শনিবার ভারতের বেশিরভাগ সংবাদপত্রে প্রথম পাতার বড় খবর ছিল যে এদিনই মহারাষ্ট্রে বিজেপি বিরোধী জোট হয়তো সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে। কিন্তু সেই খবর বহু সাধারণ মানুষ যতক্ষণে পড়া শেষ করেছেন, তার আগেই মুম্বাইয়ের রাজভবনে বিজেপি নেতা দেভেন্দ্র ফাডনবীশ আবারও মুখ্যমন্ত্রীর পদে শপথ নিয়ে ফেলেছেন।
উপমুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন বিরোধী জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টি বা এন সি পি-র বিধায়ক দলের নেতা অজিত পাওয়ার। তিনি আবার এন সি পি প্রধান শরদ পাওয়ারের ভাইপো। তিনি দাবি করেছিলেন যে এন সি পি-র ৫৪জন বিধায়কের সমর্থন রয়েছে তার সিদ্ধান্তের পেছনে। শপথ নেওয়ার পরে বিজেপি দপ্তরে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “মোদী হ্যায় তো মুমকীন হ্যায়”, অর্থাৎ মোদী থাকলে সবই সম্ভব।
বেলা বাড়তেই অবশ্য পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। এন সি পি-র বেশ কয়েকজন বিধায়ক সংবাদসম্মেলনে দাবী করেন যে তারা আসলে উদ্ভব ঠাকরেকে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে সমর্থন জানিয়ে সই দিয়েছিলেন, সেটাকেই অজিত পাওয়ার বিজেপি-র সরকার গঠনের সমর্থনের চিঠি হিসাবে পেশ করা হয়।
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এন সি পি-র বিধায়ক দলের বৈঠক চলছে মুম্বাইতে, যেখানে ৪-৫ জন ছাড়া বাকি সব এন সি পি বিধায়করাই হাজির রয়েছেন বলে সংবাদদাতারা জানাচ্ছেন। শিবসেনা প্রধান উদ্ভব ঠাকরে হয়তো শুক্রবার ঘুমোতে গিয়েছিলেন এই ভেবে যে শনিবার তার নাম মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ঘোষিত হবে। তখন তিনি বুঝতেই পারেননি যে ভোরের মধ্যেই অবস্থাটা রাজনৈতিক সমীকরণটা সম্পূর্ণ বদলে যাবে।
উদ্ভব ঠাকরে যখন ঘুমোচ্ছিলেন, তখন জেগে ছিলেন বেশ কয়েকজন শীর্ষ বিজেপি নেতা। মাঝরাতের পরে এন সি পি নেতা অজিত পাওয়ার সেরাজ্যের রাজ্যপালের কাছে ৫৪ জন বিধায়কের সই সম্বলিত সমর্থনের পত্র তুলে দেন। তার ওপরে ভিত্তি করেই শুরু হয় পরের কয়েক ঘণ্টার নাটকীয় ঘটনাক্রম।
রাত দুটোর কিছু পরে মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল রাষ্ট্রপতি শাসন তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন। ভোর পৌনে ছটায় রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দ সই করেন রাষ্ট্রপতি শাসন তুলে নেওয়ার সেই সনদে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি শাসন তুলে নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার অনুমোদন প্রয়োজন হয়।
এক্ষেত্রে অবশ্য ভোররাতে মন্ত্রীসভার বৈঠক ডাকা হয় নি, ব্যবহার করা হয়েছে আইনের একটি ধারা, যার মাধ্যমে অতি জরুরী পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী নিজেই কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তীতে মন্ত্রীসভায় তা অনুমোদন করিয়ে নিতে পারেন।
বিরোধীরা অবশ্য প্রশ্ন তুলেছে,‘মহারাষ্ট্রে সরকার গঠন কতট অতি জরুরী প্রয়োজন ছিল?’
কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সুরজেওয়ালা টুইট করে প্রশ্ন তোলেন,‘রাষ্ট্রপতি শাসন কখন তুলে নেওয়া হল? রাতারাতি কখন সরকার গঠনের দাবী পেশ করা হল? বিধায়কদের সমর্থনের তালিকা কবে জমা দেওয়া হল? তাদের কী রাজ্যপালের সামনে ব্যক্তিগতভাবে হাজির করা হয়েছিল? চোরের মতো শপথ নেওয়ানো হল কেন?’
শিবসেনার সংসদ সদস্য সঞ্জয় রাউত অভিযোগ করেছেন যে অজিত পাওয়ারের বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী দেভেন্দ্র ফাডনবীশ, সেগুলোকে ব্যবহার করেই ‘ব্ল্যাকমেইল’ করা হয়েছে মি. পাওয়ারকে।
পাল্টা বক্তব্য রেখেছেন কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রী ও বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদও। তার কথায়,‘মহারাষ্ট্রের মানুষ দেভেন্দ্র ফাডনবীশকে মুখ্যমন্ত্রী করার পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন। ভোট প্রচারের সময়ে তাকেই শিবসেনা-বিজেপি জোটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তুলে ধরা হয়েছিল। শিবসেনা এন সি পি কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ম্যাচ ফিক্সিং কেন করতে গিয়েছিল? নিজের স্বার্থে শিবসেনা যে আমাদের সঙ্গে ৩০ বছরের পুরণো সম্পর্ক ভেঙ্গে দিল সেটা কী গণতন্ত্রের হত্যা নয়?’
জোট বেঁধে ভোটে লড়া বিজেপি আর শিবসেনার মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের ফলে জোট ভেঙ্গে যায় আর বিরোধী এন সি পি এবং কংগ্রেসের সঙ্গে নতুন জোট গড়ে শিবসেনা। কিন্তু ঠিক একমাস আগে ভোটের ফল ঘোষণা হলেও কোনও দলই সরকার না গড়তে পারায় সেখানে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়েছিল।
তারপরেই সকাল আটটার সামান্য আগে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন দেভেন্দ্র ফাডনবীশ। উপমুখ্যমন্ত্রী হিসাবে অজিত পাওয়ার শপথ নেওয়ায় প্রথমে মনে করা হচ্ছিল যে এন সি পি কি তাহলে প্রায় মাসখানেকের আলোচনা শেষ মুহুর্তে ভেস্তে দিয়ে বিজেপি-র সঙ্গে সরকার গঠন করে ফেলল?
প্রশ্ন উঠছিল যে এই জোটে কি তাহলে চিরকাল বিজেপি বিরোধী রাজনীতি করে আসা মহারাষ্ট্রের জনপ্রিয় নেতা শরদ পাওয়ারের অনুমোদন রয়েছে?
বেলা বাড়তেই অবশ্য বর্ষীয়ান নেতা শরদ পাওয়ার স্পষ্ট করে দেন যে ভাইপোর উপমুখ্যমন্ত্রী হয়ে বিজেপি-র সরকারের সঙ্গে যাওয়াতে তার অনুমোদন নেই। পরে বিধায়ক দলের নেতার পদ থেকে অজিত পাওয়ারকে সরিয়ে দেয়া হয়।
বিকেলে এন সি পি বিধায়কদের নিয়ে যে দীর্ঘ বৈঠক শুরু হয়, তা রাত পর্যন্ত চলছে। তার মধ্যেই প্রথমে অজিত পাওয়ারকে সমর্থন প্রাথমিক সমর্থন জানিয়েছিলেন যে সব বিধায়ক, তারা সকলেই প্রায় ফিরে এসেছেন।
জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলি ওই বৈঠকের খবর দেখাতে দেখাতে হঠাৎই ছবি দেখায় যে একজন এন সি পি বিধায়ককে বিমানবন্দর থেকে তুলে নিয়ে বৈঠকে হাজির করাচ্ছেন শিবসেনা নেতারা। এই সব নাটকীয় ঘটনার মধ্যেই শিবসেনা সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে সুপ্রীম কোর্টে রাতেই বিশেষ শুনানীর জন্য আর্জি জানিয়েছে । তবে প্রধান বিচারপতি এখনও সে ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নেননি। সূত্র : বিবিসি।