বর্তমানে বাংলাদেশ যখন সাফল্যের সঙ্গে ভ্যাকসিন কার্যক্রম পরিচালনা করে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে, ঠিক তখনই বিশ্বজুড়ে একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনার নতুন ধরন। বাংলাদেশেও করোনার নতুন ধরনের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। দেশে এখন পর্যন্ত ছয়জনের শরীরে মিলেছে যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হওয়া নতুন ধরনের করোনাভাইরাস।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশের চিন্তার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনার এ নতুন ভ্যারিয়েন্ট। যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিলের পর আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও পাওয়া গেছে করোনাভাইরাসের বিপজ্জনক নতুন ভ্যারিয়েন্ট। এটি অবশ্যই একটি উদ্বেগের বিষয়।
সম্প্রতি ভারতের মহারাষ্ট্র, কেরালা ও তেলাঙ্গানায় ‘এন-৪৪০-কে’ ও ‘ই৪৮৪কে’ নামক নতুন ধরনের মিউটেশন পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এ স্ট্রেইন ভারতেই উৎপত্তি লাভ করেছে; যুক্তরাজ্য বা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসেনি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ভারতের এ নতুন স্ট্রেইন/ধরনের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রাপ্ত ধরনের চারিত্রিক কিছু মিল রয়েছে। ‘ই৪৮৪কে’ মিউটেশনের উপস্থিতির কারণে ভারতের নতুন ধরনটির মাঝে ‘প্রতিরোধ ক্ষমতা এড়ানোর কৌশল’ থাকার আশঙ্কা প্রবল।
এ মুহূর্তে সম্পূর্ণ নিশ্চিত করে কিছু বলা কঠিন হলেও যারা আগে সংক্রমিত হয়েছেন তাদের আবার এ নতুন ধরনটিতে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া নতুন এ ধরনটি টিকার কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে। ভারত বর্তমানে করোনাভাইরাসের নতুন এ ধরনের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে; যা তাদের পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ করতে এবং টিকার কার্যকারিতার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে সাহায্য করবে।
ভাইরাসের নতুন ধরনটি যে অঞ্চলে পাওয়া গেছে, সেই মহারাষ্ট্র ও কেরালায় সংক্রমণ দ্রুতগতিতে ছড়াচ্ছে। যদিও ভারত সরকার বলছে, নতুন ধরন দুটির সঙ্গে দ্রুত সংক্রমণের এখন পর্যন্ত কোনো সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায়নি; কিন্তু ‘এন-৪৪০-কে’ মিউটেশনের উপস্থিতির জন্য এ আশঙ্কা পুরোপুরি নাকচ করে দেওয়া যাচ্ছে না।
করোনাভাইরাস একটি m-RNA ভাইরাস এবং এক্ষেত্রে মিউটেশন হওয়া স্বাভাবিক। তবে অধিকাংশ মিউটেশনই উদ্বেগের কারণ হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এখন পর্যন্ত ভারতে সাত হাজারের বেশি করোনাভাইরাসের মিউটেশন পাওয়া গেছে; কিন্তু এগুলোর মধ্যে কেবল দুটি বিপজ্জনক ধরন (‘এন-৪৪০-কে’ এবং ‘ই৪৮৪কে’) নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
যখন স্পাইক প্রোটিনে মিউটেশন হয় এবং নতুন ধরনটি ভ্যাকসিন প্রতিরোধী হয়ে ওঠে, তখন তা বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের মাঝে এমন বিপজ্জনক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে এবং ভারতের নতুন ধরনটির মাঝে এ বিপজ্জনক চারিত্রিক পরিবর্তনের আশঙ্কা প্রবল।
পাশাপাশি ভারতে কমপক্ষে ছয়জনের শরীরে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট, একজনের শরীরে ব্রাজিলের ভ্যারিয়েন্ট এবং ১৮৭ জনের শরীরে যুক্তরাজ্যের নতুন ধরনের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছে। ভারতে নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তের পরীক্ষা (জিনোম সিকোয়েন্সিং এবং টার্গেটেড পিসিআর) যথেষ্ট পরিমাণে করা হচ্ছে না বলে এ সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করে হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের নতুন ধরনগুলোর ওপর টিকার কার্যকারিতা
যুক্তরাজ্যের নতুন ধরনটির বিরুদ্ধে বর্তমানে প্রাপ্ত সব ভ্যাকসিনই কার্যকর। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে নিয়মিত মানুষ আসা-যাওয়া করে বলে এটি আমাদের জন্য একটি স্বস্তির বিষয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিপজ্জনক হলো দক্ষিণ আফ্রিকা বা ব্রাজিলের ধরনটি। দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনটির ‘ই৪৮৪কে’ নামের একটি জায়গায় মিউটেশন হয়, যার ফলে নতুন ধরনটির মাঝে ‘প্রতিরোধ ক্ষমতা এড়ানোর কৌশল’ রয়েছে। এর ফলে আমাদের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসটিকে সহজে শনাক্ত করতে পারে না এবং ভাইরাসটিকে নিষ্ক্রিয়ও করতে পারে না।
একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফল থেকে জানা গেছে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনের বিপক্ষে কার্যকর নয়। এ কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার তাদের জনগণকে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সম্প্রতি নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনের একটি গবেষণার ফলাফল থেকে জানা গেছে, দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনের বিপক্ষে অ্যান্টিবডি তৈরির পরিমাণ ফাইজারের ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে দুই-তৃতীয়াংশ কমে যায়।
ভারতে অতি সম্প্রতি শনাক্তকৃত করোনার নতুন স্ট্রেইন সম্পর্কে বিশদভাবে মন্তব্য করা কঠিন, তবে ‘ই৪৮৪কে’ মিউটেশনের উপস্থিতির কারণে এর ওপর ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কম হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
একদিকে যেমন অধিক সংক্রমণক্ষম স্ট্রেইন আবির্ভূত হচ্ছে, অন্যদিকে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো তাদের টিকার উন্নয়নে অনবরত কাজ করে চলেছে। মডার্না নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলোর বিপক্ষে অধিক প্রতিরক্ষা দেওয়ার জন্য বুস্টার ডোজ তৈরির পরিকল্পনা করছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা আশা করছে, অক্টোবরের মধ্যে তারা দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের বিপক্ষে কার্যকর ভ্যাকসিন নিয়ে আসতে পারবে।
নতুন এ ধরন শনাক্ত করার উপায়
ভাইরাসের নতুন ধরন শনাক্ত করার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো জিনোম সিকোয়েন্সিং। এ পরীক্ষার মাধ্যমে ভাইরাসের সম্পূর্ণ সজ্জা-বিন্যাস বিশ্লেষণ করে দেখা হয় ভাইরাসের সিকোয়েন্সিংয়ে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না। এরপর পরীক্ষা করে দেখা হয় ভাইরাসটিতে কোনো চারিত্রিক পরিবর্তন হয়েছে কি না। এভাবে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে নতুন ধরন শনাক্ত করা যায়।
‘জিনোম সিকোয়েন্সিং’ করা একটু কষ্টসাপেক্ষ হলেও তুলনামূলক আরেকটি সহজ উপায়ে এ নতুন ধরনগুলোকে শনাক্ত করা সম্ভব। এ পদ্ধতিটিকে বলা হয় ‘টার্গেটেড পিসিআর’। এটি একটি সাধারণ পিসিআর পরীক্ষা, যেখানে কিছু নম্বর টার্গেট করে মিউটেশন শনাক্ত করা হয়। বাংলাদেশে খুব সহজেই টার্গেটেড পিসিআর করে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের মাঝে করোনার নতুন ধরন শনাক্ত করা যেতে পারে।
করোনার নতুন ধরন প্রতিরোধে করণীয়
করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের বিপক্ষে সবচেয়ে কার্যকর উদ্যোগ হলো দেশে বিপজ্জনক এ নতুন স্ট্রেইনগুলোর অনুপ্রবেশ বন্ধ করা। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল থেকে দ্রুত সংক্রমণক্ষম ও ভ্যাকসিন প্রতিরোধী স্ট্রেইন বাংলাদেশে প্রবেশ না করে। এক্ষেত্রে প্রথমেই ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে আসা ব্যক্তিদের নিজ খরচে কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশ ভ্রমণকারীর নিজ খরচে টেস্ট এবং হোটেলে কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করেছে, যাতে খরচের বিষয়টি মানুষকে অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করে।
দ্বিতীয়ত, যারা দ্বিতীয়বার করোনায় আক্রান্ত হবেন, অথবা ভ্যাকসিন দেওয়ার পরও যদি কেউ করোনায় আক্রান্ত হন, তাদের জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে হবে। কারণ, ভাইরাসের কিছু কিছু নতুন ধরন বা মিউটেটেড ভাইরাস মানুষকে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত করা অথবা ভ্যাকসিনকে অকার্যকর করার সক্ষমতা রাখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বের সব দেশকে সিকোয়েন্সিংয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে তাগিদ দিয়েছে।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আমরা যে ভ্যাকসিন পাচ্ছি, তা আমাদের দেশে সংক্রমিত করোনাভাইরাসের বিপক্ষে কার্যকর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মহামারি সৃষ্টিকারী ভাইরাসের ধরন পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। এজন্য প্রয়োজন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মহামারি প্রতিরোধের কৌশলগুলো পরিবর্তন করা। বাংলাদেশ সরকার দ্রুত ভ্যাকসিন অর্জন এবং ভ্যাকসিন বিতরণে বিশাল সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে দ্রুত সংক্রমণক্ষম ও ভ্যাকসিন প্রতিরোধী নতুন ধরনগুলোর অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে সরকারের কার্যকর ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি।
ডা. শাহরিয়ার মোহাম্মদ রোজেন : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; সিনিয়র পলিসি বিশ্লেষক, কানাডা
ডা. নাজিফ মাহবুব : রিসার্চ ও পলিসি অ্যানালিস্ট, সেন্টার ফর রিসার্চ, ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশন, কানাডা