ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) মহাপরিচালক (ডিজি) সামীম মোহাম্মদ আফজলের দেয়া জবাব এবং সময় বৃদ্ধির আবেদন নাকচ করে তার বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার অনিয়মের রিপোর্ট চূড়ান্ত করেছে সিভিল অডিট অধিদফতর। এতে ৯৬ খাতে অনিয়মের টাকার অংশ ১০৩২ কোটি। এর থেকে সরকারি কোষাগারে ফেরত দেয়া ৮২ কোটি টাকা বাদ যাবে। সংশ্লিষ্ট বিশ্বস্ত সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
গত ২৪ নভেম্বর ধর্ম মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রণালয়, ইফা প্রতিনিধির সাথে অডিট টিমের এক বৈঠকে অডিট আপত্তির বিষয়টি চূড়ান্ত হয়।
জানতে চাইলে অডিট টিমের একজন সদস্য এই প্রতিবেদককে বলেন, বৈঠকে মন্ত্রণালয় উপস্থিত থাকায় অডিট আপত্তির ব্যাপারে এগ্রিড মিটিং হয়ে গেছে। এখন রিপোর্ট দেয়া বাকি। মন্ত্রণালয় বৈঠকে অংশ নেয়ায় এই এগ্রিড মিটিংটি সম্পন্ন হয় বলে তিনি জানান। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দেয়া জবাবগুলো দীর্ঘ হওয়ায় তা যাচাই বাছাই করে টাকার অংকের হিসাব মিলিয়ে চূড়ান্ত রিপোর্টটি মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে কিছুটা সময় লাগবে বলেও এই কর্মকর্তা জানান। তবে টাকার অংক বৃদ্ধি বা কমবে কি না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, না দেখে বলা যাবে না।
ইফার সচিব কাজী নুরুল ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার নয়া দিগন্তকে বলেন, অনিয়মের খসড়া অভিযোগের ভিত্তিতে যে জবাব দেয়া হয়েছিল তা গ্রহণ করেনি অডিট দল। একই সাথে ২০ দিন সময় বাড়ানোর আবেদন জানানো হয়েছিল তাও গৃহীত হয়নি। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয়, ইফার প্রতিনিধি সবাই উপস্থিত থাকায় অডিট অধিদফতর অভিযোগগুলোকে চূড়ান্ত বলে সাব্যস্ত করেছে। অডিট অধিদফতর ইফার জবাবের পর তাদের দ্বিতীয় রিপোর্টে অনিয়মের বিষয়গুলো আরো সুনির্দিষ্ট করে প্রতিবেদন আকারে তুলে ধরে। এখন মন্ত্রণালয়কে চূড়ান্ত রিপোর্ট দেবে বলে জানিয়েছে।
অনিয়মের সর্বশেষ টাকার অংকের ব্যাপারে জানতে চাইলে ইফা সচিব জানান, হাজার কোটি টাকা বলতে পারেন। অংক থেকে এ পর্যন্ত যে টাকা জমা দেয়া হয়েছে তা বাদ যাবে।
বুধবারের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ইফার এমন একজন পরিচালক এই প্রতিবেদককে জানান, ১৩৪ খাতে অনিয়মের অভিযোগ ছিল খসড়ায়। কিছু অভিযোগ প্রায় একই ধরনের হওয়ায় খাত কমে ৮৬টি করা হয়েছে। তবে অনিয়মের টাকার অংক বেড়ে ১ হাজার ৩২ কোটি টাকা হয়েছে।
অপর এক পরিচালক জানান, আগের ৭৪ কোটি টাকার পর আরো আট কোটি টাকা জমা দেয়ায় টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৮২ কোটি টাকা। মোট অনিয়মের অঙ্ক থেকে এই টাকা বাদ দিয়েই রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত ২০০৯-১৮ অর্থবছরে ইফার ব্যয়ের বিষয়ে সরকারি নিরীক্ষায় অনিয়মের চাঞ্চল্যকর চিত্র ফুটে ওঠে। চলতি বছরের ৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত নিরীক্ষা চালায় পাঁচ সদস্যের টিম।
