বিষয়টি দুঃখজনক হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। প্রায়ই শোনা যাচ্ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরী পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থান হারাতে যাচ্ছে। বিশ^ অর্থনীতির উদীয়মান শক্তি ভিয়েতনাম বেশ কিছু দিন ধরেই বাংলাদেশের ঘারে নিঃশ্বাস ফেলছিল। আন্তর্জাতিক তৈরী পোশাক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থানকে টপকানোর চেষ্টা করছিল। প্রায় পাঁচ বছর আগে ভিয়েতনাম আন্তর্জাতিক তৈরী পোশাক বাজারে বাংলাদেশকে অতিক্রম করতে ১০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ওই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল ১০ বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরী পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলা। কিন্তু ১০ বছর সময় প্রয়োজন হয়নি। আগেই ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে অতিক্রম করে দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছে। বাংলাদেশ এক ধাপ নিচে নেমে তৃতীয় স্থানে চলে এসেছে।
গত বছর ভিয়েতনাম মোট দুই হাজার ৯০০ কোটি ডলারের তৈরী পোশাক রফতানি করেছে। অন্য দিকে একই সময়ে বাংলাদেশ দুই হাজার ৮০০ কোটি ডলারের তৈরী পোশাক রফতানি করে। আগের বছর বাংলাদেশ মোট তিন হাজার ৪০০ কোটি ডলারের তৈরী পোশাক রফতানি করেছিল। দশ বছর আগে আন্তর্জাতিক তৈরী পোশাক বাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ। তখন ভিয়েতনামের অংশীদারিত্ব ছিল ২ দশমিক ৯ শতাংশ। বর্তমানে বিশ^বাজারে তৈরী পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। আর ভিয়েতনামের অংশীদারিত্ব দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। বিশ^বাণিজ্য সংস্থার সা¤প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। গত বছর বিশ^বাজারে চীন সবচেয়ে বেশি তৈরী পোশাক রফতানি করেছে, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ১৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক তৈরী পোশাক বাজারে চীনের অংশীদারিত্ব হচ্ছে ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ। ভারতও অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশকে টপকে যাওয়ার চেষ্টায় ছিল। কিন্তু সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বরং আরো কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। ইতঃপূর্বে ভারত আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরী পোশাক রফতানিতে তৃতীয় অবস্থানে ছিল। কিন্তু গত বছর ভারতকে টপকে তুরস্ক তৃতীয় স্থানে উঠে আসে।
ভিয়েতনাম যে তৈরী পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অতিক্রম করবে আগেই অনুমান করা গিয়েছিল। কিন্তু সেই অবস্থা মোকাবেলায় তেমন কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। গত বছর ভিয়েতনাম ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে শুল্কমুক্ত জিএসপি সুবিধা পেয়েছে। অন্য দিকে বাংলাদেশ এখনো জিএসপি সুবিধা পেলেও ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ২০২৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে জিএসপি সুবিধা হারাবে। উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে জিএসপি+ সুবিধা প্রদান করবে। কিন্তু জিএসপি+ সুবিধা পেতে মানবাধিকার নিশ্চিত করা ও কার্যকর গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠাসহ যেসব শর্ত পরিপালন করতে হবে বাংলাদেশের পক্ষে তা কঠিন বৈকি। কাজেই এটা মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়, বাংলাদেশ ২০২৭ সালের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেয়া জিএসপি সুবিধা হারাতে বসেছে। অন্য দিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে ভিয়েতনামের অবস্থান আগামীতে আরো শক্তিশালী হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশী তৈরী পোশাক সামগ্রী রফতানির শূন্যস্থান ভিয়েতনাম পূরণ করবে। তখন বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রফতানি নিশ্চিতভাবেই আরো খারাপ অবস্থার মধ্যে পতিত হবে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক সামগ্রীর প্রায় ৬০ শতাংশই যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে।
আমরা যদি নিজেদের তৈরী পোশাক রফতানির ইতিহাস অনুসন্ধান করি, তাহলে দেখতে পাবো, বাংলাদেশ তৈরী পোশাক রফতানি শুরু করে গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে। এরপর এ শিল্পের অগ্রগতি ঘটে অত্যন্ত দ্রæতগতিতে। এ অগ্রাযাত্রার পেছনে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেয়া জিএসপি সুবিধা এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোটা সুবিধা। জিএসপি সুবিধার কল্যাণে ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নে শুল্কমুক্তভাবে বিভিন্ন পণ্য রফতানির সুযোগ পাচ্ছে। প্রতিযোগী বেশির ভাগ দেশকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে তৈরী পোশাক রফতানি করতে হলে ১২ শতাংশ করে শুল্ক দিতে হয়। বাংলাদেশ যেহেতু জিএসপি সুবিধার আওতায় শুল্কমুক্তভাবে পণ্য রফতানি করতে পারে তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমদানিকারকরা বাংলাদেশ থেকে পণ্য, বিশেষ করে তৈরী পোশাক আমদানি করে থাকে। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র কোটা সুবিধার আওতায় প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে তৈরী পোশাক আমদানি করত। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেয়া কোটা সুবিধা বাতিল করে। পরে সীমিত পরিসরে জিএসপি সুবিধা দিলেও তৈরী পোশাক সামগ্রীকে এর বাইরে রাখা হয়। কয়েক বছর আগে শ্রমআইন লঙ্ঘনের অজুহাত তুলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেয়া জিএসপি সুবিধা স্থগিত ঘোষণা করে। ফলে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রফতানি কার্যত ইউরোপীয় ইউনিয়ননির্ভর হয়ে পড়ে। এখন বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেয়া জিএসপি সুবিধাও হারাতে বসেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প মুখ থুবড়ে পড়ার ছাড়া আশঙ্কাই বেশি।
বাংলাদেশের পণ্য রফতানি বাণিজ্য কার্যত তৈরী পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভর করেই টিকে আছে। মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৯৪ শতাংশই আসে তৈরী পোশাক সামগ্রী থেকে। কিন্তু তৈরী পোশাক শিল্পের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সীমিত সংখ্যক দেশের ওপর তৈরী পোশাক রফতানি খাত টিকে আছে। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে শিল্পখাতটি জাতীয় অর্থনীতিতে তুলনামূলকভাবে কম মূল্য সংযোজন করছে। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প মূলত আমদানিকৃত কাঁচামাল এবং ক্যাপিটাল মেশিনারিজনির্ভর। ফলে প্রতি বছর তৈরী পোশাক রফতানি করে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় হয় তার অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশই কাঁচামাল এবং ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানিতে দেশের বাইরে চলে যায়। অর্থাৎ জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের মূল্য সংযোজনের হার ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ। অথচ তৈরী পোশাক শিল্পের কাঁচামাল যদি স্থানীয়ভাবে সরবরাহ করা যেত তাহলে এ খাতের মূল্য সংযোজনের হার অনেকটাই বাড়ানো যেত। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগী দেশগুলো নিজস্ব কাঁচামাল এবং ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ব্যবহার করে তৈরী পোশাক উৎপাদন করছে। ফলে ওই সব দেশ জাতীয় অর্থনীতিতে তৈরী পোশাক খাতের মূল্য সংযোজনের হার বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। ভিয়েতনাম, চীন, ভারত, তুরস্ক প্রভৃতি দেশের তৈরী পোশাক শিল্প প্রায় সম্পূর্ণরূপেই নিজস্ব কাঁচামালনির্ভর। বাংলাদেশ তৈরী পোশাক খাত থেকে মূলত মেকিং চার্জটাই পাচ্ছে। সম্ভাবনাময় নতুন রফতানি গন্তব্য খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রয়েছে দুর্বলতা। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প খাতের রফতানি কার্যক্রম মূলত যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারনির্ভর। কোনো কারণে এ দু’টি বাজার বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প সম্পূর্ণরূপে মুখ থুবড়ে পড়বে। তৈরী পোশাক শিল্পের সম্ভাবনাময় রফতানি বাজার অনুসন্ধানে বাংলাদেশের চরম ব্যর্থতা রয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তৈরী পোশাক মালিকদের পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে কিন্তু তারা এ শিল্পের কার্যকর উন্নয়নের পরিবর্তে নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারেই বেশি ব্যস্ত। কিছু দিন আগে একটি তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল যে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে ৬৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে তাকে। পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির সময় অভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এ অর্থ পাচার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার বন্ধ করা গেলে তৈরী পোশাক শিল্পের আয় আরো বাড়ত।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের আপাতত সাফল্যের মূলে রয়েছে এ দেশের সস্তা শ্রমিকের নিশ্চিত জোগান। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বিশে^র যেকোনো দেশের শ্রমিকদের তুলনায় কম। চীন স¤প্রতি তৈরী পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ব্যাপক পরিমাণে বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী শ্রমিক। তাদের সামান্য কিছু বেতন-ভাতা দিলেই সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করিয়ে নেয়া যায়। চীনে একজন তৈরী পোশাক শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ৫ দশমিক ৫১ ডলার। ভিয়েতনামে এটা ৪ দশমিক ৪২ ডলার। মেক্সিকোতে প্রতিদিন একজন তৈরী পোশাক শ্রমিক মজুরি পান ৪ দশমিক ৪৫ ডলার। বাংলাদেশে একজন তৈরী পোশাক শ্রমিক প্রতিদিন মজুরি পান মাত্র ২ দশমিক ০৮ মার্কিন ডলার। অন্যান্য দেশে তৈরী পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের নানাভাবে সুরক্ষা দেয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এসবের কোনো বালাই নেই।
তৈরী পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকদের প্রাধান্যের এটাই সবচেয়ে বড় কারণ। আসলে তৈরী পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিক নিয়োগের নামে সঙ্ঘাতিকভাবে শ্রম শোষণ চলছে। তৈরী পোশাক শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের সাথে ক্রীতদাশের মতো ব্যবহার করা হয়। তাদের দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে কারখানা মালিকরা শোষণ চালিয়ে যাচ্ছেন। নারী শ্রমিকদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা শ্রম দিয়ে তৈরী পোশাক শিল্প মালিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্ফীত হচ্ছে কিন্তু নারী শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। তৈরী পোশাক শিল্পে কর্মরতদের ক্ষেত্রে দেশের শ্রম আইন কার্যকর হচ্ছে না। নারী শ্রমিকদের নানাভাবে শোষণ করা যায়। তারা শোষিত হলেও দরিদ্রতার কারণে কিছু বলতে বা প্রতিবাদ করতে পারেন না।
বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে জরুরি ভিত্তিতে সম্ভাবনাময় নতুন রফতানি বাজার খুঁজে বের করতে হবে। একই সঙ্গে এই শিল্পের কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে জোগানদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার