ঘরে ঘরে শিশুদের জ্বর-শর্দির খবর পাওয়া যাচ্ছে। যোগ হয়েছে করোনা আতঙ্ক। আর শঙ্কা বাড়িয়েছে ডেঙ্গি। সবমিলিয়ে শিশুর জ্বরজারি হলেই ঘাবড়ে যাচ্ছেন অভিভাবকরা।
কী করতে কী করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। আর অনেকে নিজে নিজে চিকিৎসা দিতে গিয়ে শিশুর বড় ক্ষতি করে ফেলছেন।
শিশুর শরীর খুবই সংবেদনশীল। তাই যেকোনো সমস্যায় তার চিকিৎসা দেওয়ার আগে কয়েকবার ভাবতে হবে।
শিশুর জ্বরের কারণ ও চিকিৎসা নিয়ে যুগান্তরকে পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু হৃদরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সাখাওয়াত আলম
তিনি বলেছেন, জ্বরের কারণ অনুসন্ধান করা গুরুত্বপূর্ণ হলেও, জ্বরের চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য হলো আপনার শিশুর অস্বস্তি বোধ বা ব্যথা হলে তাকে সেটির থেকে আরাম দেওয়া।
জ্বর সাধারণত শরীরের কোনো অসুস্থতা বা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের লক্ষণ। জ্বর সাধারণত ক্ষতিকর নয়। আসলে এটি ভালো লক্ষণ যেটি বোঝায় যে আপনার শিশুর শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কাজ করছে এবং শরীর নিরাময়ের চেষ্টা করছে।
জ্বর কী
শরীরের তাপমাত্রা বয়স, স্বাস্থ্য, দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপ এবং দিনের সময় ভেদে পরিবর্তিত হয়। সাধারণত শিশুদের একটু বড় বাচ্চাদের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা থাকে। আমাদের শরীরের তাপমাত্রা বিকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে সর্বোচ্চ এবং মধ্যরাত এবং ভোরের মধ্যে সর্বনিম্ন থাকে। এমনকি একজন তার শরীরে কতটি পোশাক পরে তার ওপরও শরীরের তাপমাত্রা নির্ভর করে।
জ্বর শরীরের তাপমাত্রা যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। শরীরের গড় তাপমাত্রা 98.6°F (37.0°C) হলেও, সাধারণ তাপমাত্রার সীমা 97.5°F (36.4°C) এবং 99.5°F (37.5°C)-এর মধ্যে থাকে। অধিকাংশ শিশু চিকিৎসকরা তাপমাত্রা 100.4°F (38.0°C) বা তার চেয়ে বেশি হলে সেটিকে জ্বরের লক্ষণ হিসাবে বিবেচনা করেন।
জ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গ
আপনার সন্তানের জ্বর হলে তার শরীর গরম হয়ে যেতে পারে, তার চোখ মুখ লাল হয়ে যেতে পারে এবং সে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘামতে পারে। সে স্বাভাবিকের চেয়ে তৃষ্ণার্ত হতে পারে।
জ্বর হলে কিছু শিশু সেটি অনুভব করতে পারে না। তবে বেশিরভাগ শিশুদেরই জ্বর থেকে হওয়া উপসর্গগুলো দেখা দেবে। আপনার সন্তানের কানের ব্যথা, গলা ব্যথা, ফুসকুড়ি বা পেটে ব্যথা হতে পারে। এ লক্ষণগুলো জ্বরের সূত্রটি বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
চিকিৎসকের পরামর্শ কখন প্রয়োজন
শিশুর জ্বর হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নিশ্চিত করা যে স্বস্তি পাওয়ার জন্য সন্তান পর্যাপ্ত তরল পান করে জলয়োজিত থাকে এবং গুরুতর কোনো অসুস্থতার লক্ষণ আছে কিনা সেটি নিরীক্ষণ করতে থাকা। যদি শিশু ওষুধ খাওয়ার পরে সঙ্গে খেলা করে তবে এটি একটি ভালো লক্ষণ।
শিশুর তাপমাত্রা দেখা
যদিও অধিকাংশ সময় শিশুর মাথায় হাত রেখেই আপনি উষ্ণতা বুঝতে পারেন, তবে একটি থার্মোমিটারই একমাত্র বলতে পারে তাপমাত্রা অধিক কিনা। শিশু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উষ্ণ বোধ করলেও, তার অন্য লক্ষণ না থাকলে তার তাপমাত্রা পরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই।
