সেনাবাহিনীতে চাকরি দেওয়ার নামে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে চাকরিদাতা প্রতারকচক্রের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্ববৃহৎ এ শাখায় নিয়োগকে পুঁজি করে গ্রামের সহজ-সরল মানুষের বিশ্বাস স্থাপনে সেনাদপ্তর আওতাধীন এ থানা এলাকাকেই বেছে নিয়েছে চক্রের সদস্যরা। তাদের পরিপাটি পোশাক-পরিচ্ছদ আর চলন-বলন দেখে বোঝার উপায়ই নেই যে- তারা ভুয়া।
উদ্বেগের বিষয় হলো নিজেকে মেজর জেনারেল ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেলসহ ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে প্রতারকরা হুবহু সেনাবাহিনীর পোশাক পরে এখানকার নির্ধারিত বিভিন্ন অফিস কক্ষে বসে চাকরিপ্রার্থীদের ইন্টারভিউ নেওয়ার নামে নাটক করছে। বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার নাম করে নিরীহ এসব মানুষের কাছ থেকে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে মাথাপিছু ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। ইন্টারভিউর পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে সংঘবদ্ধ এ প্রতারকচক্রের সদস্যরা চাতুর্যের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লোগো সংবলিত বিভিন্ন দপ্তরের প্যাডে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে প্রকৃত নিয়োগপত্রের মতো হুবহু অথচ ভুয়া নিয়োগপত্র তুলে দিচ্ছে চাকরিপ্রত্যাশীদের হাতে। বসিয়ে দিচ্ছে স্মারক নম্বরও।
অভিযোগ উঠেছে, বহিরাগত দালাল ছাড়াও এ চক্রে জড়িত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যও। তারাই আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন চক্রের সদস্যদের। ভয়ঙ্কর এ প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে গত ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন মো. হাসান সিকদার নামে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর আলীপুর গ্রামের ভুক্তভোগী এক কৃষিজীবী। অভিযোগে ৬ চাকরি প্রত্যাশী এ চক্রের দ্বারা কীভাবে প্রতারিত হয়েছেন তা জানিয়েছেন সবিস্তারে। এর কয়েক দিন আগে রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় প্রতারক চক্রটির বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি করেছেন মো. সোলায়মান মেম্বার নামে জনৈক এক ব্যক্তি।
চাকরিদাতা প্রতারক চক্রটির হাতে প্রতারিত কয়েক যুবকের নামের একটি তালিকা ছাড়াও বিভিন্ন চাকরিপ্রার্থীর সরবরাহ করা একাধিক ভুয়া নিয়োগপত্রসহ এ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ রয়েছে আমাদের সময়ের কাছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএমপি সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, অভিযোগ তদন্তে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে অভিযুক্ত এক পুলিশ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। তদন্তাধীন বিষয়ে আর মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, অভিযোগ সত্য হলে চক্রের কেউ, এমনকি এদের সঙ্গে যাদেরই সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
ডিএমপি কমিশনারের দপ্তরে দাখিল করা অভিযোগে হাসান সিকদার উল্লেখ করেন, দেড় বছর আগে গোপালগঞ্জ সদরের মিয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা শেখ সেলিম ওরফে শুভর সঙ্গে পরিচয় হয় তার। সেলিম বর্তমানে মিরপুর ৬-এর বি-ব্লকের একটি বাসায় থাকেন। তিনি হাসানের কাছে নিজেকে মেজর জেনারেল বলে পরিচয় দেন। পরিচয়ের সুবাদে কয়েক দিন পর তিনি হাসানকে জানান, সেলিম অনেককেই সেনাবাহিনীতে জনপ্রতি ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন পদে চাকরি দিয়েছেন। হাসানের কোনো পরিচিত লোক যদি সেনাবাহিনীতে মালী ও বার্তাবাহক পদে চাকরি নিতে চান সেলিম তাদের চাকরির ব্যবস্থা করবেন।
