বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা এবং একইসঙ্গে দাপ্তরিক ভাষা। সব সরকারি অফিস ও কর্মপ্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষায় কার্যক্রম সম্পন্ন হচ্ছে। আমরা বাংলায় কথা বলি। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে মাসব্যাপী বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়ে আসছে। জাতীয় পর্যায়ে অনন্য অবদানের জন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্য থেকে একুশে পদক প্রদান করা হচ্ছে। বাংলা ভাষার উৎকর্ষ বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি কাজ করে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ভাষাকে যে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, আমরা ব্যক্তি পর্যায়ে বাংলার প্রতি কি ততটুকু শ্রদ্ধাশীল? বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের দায়দায়িত্ব কি যথাযথভাবে পালন করছি?
আমাদের প্রতিদিনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা কি লোকদেখানো? ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন কি একটি মাস, একটি দিন বা বিশেষ কিছু অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক? ব্যক্তি, পরিবার, সামাজিক পর্যায়ে ও কর্মক্ষেত্রে দৈনন্দিন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় বাংলা ভাষার প্রতি অনেক ক্ষেত্রে যথাযোগ্য সম্মান, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা তো প্রকাশ পায়ই না, কোনো কোনো সময় অবজ্ঞার ভাবই ফুটে ওঠে।
ভুল বানান, উচ্চারণ ও ইংরেজি ঢঙে বাংলা লেখা ও বলাটা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। প্রাইভেট রেডিও চ্যানেলগুলোয় ইংরেজি-বাংলা মেশানো উদ্ভট উচ্চারণের বাক্যালাপে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় থাকে না। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপকসহ অংশগ্রহণকারীরা ‘গ্রেট’, ‘গুড মর্নিং’, ‘গুড ইভিনিং’, ‘গুড নাইট’ ও ‘বা-বাই’ বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। দশজনের কাছে নিজেকে স্মার্ট হিসাবে তুলে ধরার জন্য খুব সচেতনতার সঙ্গে বাংলার বদলে যতটুকু পারছেন ইংরেজি বলার কসরত করে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে, বাংলা ভাষা তাদের কাছে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়গুলো চিন্তা করেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবাইকে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে বাংলা শব্দের বানান ও উচ্চারণ সম্পর্কে আরও সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন বহুদিন আগেই। তিনি আরও বলেছিলেন, ইদানীং বাংলা বলতে গিয়ে ইংরেজি বলার একটি বিচিত্র প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। জানি না, অনেক ছেলেমেয়ের মাঝে এখন হয়তো এটি সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে গেছে। এভাবে কথা না বললে যেন তাদের মর্যাদাই থাকে না, এমন একটা ভাব।
কোনো ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশের অন্যতম উপায় হলো শুদ্ধ বানান ও উচ্চারণে কথা বলা ও লেখা। শুদ্ধ-অশুদ্ধ যা-ই হোক, আমরা ইংরেজি লেখার সময় অনেক সতর্ক থাকি, পাছে যোগ্যতা ও স্মার্টনেস যদি ক্ষুণ্ন হয়! কিন্তু ভুল বানানে বাংলা লেখায় কারও দক্ষতা, যোগ্যতা নিয়ে সাধারণত কোনো প্রশ্ন তোলা হয় না। আর সেজন্য আমরা অশুদ্ধ উচ্চারণ ও বানানে বাংলা বলছি, লিখছি ও পড়ছি। কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, শোধরানোর তাগিদ নেই, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে একই ভুলের চর্বিত চর্বণ করেই চলেছি।
বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের স্ক্রল ও ফেসবুক পোস্টের দিকে তাকালে বোঝা যায় কত অযত্ন, অবহেলা ও অজ্ঞতার সঙ্গে শব্দ ও বাক্যগুলো লেখা হচ্ছে। যারা এসব করছেন, তারা কিন্তু উচ্চশিক্ষিত এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। অল্প বয়সের শিক্ষার্থী এবং আমাদের মধ্যে যারা সরাসরি লেখাপড়ার সঙ্গে যুক্ত নয়, তারা যখন টিভি চ্যানেলে কোনো লেখা দেখে, পত্র-পত্রিকা পড়ে, তখন ওখানে যেভাবে লেখা থাকে সেটাকে সঠিক মনে করে। ওইসব ব্যক্তির জ্ঞান-গরিমার প্রতি সাধারণের বিশ্বাস এতটাই সুদৃঢ় যে, তারা ভুল বানানে কিছু লিখতে পারেন এমনটি কখনোই ভাবতে পারেন না।
প্রতিনিয়ত ভুলগুলো দেখে আমার মনে হয়েছে, আমাদের অধিকাংশ শিক্ষিত ব্যক্তি ‘র’ ও ‘ড়’-এর উচ্চারণে পার্থক্য বুঝতে পারছেন না। তাই ‘পাড়’-এর বদলে লিখছেন ‘পার’ এবং ‘শাড়ি’র বদলে ‘শারি’, ‘জুয়াড়ি’র বদলে ‘জুয়ারি’। ‘সারি’ ‘সারি’ গাছ, ‘উজাড়’ করা ভালোবাসা হয়ে যাচ্ছে যথাক্রমে ‘শাড়ী’ ‘শাড়ী’ গাছ, ‘উজার’ করা ভালোবাসা, লেখা-‘পড়া’ হয়ে যাচ্ছে লেখা-‘পরা’।
এখন কথা হলো, আমরা কি আসলে এগুলোর শুদ্ধ বানান জানি না? যারা এ ধরনের ভুল নিয়মিত করে যাচ্ছেন, তাদের ভাষাজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা খুবই যৌক্তিক। একই ভুল পুনঃপুন যদি হতেই থাকে, তবে এটাকে অজ্ঞতা হিসাবেই ধরে নিতে হবে। এ ধরনের ভুল চর্চাই একদিন হয়তো সঠিক বলে বিবেচিত হতে থাকবে। কারণ, দশজন যা লিখবেন, বলবেন, পড়বেন, সেটাই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। প্রতিনিয়ত ভুলের সমষ্টি যদি পাহাড়সম হয়ে যায়, তাহলে সবাই মিলে চেষ্টা করেও সে ভুলগুলোকে সহজে সারানো যাবে না।
আরেকটি বিষয় এখানে আলোচনার দাবি রাখে। একই শব্দ বিভিন্নজন বিভিন্ন বানানে লিখে থাকেন। বাংলা বানানে সমতা আনয়নে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও সমন্বয় জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই এখনই সতর্ক হতে হবে, নইলে আমাদের ভাষা প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হতেই থাকবে। একুশের চেতনায় আমাদের শুদ্ধ উচ্চারণে ও শুদ্ধ বানানে বাংলা বলা ও লেখার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কোনো কিছু লেখার আগে সন্দেহ দেখা দিলে অভিধান দেখে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আমাদের অনেকেরই বাংলা বর্ণমালার ক্রম চটজলদি মনে না পড়ার কারণে অভিধান ওলটাতে গিয়ে সময়ক্ষেপণ হয়। তাই প্রত্যেক বাংলা অভিধানের শুরুতে বর্ণমালার তালিকাটি জুড়ে দিলে সাধারণের অনেক সুবিধা হবে।
আমরা অনেকেই উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃ-গোষ্ঠী বোঝাতে ঢালাওভাবে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করে চলেছি। কখনো কী ভেবে দেখেছি, এ ব্যাপারে আমার সংবিধান কী বলছে? একইভাবে মাননীয় সংসদ সদস্যদের অনেক ক্ষেত্রে ‘সাংসদ’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি যখন আমাদের জাতীয় সংসদের স্পিকার ছিলেন, তখন তিনি রুলিং দিয়েছিলেন সংসদ সদস্যদের ‘সাংসদ’ বলার কোনো সুযোগ নেই। বিভিন্ন শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার ভাষার বোধগম্যতাকে দুরূহ করেই চলেছে। এসব বিষয়ে আমরা কতটা সতর্ক?
চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রকৌশলসহ উচ্চশিক্ষায়, বিশেষত বিজ্ঞানের বেশকিছু বিষয়ে বাংলায় লেখাপড়া করা যায় না। ওইসব লেখাপড়ার পর্যাপ্ত পুস্তক বাংলায় প্রণয়ন বা অনূদিত হয়নি। ক্লাসে শিক্ষকরা বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে পাঠদান করেন। এতে অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষে ইংরেজি বই পড়ে বোঝা ও ইংরেজি লেকচার অনুসরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব বিষয়ে বাংলা ভাষায় লেখাপড়া করা যায় সেখানেও পর্যাপ্ত বইয়ের অভাব রয়েছে। পৃথিবীর বড় বড় লেখক, গবেষক, বিজ্ঞানীদের যেসব প্রবন্ধ, নিবন্ধ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হচ্ছে-সাহিত্য, চিকিৎসা, অর্থনীতি, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে প্রতিবছর যারা নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন, তাদের অবদানের বাংলায় অনূদিত সংকলন আমাদের নেই। দু-একজন অনুবাদকের বিছিন্ন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে দু-চারটা বইয়ের অনুবাদ দিয়ে সব শ্রেণির গবেষক, চিন্তক, সংস্কারকের জ্ঞানতৃষ্ণা মেটানো যাবে না। আমাদের অনুবাদকর্মের ওপর জোর ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন ধারাবাহিক ও সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ। আমেরিকার লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন, স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটিসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর অনেক প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন ভাষায় লিখিত পুরোনো আমলের বই ও গবেষণাকর্ম ইংরেজিতে অনুবাদ করে যাচ্ছে। একুশের চেতনায় আমাদের করণীয় হতে পারে উচ্চশিক্ষায় প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পাঠ্যবই, পৃথিবীর তাবৎ ভালো পুস্তক, রচনা, প্রকাশনার বাংলায় নিয়মিত অনুবাদের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
আরেকটি বিষয় এখানে আলোচনা করা যেতে পারে, তা হলো ক্যালিগ্রাফি। এটি শিল্পকলার বহু পুরোনো ও সর্বজনগ্রাহ্য একটি শাখা। এটি পেইন্টিংয়েরই একটি ধারা। আরবি, চীনা ও জাপানি ভাষায় ক্যালিগ্রাফি উৎকর্ষের অনন্য সীমায় পৌঁছেছে। বাংলা ক্যালিগ্রাফিকেও সে পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। এখানে সৃজনশীলতা ও প্রতিভা বিকাশের সুযোগ আছে। বিভিন্ন কথা, বাক্য, শব্দ, উক্তি শৈল্পিকভাবে হরফের মাধ্যমে প্রকাশই হলো ক্যালিগ্রাফি। আর সে ক্যালিগ্রাফি নিজের মাতৃভাষার বর্ণমালায় শোভিত হলে এতে আবেগ ও ভালোবাসা যুক্ত হয়ে ভিন্ন মাত্রা লাভ করে। দেশে বাংলা ক্যালিগ্রাফির অপার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ভাষার মাসেই শুরু হোক দৃষ্টিনন্দন বাংলা ক্যালিগ্রাফির নতুন যাত্রা।
আমাদের দেশের মধ্যবিত্তের বাসাবাড়িতে টিভি চ্যানেলে হিন্দি ও বাংলা সিরিয়ালের কদর দিন দিন বাড়ছে। অনেকেই বলে থাকেন, ওইসব সিরিয়ালে পারিবারিক দ্বন্দ্ব-হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া, পরকীয়া, অন্যের ঘর ভাঙা সম্পর্কিত বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এসব থেকে আমাদের দর্শক কী শিখছেন? সারাক্ষণ যদি টিভিতে ওইসব অনুষ্ঠান দেখা হয় তাহলে তো মনমানসিকতাও ওইভাবেই গড়ে উঠতে পারে। আমাদের সমাজে পারিবারিক অস্থিরতা বৃদ্ধির জন্য ওইসব অনুষ্ঠানকেও অনেকে দায়ী করে থাকেন। আকাশ-সংস্কৃতির যুগে আমরা হয়তো ওইসব অনুষ্ঠানের প্রবেশাধিকার বন্ধ করতে পারব না; কিন্তু তাই বলে চুপচাপ বসে থাকাও যাবে না। উন্নতমানের রুচিসম্পন্ন গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্র তৈরির মাধ্যমে দেশের দর্শকদের মনোজগতে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। স্বাধীনতার পর আমাদের নাটক, বিশেষত টেলিভিশন ও মঞ্চনাটক সৌকর্য ও উৎকর্ষের শিখরে পৌঁছেছিল। দেশের সীমানা অতিক্রম করে সেসবের আবেদন ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। সে সময়গুলোকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। ভাষা আন্দোলনের মাসে আমাদের লক্ষ্য হতে পারে দর্শকদের দেশীয় সংস্কৃতিমুখী করা।
বিশ্বে বাংলা ভাষায় কথা বলা প্রায় ৩০ কোটি মানুষের অর্ধেকেরও বেশির বাস আমাদের এ ভূখণ্ডে। এ দেশের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এক ভাষাতেই মনের ভাব প্রকাশ করছেন। তাই এ ভাষার শ্রীবৃদ্ধি, উৎকর্ষ সাধন, সমৃদ্ধি আনয়নে এ অঞ্চলের সব শ্রেণির মানুষকে, বিশেষত সুধীজনদের অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। বাংলা ভাষাচর্চার মূল কেন্দ্র হবে ঢাকা এবং আমরা হব অন্যদের পথিকৃৎ। এখানেই বাংলা ভাষার সেরা সাহিত্যকর্ম লেখা হবে, বিকশিত হবে এবং এখান থেকেই তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। বাংলা ভাষা নিয়ে সবার আগে অহংকার করবে বাংলাদেশের জনগণ। আর তাই অন্য যে কোনো অঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের তুলনায় আমাদের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ একটু বেশি থাকতে হবে।
সালাহ্উদ্দিন নাগরী : সরকারি চাকরিজীবী