সন্তানের তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে সর্বদা ডিজিটাল থার্মোমিটার ব্যবহার করুন। পারদ থার্মোমিটার ব্যবহার করা উচিত নয়। অভিভাবকদের পারদ থেকে হওয়া সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য ঘর থেকে পারদ থার্মোমিটারগুলো সরিয়ে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হয়। তাপমাত্রা নির্ধারণের জন্য উপলব্ধ অন্য পদ্ধতিগুলো যেমন প্যাসিফায়ার থার্মোমিটার বা ফিভার স্ট্রিপ উপলভ্য থাকলেও এগুলো এখনই ব্যবহারযোগ্য নয়।
তিন ধরনের ডিজিটাল থার্মোমিটার সম্পর্কিত তথ্য রয়েছে।
ডিজিটাল মাল্টিইউজ থার্মোমিটারগুলো শরীরের তাপমাত্রা নির্ধারণ করে যখন সেটির ডগায় থাকা সেন্সরটি
* শিশুর পশ্চাতে (মলদ্বারে) দেওয়া হয় (নবজাত শিশু থেকে ১ বছর পর্যন্ত)।
* শিশুর মুখের মধ্যে (মৌখিক) দেওয়া হয় (৪ থেকে ৫ বছর বা তার বেশি বয়সি বাচ্চাদের জন্য)।
* বগলের তলায় (অ্যাক্সিলারি) দেওয়া হয় (সব শিশুর জন্য)। তবে, বগলের তলার তাপমাত্রা নেওয়া কম নির্ভরযোগ্য। এই পদ্ধতিটি স্কুল এবং চাইল্ড কেয়ার কেন্দ্রগুলোতে কোনো শিশুর অসুস্থতার অন্য লক্ষণ দেখা দিলে তার তাপমাত্রা পরীক্ষা (স্ক্রিন) করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাপমাত্রা তখন সাধারণ গাইড হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
টেম্পোরাল আর্টেরি থার্মোমিটার : টেম্পোরাল আর্টেরি থেকে নির্গত ইনফ্রারেড তাপ তরঙ্গগুলো পরিমাপ করে, যা ত্বকের ঠিক নিচে কপালজুড়ে চলে। এগুলো তিন মাস বা তার বেশি বয়সি বাচ্চা এবং শিশুদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। নতুন গবেষণা অনুসারে এগুলো নবজাত শিশু বা তিন মাসের কম বয়সি শিশুদের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য হতে পারে।
টিস্প্যানিক থার্মোমিটার : কর্ণশ্রুত দ্বারা প্রকাশিত ইনফ্রারেড হিট ওয়েভসগুলো ব্যাখ্যা করে। এগুলো ৬ মাস বা তার বেশি বয়সি বাচ্চা এবং শিশুদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। ৬ মাসের কম বয়সি বাচ্চাদের পক্ষে এগুলো নির্ভরযোগ্য নয়। বড় বাচ্চাদের ওপর ব্যবহার করার সময় এগুলোর সঠিক পরিমাপের জন্য শিশুদের কানের নালিতে সঠিকভাবে রাখা দরকার। কানের লোম অত্যাধিক থাকলে পরিমাপ ভুল হতে পারে।
জ্বর থেকে সৃষ্টি হওয়া সন্তানের অস্বস্তির চিকিৎসা
শিশুর বয়স যদি ৬ মাসের বেশি হয় এবং তার জ্বর হয়, তবে অস্বস্তি না হওয়া অবধি তার চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। তার আচরণের দিকে নজর রাখুন। যদি তার খাওয়া দাওয়া, পিপাসা এবং ঘুম স্বাভাবিক হয় এবং সে খেলা করে তবে তার জ্বরের চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। বরং, জ্বরটি নিজে থেকেই সেরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা উচিত।
যা করতে পারেন
* তার ঘরটি ঠাণ্ডা রাখুন।
* নিশ্চিত করুন যে সে হালকা পোশাক পরে আছে।
* তাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল যেমন জল বা দোকান থেকে কেনা ইলেকট্রোলাইট তরল দিন।
* নিশ্চিত করুন যেন সে অত্যাধিক পরিশ্রম না করে।
কী করবেন না
* সন্তানের জ্বর বা অস্বস্তির চিকিৎসার জন্য অ্যাসপিরিন ব্যবহার করবেন না। অ্যাসপিরিনে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার আশংকা থাকে যেমন পেট খারাপ, অন্ত্রের রক্তপাত এবং রেই সিনন্ড্রোম। রেই সিন্ড্রোম একটি গুরুতর রোগ যা লিভার এবং মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে।
* সন্তানের জ্বর কমাতে স্পঞ্জিং ব্যবহার করবেন না। শীতল বা ঠাণ্ডা জলে কাঁপুনি হতে পারে এবং সন্তানের তাপমাত্রা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
