গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহ দেখে সবাই নিশ্চিত ছিল যে, ক্ষমতা তালেবানের হাতেই যাচ্ছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি? ভাবেননি কেউই। শেষ কয়েকদিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল তালেবান বাহিনী। তারই চ‚ড়ান্ত রূপ দেখা গেল গত ১৫ আগস্ট। ২০ বছর পর আফগানিস্তানে ক্ষমতা কার্যত দখল করে নিল তালেবান। হার মেনে বর্তমান সরকার দ্রæত ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হয়ে গেল কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। পদত্যাগ করলেন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। বিশ্ব রাজনীতির টানটান এক চিত্রনাট্যের সামনে বসে হাঁ হয়ে রইল দুনিয়া।
প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির পদত্যাগের পরই আফগানিস্তানে কার্যত তালেবান রাজত্ব শুরু হয়ে গেছে। তালেবানের পক্ষ থেকে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে মোল্লা আবদুল গনি বরাদারের নাম শোনা যাচ্ছে। দক্ষিণ আফগানিস্তানে অধিকাংশ তালেবান সামরিক কর্মকাণ্ডের অধিনায়ক গনি।
এপ্রিলের শুরুতে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। ৩১ আগস্টের মধ্যে সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা বলা হয়। তার পর থেকেই মাথাচাড়া দেয় তালেবান জঙ্গিগোষ্ঠী। একের পর এক নগর, জনপদ দখল করতে শুরু করে। ৩১ আগস্টের আগেই দখল করে নেয় আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলও। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে তালেবানের আফগানিস্তান কব্জা করার ঘটনাটি বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে।
আমেরিকান অস্ত্রে সজ্জিত আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা তিন লাখের মতো। বিমানবাহিনীও রয়েছে তাদের। অন্যদিকে তালেবানে যোদ্ধার সংখ্যা ৬০ থেকে ৮০ হাজারের মতো। কোনো ইউনিফর্ম নেই, সিংহভাগ যোদ্ধার পায়ে জুতো পর্যন্ত নেই। কিন্তু তাদের চাপে তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ছে আফগান বাহিনীর প্রতিরোধ। যা সত্যিই বিস্ময়কর।
টুইন টাওয়ারে হামলার প্রতিশোধ নিতে রাতারাতি সৈন্যসামন্ত নিয়ে আফগানিস্তানে এসেছিল বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশ আমেরিকা। মূলত আল কায়েদা এবং তাদের আশ্রয়দাতা তালেবান নিধনের লক্ষ্যেই আফগানিস্তানে পা রেখেছিল আমেরিকা। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে কোটি কোটি ডলার খরচ করে, হাজার হাজার জওয়ানের দেহ কফিনবন্দি করে, দেশের ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধ শেষ করে খালি হাতেই আফগানিস্তান থেকে ফিরতে হচ্ছে আমেরিকাকে।
পেন্টাগন থেকে এখন পর্যন্ত যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে সে অনুযায়ী, গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে যুদ্ধের পেছনে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে আমেরিকা। এর মধ্যে কেবল আফগান সেনাকে প্রশিক্ষণ দিতেই খরচ হয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। আর সরাসরি যুদ্ধে তাদের ৮১ হাজার ৫৭০ কোটি ডলার খরচ হয়েছে।
২০০৯ সালে আফগানিস্তানে সেনা বাড়িয়ে ১ লাখ করেন আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। আফগান সেনা এবং পুলিশ মিলিয়ে তালেবানের বিরুদ্ধে আমেরিকার হয়ে লড়াইয়ে নামে ৩ লাখ সেনা। আমেরিকার সেনাদের মধ্যে ২ হাজার ৪৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে আমেরিকায়। বেসরকারি সংস্থা থেকে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে আফগানিস্তানে গিয়ে প্রায় ৪ হাজার জন মারা গিয়েছেন। গুরুতর আহত হয়ে ফিরেছেন ২০ হাজার ৬৬৬ জন।
