অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ দিকে আজ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের জন্য ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ধর্মঘটের সাথে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটে গতকাল মঙ্গলবার থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে চরম ভোগান্তি শুরু হয় সারা দেশে। স্থবির হয়ে পড়ে মানুষের গতি। নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাতিলের দাবিতে কোনো ঘোষণা ছাড়াই এভাবে বাস, মিনিবাস, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক বন্ধ করে দিয়ে বিক্ষোভ করে পরিবহন শ্রমিকরা। এতে ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-জামালপুরসহ বিভিন্ন রুটের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
বরিশালের অভ্যন্তরীণ রুটে বাস চলাচল বন্ধসহ এ এলাকা দিয়ে দূরপাল্লার বাসও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বরিশালের বিভিন্ন জেলার সাথে ঢাকার পরিবহন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বরিশালের সাথে খুলনাসহ অন্যান্য এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
বরিশাল জেলা বাস মালিক গ্রুপের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার দে এবং জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ফরিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, নতুন সড়ক নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ধর্মঘট কিংবা কর্মবিরতি করেননি। বিভিন্ন স্থানে বাধা এবং ভাঙচুরসহ নতুন আইনে জেল-জরিমানার ভয়ে শ্রমিকরা নিজেরাই বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন।
ঢাকার নেতারা বলেছেন, আপতত বাস ধর্মঘটের কোনো সিদ্ধান্ত তাদের নেই। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের মহাসচিব ওসমান আলী গতরাতে নয়া দিগন্তকে বলেন, পরিবহন ধর্মঘটের সাথে ফেডারেশনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
তিনি বলেন, ২১ ও ২২ নভেম্বর ফেডারেশনের মিটিং আছে। সারা দেশের সদস্যরা সেখানে আসবেন। ওই মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে ফেডারেশন কী করবে। ওসমান আলী বলেন, শ্রমিকরা ভয় পেয়েছেন। জেল-জরিমানা এত বেশি মাত্রায় যে শ্রমিকদের ভয় পাওয়ারই কথা। যে কারণে শ্রমিকরা গাড়ি চালাতে চাচ্ছে না। শ্রমিকরা বলছেন, গাড়ি না চালিয়ে গ্রামে গিয়ে কৃষি কাজ করবে।
তিনি বলেন, বিআরটিএ-ও চালকদের ভয় দেখাচ্ছে। তারা শ্রমিকদের পক্ষের আইনগুলো সামনে না এনে শ্রমিকদের বিপক্ষে যেসব আইন আছে তার প্রচারণা চালাচ্ছে। এতে শ্রমিকরা আরো ভয় পাচ্ছেন।
মালিক-শ্রমিক ঐক্যলীগের সদস্য সচিব ইসমাইল হোসেন বাচ্চু বলেছেন, তারা ধর্মঘটের বিপক্ষে। ধর্মঘট দিয়ে তারা জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলতে চান না। তবে আইনের কিছু ধারা শিথিল করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, কিছু লোক যারা ক্ষমতার ভাগিদার তারাই ইন্ধন দিচ্ছে ধর্মঘটের। বাচ্চু বলেন, আইনের মধ্যে ৫২টি বিষয় রয়েছে যা শ্রমিকদের সরাসরি বিপক্ষে। এগুলো শিথিল করতে হবে। এ নিয়ে তারা সরকারের কাছে দাবি জানাবেন। তবে তা ধর্মঘটের মাধ্যমে নয়।
এ দিকে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্যপরিষদ নতুন সড়ক পরিবহন আইন স্থগিত করে সংশোধনের জন্য ৯ দফা দাবি উপস্থাপন করেছে। সংগঠনটি আজ বুধবার ভোর ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ট্রাকস্ট্যান্ডে অবস্থিত পরিষদের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দেয় সংগঠনটি। এ সময় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস ও সড়কে শৃঙ্খলা আনতে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্যপরিষদ মোটরযান আদেশ-১৯৮৩ এবং মোটরযান বিধিমালা-১৯৮৪’র যুগোপযোগী পরিবর্তন চায়। তবে ১ নভেম্বর ২০১৯ থেকে কার্যকর হওয়ায় সড়ক পরিবহন আইন পরিবহন শিল্পকে ধ্বংসের একটি সূক্ষ্ম নীল নকশা এবং পরিবহন সংশ্লিষ্ট বিশাল জনগোষ্ঠীকে বর্তমান স্থিতিশীল সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর পাঁয়তারা করা হচ্ছে।’