অডিট আপত্তি পাওয়ার পর গত ২৩ অক্টোবর ৩১ কোটি ৯৯ লাখ ১৫ হাজার ২২০ টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেন ইফা ডিজি। মসজিদ ভিত্তিক গণশিক্ষা প্রকল্পের টাকায় অনিয়মের অভিযোগের বিপরীতে সোনালী ব্যাংক পাবলিক সার্ভিস কমিশন শাখায় ওই টাকা জমা দিয়ে সরকারি নিরীক্ষক কার্যালয়ের কাছে অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতির অনুরোধ জানান তিনি। এরপর আরো তিন দফায় জমা দেন প্রায় ৪২ কোটি টাকা। সর্বশেষ আট কোটি টাকাসহ মোট ৮২ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার কথা জানা গেছে।
ইফা ডিজি বিশ্বস্তদের দিয়ে তৈরি করে গত ৩০ অক্টোবর নিরীক্ষা আপত্তির জবাব দেন। নিরীক্ষা দল তার জবাবটি পরীক্ষা করে দেখে সর্বশেষ গত রোববার মন্ত্রণালয়ে বৈঠকে বসে। এদিকে ইফা ডিজি বৈঠকে উপস্থিত না থাকলেও তার পক্ষ থেকে ২০ দিনের সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়। কিন্তু বৈঠকে মন্ত্রণালয় ও ইফার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেয়ায় সময় আবেদন নাকচ করা হয়।
গত ১০ বছরে বিধিবহির্ভূত নিয়োগ ও পদোন্নতি, প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ ফেরত না দিয়ে বিদ্যমান আইন লঙ্ঘন, কেনাকাটায় অনিয়ম, অনুমোদন ছাড়া পেনশন ফান্ডে টাকা স্থানান্তরসহ ইফার ৮৬টি খাতে অনিয়মের বিষয়টি অডিট অধিদফতর চূড়ান্ত করে।
এ অডিট আপত্তির ব্যাপারে ইতঃপূর্বে ইফা ডিজি শামীম মোহাম্মদ আফজালের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি মোবাইলে এ ধরনের বিষয়ে কথা বলেন না জানিয়ে লাইন কেটে দেন। গতকাল আবারো এ বিষয়ে জানার জন্য তার দফতরে যোগাযোগ করা হলে তিনি নেই বলে জানানো হয়।
২০০৯ সাল থেকে ইফা ডিজির দায়িত্ব পালন করে আসছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত বিচার বিভাগের কর্মকর্তা সামীম মোহাম্মদ আফজাল। শুরু থেকেই ইফায় গানের আয়োজন করা এবং বিদেশী শিল্পীদের অংশগ্রহণে ব্যালে নৃত্যের আয়োজন, নিয়োগ-পদোন্নতিতে অনিয়মের অভিযোগসহ নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত হয়ে আসছিলেন এই কর্মকর্তা।
অডিট কেন্দ্রিক অনিয়মের বিষয় আলোচনায় আসার আসার আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক ইফা ডিজির ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তলব করে। এ ছাড়া গত জুন মাসে বায়তুল মোকাররম ভবনের একটি পিলার গায়েব হওয়াকে কেন্দ্র করে এক পরিচালককে ডিজি বরখাস্ত করেন। তারপরই অনিয়মের অভিযোগে ধর্ম মন্ত্রণালয় ডিজিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলে তার নানা অনিয়মের বিষয় আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় আসে।
ওই শোকজ নোটিশেও অনিয়মের অভিযোগের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলে ঊর্র্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানোর বিষয় স্থান পায়। পরে অবশ্য ইফা বোর্ড কিছুটা নমনীয় হয় এবং ডিজির কিছু ক্ষমতা কমিয়ে তার চুক্তির মেয়াদ পর্যন্ত দায়িত্ব অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। আগামী ৩১ ডিসেম্বর তার নিয়োগের মেয়াদ শেষ হবে।