মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২৯ পূর্বাহ্ন

প্রতি মণ ধানে লোকসান ৫০০ টাকা

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯
  • ৩১৫ বার

সারা দেশে আমন ধানের বাম্পার ফলন হলেও কাংক্ষিত দাম পাচ্ছেন না কৃষক। সরকার প্রতি মণ ধানের দর এক হাজার ৪০ টাকা নির্ধারণ করলেও সব কৃষক সে সুবিধা পাচ্ছেন না। বাজারে মাত্র পাঁচ শ’ থেকে ছয় শ’ টাকা দরে ধান বিক্রি হচ্ছে। কৃষকদের দাবি, এতে প্রতি মণ ধানে তাদের লোকসান গোনতে হচ্ছে অন্তত ৫০০ টাকা। প্রতি বিঘায় এ লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। ফলে উৎপাদন খরচ উঠাতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়েছেন কৃষক।

যশোরের কৃষক আলী হোসেন বলেন, সাধারণত আমন আবাদ বৃষ্টির পানি দিয়ে হয়ে থাকে। অথচ এ বছর পুরো মওসুমে সেচ দিয়ে চাষ করতে হয়েছে। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পরই অধিকাংশ আধাপাকা ধান পড়ে যায়। ফলে ধানে চিটা বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, যেখানে বিঘাপ্রতি ২০ থেকে ২২ মণ করে ধান হওয়ার কথা সেখানে ১৬ থেকে ১৭ মণ ধান উৎপাদন হয়েছে। যে কারণে লাভ তো দূরের কথা উৎপাদন খরচও উঠছে না।

ময়মনসিংহের গৌরীপুরের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকায়। গেল বছর একই সময় প্রতিমণ ধানের দর ছিল ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা। চাষিদের মতে, এবার এক মণ ধান উৎপাদনে বীজ বপন থেকে ঘরে তোলা পর্যন্ত দিনমজুরি ও সার-কীটনাশকসহ প্রায় ৭০০ টাকা খরচ হয়। অথচ গতকাল বুধবার এক মণ ধান ৫৫০ টাকায় বিক্রি হয়। এক মণ ধান বিক্রির টাকায় মাত্র তিন কেজি পেঁয়াজ কেনা যাচ্ছে।

বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার কালিকাপুরের চাষি দুদু মিয়া জানান, বাজারে ধান বিক্রি করে প্রতি বিঘায় কমপক্ষে তিন থেকে চার হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে।
পাবনার সদর উপজেলার তারাবাড়িয়া গ্রামের কৃষক নাজিম উদ্দীন জানান, প্রতি মণ ধান কমপক্ষে ৯০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হলে কিছুটা লাভ থাকে। কিন্তু বর্তমান বাজার দরে উৎপাদন খরচ অনুযায়ী প্রতি মণে তার ২০০ টাকা করে লোকসান গুনতে হচ্ছে।

যশোর থেকে আমাদের সংবাদদাতা শেখ জালাল উদ্দিন জানান, যশোরে মাঠের পর মাঠ সোনালী ধান মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে। এ বছর আমনের ফলনও ভালো। কৃষকের ঘরে উঠতে শুরু করেছে আমন ধান। তবে ফলন ভালো হলেও দাম নিয়ে হতাশ তারা। হাসি নেই কৃষক-কৃষণীর মুখে। কাক্সিক্ষত দাম পাচ্ছে না তারা। সরকারিভাবে এক হাজার ৪০ টাকায় প্রতি মণ ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও সব কৃষক সে সুবিধা পাচ্ছেন না। আর এ সুযোগে ফড়িয়ারা ধানের দাম বলছে সাড়ে পাঁচ শ’ থেকে ছয় শত টাকা। কৃষকদের দাবি, এ হিসাবেই প্রতি মণ ধানে তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে অন্তত ৫০০ টাকা। প্রতি বিঘায় এ লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে চার-পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। চাষিদের দাবি প্রশাসনের মনিটরিং থাকলে কৃষক লাভবান হতেন।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, চলতি মওসুমে যশোর জেলার আট উপজেলায় আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল এক লাখ ৩৪ হাজার ৯৭৫ হেক্টর। চাষ হয়েছে এক লাখ ৩৯ হাজার ১২৫ হেক্টর। যশোরের বিভিন্ন হাঁট ঘুরে জানা গেছে, বর্তমানে যশোরে মানভেদে প্রতি মণ আমন ধান বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকায়।