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয় ‘সড়ক দুর্ঘটনার জন্য শুধু চালক বা শ্রমিক একা দায়ী নয়, এ জন্য বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তাই শুধু চালক বা শ্রমিকদের দোষারোপ করলে চলবে না।’ সংবাদ সম্মেলনে ৯টি দাবি উত্থাপন করা হয়।
দাবিগুলোর মধ্যে সড়ক পরিবহন আইন স্থগিত করে মালিক-শ্রমিকদের আয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জরিমানা বিধান ও দণ্ড উল্লেখ করে আইন সংশোধনের পর একটি যুগোপযোগী ও বিজ্ঞানভিত্তিক সঠিক আইন প্রণয়ন করতে হবে, সড়ক সংশ্লিষ্ট যতগুলো কমিটি রয়েছে সেগুলোতে শ্রমিক প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কোনো মামলায় চালক আসামি হলে তা অবশ্যই জামিনযোগ্য ধারায় হতে হবে, প্রকৃত দোষী নির্ণয় করতে মালিক শ্রমিক প্রতিনিধিদের সংযুক্ত করে কমিটি গঠনপূর্বক গঠিত তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে হবে, সড়ক দুর্ঘটনার মামলায় কোনো গাড়ির মালিককে হয়রানি করা যাবে না।
আইন সংশোধনের দাবিতে তেজগাঁওয়ে মালিক শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। চালকদের কয়েকজন বলেছেন, তারা চরম ভয়ের মধ্যে আছেন। জরিমানার পরিমাণ এতটাই বেশি যে, তা ভাবাই যায় না। এর সাথে জেলের শাস্তিও আছে। ফলে তারা ভয়ের মধ্যে আছেন। এভাবে হাতকড়া পরে গাড়ি চালানো যায় না।
মেহেরপুর সংবাদদাতা জানান, মেহেরপুরে সোমবার দুপুর থেকে হঠাৎ বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। গতকালও সেখানে দ্বিতীয়দিনের মতো ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। এর ফলে মেহেরপুর-কুষ্টিয়া, মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর-মুজিবনগর সড়কে বাস চলাচলসহ দূর পাল্লার সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ দিকে আকস্মিক এ ধর্মঘটের সিদ্ধান্তে মানুষজন চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। বিশেষ করে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী ও চাকরিজীবী লোকজন বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
মাদারীপুরে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি : মাদারীপুর সংবাদদাতা জানান, গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে কোনো রকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই মাদারীপুরে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি পালন করছে পরিবহন শ্রমিকরা। জেলার বিভিন্ন রুটের স্বল্প ও দূরপাল্লার পরিবহন বন্ধ করেছে দিয়েছে পরিবহন শ্রমিকরা। শ্রমিকরা জানান, আইন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত তাদের এই কর্মবিরতি চলবে। তবে এ কর্মবিরতিতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে মাদারীপুরের বিভিন্ন রুটের যাত্রীরা।
নওগাঁয় তিন দিন ধরে ধর্মঘট : নওগাঁ সংবাদদাতা জানান, নওগাঁয় তৃতীয় দিনের মতো চলছে বাস ধর্মঘট। জেলার বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে জেলার ১১টি উপজেলার সকল রুটের মেইল ও লোকাল বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে রাজশাহী ও বগুড়া চলাচলের সকল বাসও। ফলে দূরপাল্লার রুটে যাতায়াতকারী যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। বাস ছাড়া অন্যান্য যানবাহন কম হওয়ায় ভাড়া যেমন দ্বিগুণ গুনতে হচ্ছে তেমনি সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছা নিয়েও দেখা দিচ্ছে অনিশ্চয়তা।
ঝালকাঠির ১৪ রুটে বাস বন্ধ : ঝালকাঠি সংবাদদাতা জানান, গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে ঝালকাঠির অভ্যন্তরীণ ১৪টি রুটে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে বাস ও মিনিবাস শ্রমিক সংগঠন। হঠাৎ করে বাস চলাচল বন্ধ হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন অসংখ্য যাত্রী। ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল কিংবা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে অধিক ভাড়ায় তাদের গন্তব্যে যেতে হচ্ছে।