* জ্বরের চিকিৎসার জন্য কখনই সন্তানের গায়ে অ্যালকোহল জাতীয় দ্রব্য প্রয়োগ করবেন না। অ্যালকোহল জাতীয় দ্রব্য প্রয়োগ করলে সেটি ত্বকের মধ্যে প্রবেশ করে কোমার মতো মারাত্মক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
জ্বর এবং ব্যথার ওষুধ
বাচ্চার মাথা ব্যথা বা শরীরে ব্যথা বা জ্বর থাকলে শিশুকে অ্যাসিটামিনোফেন এবং আইবুপ্রোফেন স্বস্তি দিতে পারে।
* শিশুদের জন্য অ্যাসিটামিনোফেন জলীয় এবং বড়ি হিসাবেও উপলভ্য যা চিবানো যায়। এটি ওষুধের বড়ি হিসাবেও আসে যেটি মলদ্বারে (সাপোজিটরি) দেওয়া হয় যদি শিশুর বমি হয় এবং যদি সে মুখ দিয়ে ওষুধ খেতে অক্ষম থাকে।
* আইবুপ্রোফেন শিশুদের জন্য তরল এবং বড় বাচ্চাদের জন্য চিবিয়ে খাওয়া ট্যাবলেট হিসাবে আসে। মনে রাখবেন আইবুপ্রোফেনের ২ ধরনের তরল ওষুধ হয়, একটি নবজাতকের জন্য এবং অন্যটি শিশুদের জন্য শিশু থেকে ১১ বছর বয়স পর্যন্ত। বড় শিশুদের ওষুধের তুলনায় ছোট শিশুদের ওষুধ বেশি শক্তিশালী (আরও ঘন) হয়।
সন্তানের সঠিক ওষুধের মাত্রার বিষয়ে জানতে আপনার শিশুর চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। যদি শিশু অন্য কোনো ওষুধ গ্রহণ করে তবে উপাদানগুলো যাচাই করে নিন। যদি সেগুলোর মধ্যে অ্যাসিটামিনোফেন বা আইবুপ্রোফেন থাকে তবে সন্তানের চিকিৎসককে সেটি জানান।
জ্বর থেকে হওয়া খিঁচুনি
৬ বছরের কম বয়সি কিছু শিশুদের ক্ষেত্রে জ্বর থেকে খিঁচুনি হতে পারে। এটি ভীতিজনক হলেও, এ খিঁচুনিগুলো সাধারণত ক্ষতিকর নয়। খিঁচুনির সময়, শিশু কিছুক্ষণের জন্য অদ্ভুত হয়ে যেতে পারে, কাঁপতে পারে, এবং তারপর শক্ত হয়ে, ঝাঁকুনি খেতে পারে, এবং চোখ পাকাতে পারে। তার ত্বকের রঙে পরিবর্তন এসে সেটি নীলচে লাগতে পারে। যদি এরকম হয় তবে
* তাকে মেঝে বা বিছানার ওপর শুইয়ে দিন, কোনো শক্ত বা ধারালো বস্তু থেকে দূরে রাখুন।
* তার মাথাটি একপাশে ঘুরিয়ে দিন যাতে মুখ থেকে লালা বা বমি সহজে বেরিয়ে যেতে পারে।
* শিশুর মুখে কিছু রাখবেন না, এমনকি আঙুলও নয়।
* সন্তানের চিকিৎসককে কল করুন।
সন্তানের চিকিৎসক আপনার শিশুর পরীক্ষা করতে চাইবেন, বিশেষত যদি এটি আপনার সন্তানের প্রথমবার জ্বর থেকে খিঁচুনি হয়। জ্বর থেকে খিঁচুনি হওয়ার কারণটি অনুসন্ধান করা গুরুত্বপূর্ণ।
কখন চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন
* শিশুকে দেখতে অসুস্থ, অলস, ও উদ্বিগ্ন লাগে।
* উত্তপ্ত জায়গায় বা উত্তপ্ত গাড়ির মধ্যে সময় কাটিয়ে থাকতে পারে।
* অন্যান্য লক্ষণ যেমন, ঘাড় শক্ত, তীব্র মাথা ব্যথা, গলা ব্যথা, কানে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, ফুসকুড়ি, বারবার বমি বা ডায়রিয়ার মতো লক্ষণ থাকে।
* ইমিউন সিস্টেমের সমস্যা রয়েছে, যেমন সিকেল সেল ডিজিজ বা ক্যান্সার, বা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন করছে যা তার শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
* হৃদরোগের সমস্যা রয়েছে যা তার জ্বরকে প্রভাবিত করতে পারে এবং ফলস্বরূপ তার হৃদ-কম্পন বাড়িয়ে তুলতে পারে।
* খিচুনি রোগ আছে।
* ৩ মাস (১২ সপ্তাহ)-এর চেয়ে কম বয়সি এবং তাপমাত্রা 100.4°F (38.0°C) বা তার বেশি।
* যে কোনো বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা ঘনঘন 104.0°F (40.0°C)-এর ওপরে উঠে যায়।
* জ্বর কমে যাওয়া সত্ত্বেও আপনার শিশু ‘অসুস্থ বোধ’ করে।
* শিশুর অসুস্থতা আরও বেড়ে যাচ্ছে।
* ২ বছরের কম বয়সি শিশুর ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টার ঊর্ধ্বে জ্বর থাকে।
* ২ বছর বা তার বেশি বয়সি বাচ্চার ক্ষেত্রে জ্বর ৩ দিনের বেশি (৭২ ঘণ্টা) স্থায়ী থাকে।