সেলিমের কথা বিশ্বাস করে হাসান তার ছোট ভাই আহাদুল সিকদারকে মালী, ভাগিনা বনি ইসরাইলকে বার্তাবাহক, প্রতিবেশী মো. রানা মোল্লাকে বার্তাবাহক, মাসুদ রানাকে বার্তাবাহক, রিয়াজ মিয়াকে মালী, মাহমুদুল হাসানকে মালী পদে চাকরি নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। এরপর সেলিম মালী পদের জন্য জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা এবং বার্তাবাহক পদের জন্য সাড়ে ৮ লাখ টাকা চান। হাসান তার ভাইদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে জমি বিক্রি ও ধার-কর্য করে বিভিন্ন সময় নগদ ও ব্যাংক একাউন্টে সেলিমকে ৩৬ লাখ টাকা দেন।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, সেলিম ৩৬ লাখ টাকা পেয়ে চাকরিপ্রত্যাশীদের নিয়োগপত্র দেয়, যা ভুয়া বলে জানতে পারেন কয়েক দিন পরই। কারণ হাসানসহ সবাই ওই নিয়োগপত্র নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গেলে সেখানকার কর্মকর্তারা জানান সেগুলো ভুয়া। প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে সেলিমের কাছে ৩৬ লাখ টাকা ফেরত চান হাসান। টাকা ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকার করলেও আজ-কাল করে টালবাহানা করে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন সেলিম।
এদিকে এলাকার প্রতিবেশীরাও তাকে টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে। নিরুপায় হয়ে গত ৩০ জানুয়ারি তিনি মিরপুর থানা পুলিশের শরণাপন্ন হলে থানার টহল পুলিশ এসআই তপন সেলিমকে আটক করেন। এরপর মোহাম্মদপুর থানার পুলিশের এসআই মো. তুহিন কাজী মিরপুর থানায় এসে সেলিমের মামা পরিচয় দিয়ে হাসানকে উল্টো মামলা-হামলার ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে সে দিনগত রাত ২টার দিকে সেলিমকে মিরপুর থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান।
পরবর্তী সময়ে খোঁজ নিয়ে হাসান জানতে পারেন, সেলিম ও তুহিন কাজী চাকরিদাতা প্রতারক চক্রের সদস্য। তুহিনের প্ররোচনায় সেলিম বিভিন্ন লোকজনকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে টাকা নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে প্রতারণা করে আসছেন।
অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে গতকাল শনিবার এসআই তুহিন কাজী আমাদের সময়কে বলেন, একই জেলার বাসিন্দা শেখ সেলিমকে আমি আগে চিনতাম না। জনৈক হাসানের কিছু টাকার ঝামেলা নিয়ে ওই দিন রাতে (গত ৩০ জানুয়ারি) শেখ সেলিমকে মিরপুর থানায় আনা হয়। সেলিমের এক মামা যিনি আমার বন্ধু- তার অনুরোধে থানায় গিয়েছিলাম মাত্র। উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে চলে আসি। আমি মোহাম্মদপুর থানায় আছি। মিরপুর থানায় আমার কিছু করার কি ক্ষমতা আছে? অভিযুক্ত কাউকে ধরে এনে যদি ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে এর দায় কি আমার?
এ বিষয়ে মিরপুর থানা পুলিশই ভালো বলতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, ডিএমপি সদর দপ্তরে হাসান সিকদারের দায়ের করা অভিযোগের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমার কাছে সেদিনের ঘটনার বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। আমি আমার জবাব দিয়েছি। আমি কোনো অবৈধ কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত নই। আর শেখ সেলিমের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলেও দাবি করেন এসআই তুহিন কাজী।
অভিযুক্তকে ধরেও ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ সত্য নয় দাবি করে গতকাল মিরপুর মডেল থানার এসআই তপন বলেন, চাকরি সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু টাকার ঝামেলার কারণে সেদিন শেখ সেলিমকে থানায় আনা হয়েছিল। সেখানে হাসান সিকদারও উপস্থিত ছিলেন। পরে তারা চলে যান। হাসান সিকদার টাকা পাবেন বলে স্বীকার করেছেন শেখ সেলিম। কিন্তু জিডির বদৌলতে কি কাউকে আটক করা যায়?
হাসান সিকদারের দায়ের করা অভিযোগের বক্তব্য ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করেছেন অভিযুক্ত শেখ সেলিম। তিনি গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, চাকরি সংক্রান্ত বিষয়ে হাসান সিকদারের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। সেনাবাহিনীতে কাউকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে টাকা নিয়েছি বলে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তা সত্য নয়। এ অভিযোগ কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। ডিএমপি সদর দপ্তরে অভিযোগ করায় উল্টো হাসান সিকদারই তাকে হয়রানি করছেন বলে অভিযোগ করেছেন শেখ সেলিম। তবে ৩০ জানুয়ারি রাতে মিরপুর থানায় তিনি কেন গিয়েছিলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি।