয়ে গেলেন।
এর চাইতেও ভয়ংকর ব্যাপার আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। দলের সাধারণ সম্পাদক একজন খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগের একজন জনপ্রিয় নেতা। তার ভাই কাদের মির্জা একটি নিুপর্যায়ের নির্বাচনে জেতার জন্য দলের সরকার ও এমপিদের বিরুদ্ধে যে বিষোদগার করেছেন, তাতে মনে হয়েছিল, তিনি সম্ভবত বিএনপি অথবা জামায়াতের মনোনীত প্রার্থী। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও এমপিদের বিরুদ্ধে তার অভিযোগগুলো যদি সত্য হয়, তাহলে সেগুলো তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দলের হাইকমান্ডকে জানিয়ে বিচার চাইতে পারতেন। তার কাছে অভিযোগগুলোর কোনো প্রমাণ থাকলে তা দুদককে জানাতে পারতেন। তা না করে দল ও সরকারের বিরুদ্ধে তার এই লাগামহীন বক্তব্য শুধু দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেনি, দল ও দলের নেতৃত্বের সম্মান ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছে। তিনি সংগঠনের একজন প্রধান নেতার ভাই হয়ে দলের মন্ত্রী, এমপিদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগকে তার নির্বাচনী প্রচারণার মূলধন কেন করলেন, তা এক আশ্চর্যের ব্যাপার। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, তার এই আচরণ ও অসদাচরণ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন নেতারা কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। সম্ভবত তার কৈফিয়ত তলব করা হয়নি, শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা। বরং নির্বাচনে বিজয়ের পর দলীয় অভিনন্দন তিনি পাচ্ছেন এবং নির্বাচিত হওয়ার পর এখন সুর পাল্টে প্রধানমন্ত্রীর বন্দনা গাইতে শুরু করেছেন।
বিস্ময়ের পর বিস্ময়। কাদের মির্জার বক্তব্যের পর তারই নির্বাচনী এলাকার আওয়ামী এমপি এবং জেলার সাধারণ সম্পাদক তারই দলীয় কাদের মির্জার বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে নোংরা ভাষা ব্যবহার করেছেন এবং কাদের মির্জার বাপান্ত করে ছেড়েছেন। এই বাপান্তের কাজটি করতে গিয়ে প্রকারান্তরে ওবায়দুল কাদেরের পরিবারকে রাজাকারের পরিবার বানিয়ে ছেড়েছেন। ওবায়দুল কাদের কতটা নিষ্ঠ এবং সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর আপসহীন কর্মী ছিলেন, সেকথা জানেন না বাংলাদেশে এমন লোক নেই। তার পরিবারের কোনো সদস্য শান্তি কমিটির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন, কিন্তু ওবায়দুল কাদেরের বাবা যে রাজাকার ছিলেন না, একথা এত দীর্ঘকাল পর প্রমাণ করার দরকার নেই। বরং এই দুরভিসন্ধিমূলক উক্তিটি যিনি করেছেন, তিনি দলীয় এমপি হলেও তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। দলের হাইকমান্ডের এই স্পিকটি নট ভূমিকা এবং দলের ভেতর এই ফ্রিস্টাইল লড়াই এ কথাই কি প্রমাণ করে না দেশের তিন দফা ক্ষমতায় আসীন এত বড় দলটিতে অভ্যন্তরীণ ক্ষয় দেখা দিয়েছে? এটা কি কোনো দলের পতনের পূর্বলক্ষণ?
আমার বড় ভয় হয়, শঙ্কা হয়। ভবিষ্যৎ ভেবে শঙ্কাবোধ করি। ভাগ্য বিধাতার কাছে প্রার্থনা করি, শেখ হাসিনা যেন ‘চাটার দলের’ কবলমুক্ত হন এবং কঠোর হন। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও সংহতি আবার ফিরিয়ে আনতে পারেন। যুদ্ধের ময়দানে আওয়ামী লীগের যেন সম্মুখ যাত্রার পদধ্বনি শোনা যায়, পেছনে ফেরার বা পশ্চাদপসরণের পদধ্বনি নয়। এই মুহূর্তে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প বিএনপি-জামায়াত এবং আধা তালেবানি শাসন। এই তালেবানি শাসনের অন্ধকার যুগ আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান দেখেছে। বাংলাদেশকে যেন এই অন্ধকার যুগের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে না হয়। আওয়ামী লীগ এবং তাদের সরকার জনগণের যে কোনো সংকটে কথা বলুক, লড়াইয়ে আত্মপ্রত্যয়ী সাহস দেখাক। সংকটকে কাটাবার জন্য মূক ও বধিরের ভূমিকা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুক। এই ভূমিকা গ্রহণ করে অতীতে কোনো সরকার ও দল বাঁচতে পারেনি। আওয়ামী লীগ দলকে কবি আহসান হাবীবের কবিতার দুটি লাইন স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
‘থাকতে কি চাও নির্বিবোধ?
রক্তেই হবে সে ঋণ শোধ।’