যশোর কেশবপুরের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, তারা কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। এখন প্রতিমণ জামাইবাবু ধান তারা কৃষকের কাছ থেকে কিনছেন ৫০০ টাকা আর ২৮ ধান কিনছেন ৬০০ টাকা ধরে। তবে পুরনো ২৮ তারা কিনছেন ৮০০ টাকা দরে। কৃষক হাসান আলী বলেন, এত কম দামে ধান বিক্রি করে তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। কৃষক ওমর আলী বলেন, বিঘাপ্রতি ধান আবাদে তার খরচ হয়েছে ১০-১২ হাজার টাকা। বর্তমান বাজারে এক বিঘা জমিতে উৎপাদিত ধান বিক্রি করতে পারছেন ৮-৯ হাজার টাকায়। এতে তার ক্ষতি হচ্ছে অন্তত দুই থেকে তিন হাজার টাকা। কেশবপুরের গোপসেনা গ্রামের কৃষক হযরত আলী বলেন, ফলন ভালো হয়েছে। তবে বাজারে ধানের দাম নেই। তবে ধান মজুদ করতে পারলে হয়তো লাভ হতো। কিন্তু সে উপায় না থাকায় বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের উপপরিচালক শেখ এমদাদ হোসেন বলেন, আমন ধানের ফলন এবার ভালো হয়েছে। তবে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম না পেলে কৃষকরা ধান আবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।

ময়মনসিংহ থেকে আমাদের সংবাদদাতা সাইফুল মাহমুদ জানান, ময়মনসিংহে আমন ধানের বাম্পার ফলন হলেও কৃষকরা এবারো ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। চলতি আমন মওসুমের ধানকাটা বেশ কিছুদিন আগে শুরু হলেও ধানের বাজারদর ক্রমেই নি¤œমুখী। নতুন ধান বাজারে আসার আগে ধানের যে দাম ছিল, তার চেয়েও কমদামে এখন বেচাকেনা হচ্ছে। বর্তমানে জেলার হাটবাজারে প্রতি মণ ধান ৫৫০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফলে চাষিদের প্রতি মণ ধান উৎপাদনে দেড় শ’ টাকার বেশি লোকসান গুনতে হচ্ছে।

আগামীতে ধানের পরিবর্তে লাভজনক শস্য চাষ করবেন বলে জানান কৃষকরা। গৌরীপুর উপজেলার অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা নিলুফার ইয়াসমিন জলি জানান, সরকারিভাবে প্রতি কেজি ধান ২৬ টাকা দরে ক্রয়ের জন্য দুই হাজার ১৩৫ জন কৃষককে লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত করা হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে এক মেট্রিক টন করে ধান ক্রয় করা হবে।

গত মঙ্গলবার ফুলপুর উপজেলার সিংহেশ্বর বাজারে পাজাম প্রতি মণ ৯০০ টাকা, তুলসীমালা ১৫০০ টাকা ও মোটা ধান ৬৩০ টাকায় বিক্রি হয়। চানপুর গ্রামের কৃষক তজিম উদ্দিন ৬৩০ টাকা দরে ধান বিক্রি করেন। সিংহেশ্বর গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন ৯০০ টাকা দরে পাজাম ও ১৪ শ’ টাকা দরে তুলসীমালা ধান বিক্রি করেন। গতকাল বুধবার ফুলপুরের আমুয়াকান্দা বাজারে পাজাম ৯০০ টাকা, তুলসীমালা ১৪ শ’ টাকা ও মোটা ধান ৬১০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়। গড়পয়ারী গ্রামের কৃষক আশরাফ আলী ৬১০ টাকা দরে মোটা ধান বিক্রি করেন।
গফরগাঁও উপজেলার দীঘা পুলিয়াদী গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মজিবুর রহমান জানান, তাদের গ্রামে ফড়িয়ারা প্রতি মণ ধান ৭৫০ টাকা দরে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ফুলবাড়িয়া উপজেলার কমলাপুর গ্রামের কৃষক হযরত আলী জানান, তিনি ৬২০ টাকা দরে ব্রি-৪৯ ধান বিক্রি করেছেন। তাদের গ্রামে মতিন নামে সরকারি দলের একজনকে ধান বিক্রির কার্ড দেয়া হয়েছে। ওই গ্রামে ভোটার হচ্ছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার।

ভালুকা উপজেলার মামারিশপুর গ্রামের বর্গাচাষি বারেক ও হুমেদ আলী জানান, স্থানীয় বাজারে তারা বিআর-৪৯ প্রতি মণ ৫৫০ টাকায় বিক্রি করেছেন। প্রতি কাঠা জমিতে তিন মণ করে ধানের ফলন হয়েছে। ৫৫০ টাকা দরে ১৬৫০ টাকা বিক্রি হয়। এই পরিমাণ ধানের উৎপাদন খরচ হয়েছে এক হাজার টাকার কিছু বেশি। ধোবাউড়া উপজেলার সিংগুরা গ্রামের কৃষক সগীর হোসেন প্রতি মণ তুলসীমালা ধান এক হাজার ৩৫০ টাকা এবং ব্রি-৪৯ ৬০০ টাকায় বিক্রি করেছেন। মুন্সিরহাট গ্রামের জুবায়ের সোহাগ ব্রি-৫১ ধান প্রতি মণ ৫৩০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। এবারো ধানচাষে তার কোনো লাভ হয়নি। ধান ব্যবসায়ী দুলাল আহমদ শরিফ জানান, প্রতি মণ মোটা ধান ৫৮০ টাকা, চিকন ধান ৬০০-৭০০ টাকা এবং চিনিশাইল ১৩০০-১৪০০ টাকা দরে কিনছেন।

বগুড়া থেকে আমাদের সংবাদদাতা আবুল কালাম আজাদ জানান, বগুড়ায় নতুন আমন ধানের উপযুক্ত দাম না পেয়ে কৃষকের মাথায় হাত পড়েছে। কারণ উৎপাদন খরচ পাচ্ছেন না তারা। নন্দীগ্রাম উপজেলা সংবাদদাতা ফজলুর রহমানের তথ্য মতে, নন্দীগ্রাম উপজেলা সদর, রনবাঘা, কুন্দাহাট, ওমরপুরহাট ঘুরে দেখা গেছে, বিআর-৪৯ জাতের এক মণ ধানের দাম ৬৮০ টাকা থেকে ৭২০ টাকা, বিআর-৩৪ জাতের ধান ১৪৫০-১৬৫০ টাকা, মিনিকেট ১০০০-১১০০ টাকা দরে বেচাকেনা হচ্ছে। বিশেষ করে বিআর-৪৯ ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। এক দিকে এবার উৎপাদন কম হয়েছে অন্য দিকে দামও কম। ফলে এ ধান চাষ করে কৃষক হা-হুতাশ করছেন। উপজেলার রিধুইল গ্রামের জয়নাল আবেদীন, কৈগাড়ী গ্রামের মজিবর রহমান, কাথম গ্রামের আব্দুল মতিন, কালিকাপুরের দুদু মিয়া জানান, বাজারে ধান বিক্রি করে প্রতি বিঘায় কমপক্ষে তিন থেকে চার হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে। এ দিকে সরকারি গুদামে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা হলেও তা দেয়াটা কঠিন। এ ছাড়া বরাদ্দের পরিমাণও কম। জেলার শেরপুর, ধুনট, সোনাতলা ও সারিয়াকান্দি উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজার ঘুরেও ধানের দামের একই চিত্র দেখা গেছে। কাক্সিক্ষত দাম না পেয়ে কৃষক চোখে আঁধার দেখছেন।

পাবনা থেকে আমাদের সংবাদদাতা এস এম আলাউদ্দিন জানান, চলতি বছর পাবনার বৃহত্তর চলনবিল ও গাজনার বিলে প্রচুর পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ফলন ভালো হয়েছে। বর্তমানে ৭০০ টাকা মনে ধান বিক্রি হচ্ছে। যা খরচের তুলনায় কম। প্রতি মণ ৯০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হলে তাদের খরচ উঠে কিছুটা লাভ থাকে। কিন্তু ৭০০ টাকায় বিক্রি হওয়ায় তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। পাবনার চাটমোহর হাটের ধান ব্যবসায়ী আজিজুল হক জানান, চলতি বছর তারা রোপা আমন ও সাধারণ আমন ক্রয় করছেন প্রতি মণ ৭০০ টাকা দরে। সদর উপজেলার কৃষক আব্দুল গফুর জানান, সার, বিষ ও চাষাবাদে তার যে পরিমাণ খরচ হয়েছে তাতে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি করায় অনেক লোকসান গুনতে হচ্ছে। এ ছাড়া পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, চাটমোহর, সুজানগর ও ঈশ্বরদীর বিভিন্ন হাট-বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে গত কয়েক দিন নতুন ধান বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা দরে।

সুনামগঞ্জ থেকে আমাদের সংবাদদাতা তৌহিদ চৌধুরী জানান, কৃষকরা হাড়ভাঙা পরিশ্রমে দাদন এবং মহাজন থেকে ঋণ করে জমি চাষ করলেও ধান কাটার শুরুতেই বহু কৃষক উঠান থেকেই প্রতি মণ ধান ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকা দরে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কৃষক তোফায়েল আলম ছানা মিয়া জানান, ধান কাটার পারিশ্রমিক হিসেবে অর্ধেক ধান নিয়ে গেছে শ্রমিকরা। ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় ছেলেমেয়ের জামা-কাপড় কেনায় তিনি হিমশিম খাচ্ছেন। কৃষক রহমত আলী বলেন, আগুন্যা (অগ্রহায়ণ) ধানতো কমবেশি কাটছি, কিন্তু আমরা তো সরকারি গুদামে ধান দিতে পারছি না। ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দরে ধান বিক্রি করতাছি। কৃষক তোফায়েল মিয়া বলেন, ১০৪০ টেকা মণ ধানের সরকারি দাম, আমরা দুই মণ ধান বিক্রি করেও ১০৪০ টাকা পাইছি না। এলাকাবাসী জানান, সুনামগঞ্জ হাওরাঞ্চলের প্রায় ২০ লাখ সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কান্না আজো কেউ শোনে না। সীমাহীন বৈষম্য আর উন্নয়নবঞ্চিত এ অঞ্চলের মানুষগুলো ডুবে আছে অন্ধকারে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com