ঝালকাঠি আন্তঃজেলা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বাহাদুর চৌধুরী বলেন, সরকার বাস মালিক ও শ্রমিকদের নিয়ে বৈঠক করে আইনটি সংস্কার করবে, এমনটা প্রত্যাশা করছি। অন্যথায় বাস ধর্মঘট চলতে থাকবে।
সাতক্ষীরায় চলছে ধর্মঘট : সাতক্ষীরা সংবাদদাতা জানান, সাতক্ষীরায় গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো চলেছে বাস শ্রমিকদের ধর্মঘট। সাতক্ষীরা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে মঙ্গলবার সকাল থেকে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। বন্ধ রয়েছে অভ্যন্তরীণ রুটের সব বাস চলাচলও। সোমবার রাতে দূরপাল্লার পরিবহন সাতক্ষীরা ছেড়ে গেলেও গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে সব বন্ধ রয়েছে। তবে দুই একটি বিআরটিসি বাস চলাচল করতে দেখা গেছে। বাস চলাচল বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন দূর-দূরান্তের যাত্রীরা। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ইজিবাইক, মাহেন্দ্র, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে যাতায়াত করছেন যাত্রীরা।
খুলনায় আজ বাস চলবে : খুলনা ব্যুরো জানায়, খুলনায় দ্বিতীয় দিনের মতো কর্মবিরতি পালন করেছে বাসচালকরা। গতকাল মঙ্গলবারও খুলনা থেকে রাজধানী ঢাকাসহ আভ্যন্তরীণ ও দূর পাল্লার কোনো রুটে বাস চলাচল করেনি। খুলনা থেকে বাস চলাচল বন্ধ থাকায় খুলনা রেলস্টেশনে যাত্রীদের তীব্র চাপ বেড়েছে। অনেক যাত্রী টিকিট না পেয়েও জোর করে ট্রেনে উঠেছেন।
এ দিকে চলমান পরিবহন ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল মঙ্গলবার সকালে স্থানীয় সার্কিটহাউজে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেনের সভাপতিত্বে পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের সাথে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দুই পক্ষের আলোচনা শেষে মধ্যস্থতার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতারা চলমান পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেন। আজ বুধবার থেকে খুলনায় বাস চলাচল করবে বলে পরিবহন শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন।
নওগাঁ-জয়পুরহাট রুটে বাস বন্ধ : ধামইরহাট (নওগাঁ) সংবাদদাতা জানান, নওগাঁর ধামইরহাটে বাস শ্রমিকরা গত সোমবার থেকে সকল রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত ছাড়াই শ্রমিকরা নিজ উদ্যোগে এ কর্মবিরতি পালন করছেন।
এ ব্যাপারে নওগাঁ জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো: জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কর্মবিরতি পালন সম্পর্কে জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের কোনো সিদ্ধান্ত নেই। তা ছাড়া মালিক সমিতিও এ কর্মবিরতি সম্পর্কে অবগত নয়। এ দিকে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই পরিবহন ধর্মঘটের কারণে যাত্রীরা বেকায়দায় পড়েছেন। আকস্মিক বাস বন্ধ হওয়ায় সবচেয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষার্থীদের। নিকটবর্তী স্থানে কোনোভাবে যাওয়া গেলেও দূরের যাত্রীরা পড়েছেন বেকায়দায়।
হিলি-বগুড়া রুটে ৩০টির স্থলে চলছে ৩টি : হিলি (দিনাজপুর) সংবাদদাতা জানান, হিলি-বগুড়া রুটে বাস চলাচল প্রায় বন্ধ রয়েছে। এ রুটে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি বাস নিয়োমিত চলাচল করলেও এখন চলছে দিনে দুই থেকে তিনটি বাস। আগে ১০-১৫ মিনিট পর-পর বাস চলাচল করলেও এখন চলছে চালক ও হেলপারের খেয়ালখুশি মতো।
এ কারণে গন্তব্যে পৌঁছাতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে যাত্রীরা। ভারত থেকে আসা যাত্রীরাও পড়েছেন চরম দুর্ভোগে। বাস মালিক সমিতির নেতারা দাবি করছেন, বাস মালিক সমিতির পক্ষ থেকে কোনো নিষেধ না থাকলেও মূলত নতুন সড়ক পরিবহন আইনের ভয়ে কোনো চালক বাস চালাতে চাচ্ছে না।