দুদশক আগে আমেরিকার নেওয়া একতরফা সিদ্ধান্তে শুধু আমেরিকাই নয়, আফগানিস্তানেরও প্রভ‚ত ক্ষতি হয়েছে। নাইন-ইলেভেনের হামলায় যদি তিন হাজার নিরীহ মানুষের প্রাণহানি হয়ে থাকে, গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৪৭ হাজার নিরীহ মানুষ। তালেবান, মুজাহিদিন বা অন্য কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যাদের কোনো সংযোগ ছিল না। আফগানিস্তান নিয়ে খবর করতে গিয়ে ৮০ জন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। আবার যুদ্ধক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতে গিয়ে ৪০০-র বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন। এই যুদ্ধে কতজন আফগান সেনা মারা গেছেন, তার কোনো সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। তবে গত ২০ বছরে প্রায় ৭০ হাজার আফগান সেনা মারা গিয়েছেন বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের অনুমান।
২০১৩ সাল থেকে আফগানিস্তানে প্রায় ২৭ হাজার বোমা নিক্ষেপ করেছে আমেরিকা। এর মধ্যে গত বছরই ৭ হাজার ৪০০ বোমা নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু সবকিছুর ফলাফল : আফগান শাসক আশরাফ গনি, আমেরিকা এবং ন্যাটোকে হটিয়ে ২০ বছর পর আবার কাবুলে তালেবান শাসন কায়েম।
কিন্তু এত অর্থ, বোমা-অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, ত্যাগের পরও ‘সর্বশক্তিমান আমেরিকা’ তালেবানকে কেন রুখতে পারল না? বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগানিস্তানে আসলে অহংয়ের লড়াই লড়তে গিয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু তালেবানের কাছে তা ছিল শিকড় রক্ষার লড়াই। তাই যতবার আঘাত নেমে এসেছে, ভ‚পতিত হয়েও বারবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তারা। গুলি-বোমায় একজন তালেবান মারা গেলে তার জায়গায় আরও ১০ জন এগিয়ে এসেছেন।
তালেবানের কৌশলও যুক্তরাষ্ট্র ধরতে পারেনি। তারা জানত আমেরিকা এক সময় আফগানিস্তান ছাড়বেই। শুধু সময়ের অপেক্ষা করছিল তারা। ১০ বছর ধরে এই কৌশল নিয়েই ধীরে ধীরে এগিয়েছে তালেবান। আমেরিকানদের কৌশল ছিল আফগানিস্তানের প্রধান শহরগুলোকে কব্জায় রাখা। কিন্তু শহরের বাইরে গ্রামগঞ্জ তালেবানের নিয়ন্ত্রণে থেকে গিয়েছিল। তার পর এক সময় যখন আমেরিকা আফগান সেনাবাহিনীর ওপর নিরাপত্তার দায়িত্ব ছেড়ে দিতে শুরু করল, তালেবান তখন আস্তে আস্তে শহরগুলো নিশানা করতে শুরু করে।
হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত আফগান সেনাবাহিনীর অস্ত্র, শক্তি ও প্রশিক্ষণ কোনো কাজে লাগেনি। কারণ তারা নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান ছিলেন না। তাদের অনেকের সঙ্গেই ছিল তালেবানের গোপন যোগাযোগ। গত দুমাস ধরে হাজার হাজার আফগান সৈনিক লড়াই না করে তালেবানের হাতে অস্ত্র, যানবাহন, রসদ, ইউনিফর্ম তুলে দিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক ভিডিও পোস্টে দেখা গেছে, আত্মসমর্পণের পর অনেক সৈনিক তালেবান যোদ্ধাদের আলিঙ্গন করছে।
আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা দখল মোটেও আকস্মিক নয়, বরং পরিকল্পিত। তালেবান মূলত জাতিগত পশতুন এবং কট্টর সুন্নি ওয়াহাবি ভাবধারার একটি গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত হলেও কয়েক বছর ধরে তারা আফগানিস্তানের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে কাছে টানার চেষ্টা করছে। নানা কারণে হতাশ তাজিক, তুর্কমেন এবং উজবেক গোষ্ঠী নেতাদের অনেকেই তালেবানে যোগ দিয়েছেন। যার ফলে তালেবান তাদের চিরাচরিত প্রভাব বলয়ের বাইরেও নিয়ন্ত্রণ আরোপের শক্তি অর্জন করেছে। শুধু সাধারণ যোদ্ধাই নয়, বর্তমানে তালেবানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশই তাজিক, উজবেক, তুর্কমেন এবং হাজারা স¤প্রদায়ের। চলতি বছর জানুয়ারিতে তালেবানের শীর্ষ নীতিনির্ধারণী পরিষদ, যেটি রাহবারি শূরা বা কোয়েটা শূরা নামে পরিচিত, তাতে কমপক্ষে তিনজনকে নেওয়া হয়েছে, যারা জাতিগত পশতুন নন। স¤প্রতি অনেকগুলো প্রদেশে তালেবানের পক্ষ থেকে ছায়া গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যারা জাতিগত পশতুন নন।
তালেবানকে নিয়ে ভ্রান্ত কিছু ধারণা আন্তর্জাতিক বাহিনীর সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। তারা ভেবেছিল তালেবান অনেকগুলো গোষ্ঠীর একটি নড়বড়ে কোয়ালিশন, যারা শুধুই স্থানীয়ভাবে শক্তিধর। কিন্তু বাস্তবে তালেবান খুবই শক্তিধর একটি সংগঠন, যাদের জুতসই কৌশল রয়েছে, পরিকল্পনা রয়েছে এবং সমন্বয় রয়েছে। তাদের গোয়েন্দা তৎপরতা এবং প্রোপাগান্ডা খুবই কার্যকরী। স্থানীয় কমান্ডারদের যথেষ্ট স্বাধীনতা রয়েছে, ফলে পরিস্থিতি বুঝে তারা দ্রæত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
তা ছাড়া আফগানিস্তানের অনেক মানুষ এখনো তালেবানের সমর্থক। পাকিস্তানে পশতুনদের মধ্যে তালেবানের বেশ সমর্থন রয়েছে, ধর্মীয় অনেক গোষ্ঠী তাদের সমর্থক। টাকা-পয়সাও দেয় তারা। পাকিস্তানের ভেতর আফগান শরণার্থী শিবির এবং পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে অনেক মাদ্রাসা থেকে তালেবান যোদ্ধা নিয়োগ করে। কাবুলে পাকিস্তানবান্ধব একটি সরকার প্রতিষ্ঠা এবং আফগানিন্তানে ভারতের প্রভাব খর্ব করা পাকিস্তানের বহুদিনের কৌশলগত একটি নীতি, যা থেকে পাকিস্তান কখনই সরেনি। পাকিস্তান মনে করে তালেবান তাদের সেই উদ্দেশ্য সাধনে প্রধান সহযোগী। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চীনের সমর্থন। তালেবানকে সমর্থন প্রদানের মাধ্যমে ভারতকে শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ চীনও হাতছাড়া করতে চায় না।
কাবুলে ক্ষমতা সংহত করার পর তালেবানের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, তারা আফগানিস্তানে ইসলামি আমিরাত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তবে তালেবান মুখপাত্রদের কেউ কেউ বলেছেন, তারা ‘ইসলামিক আমিরাত’ প্রতিষ্ঠার ধারণা থেকে কিছুটা সরে এসে ‘ইসলামিক নেজামত’ প্রতিষ্ঠার অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এই ব্যবস্থায় একদিকে রাষ্ট্রের জন্য এক ধরনের ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ কাঠামো থাকবে, আর রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা করবে প্রতিনিধিত্বশীল জিরগা বা সংসদীয় ব্যবস্থাভিত্তিক সরকারকাঠামো। অন্তর্ভুক্তিমূলক এই ব্যবস্থার আওতায় পশতুন তাজিক উজবেক নির্বিশেষে সব জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা আফগানিস্তান শাসনে অংশীদার হতে পারে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি থাকবে তালেবানদের হাতে।
তবে আফগানিস্তানে তালেবান উত্থানে অনেক প্রশ্ন আন্তর্জাতিক মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে। তালেবানের ক্ষমতা পাকাপোক্ত হওয়ার পর দেশে দেশে কি আবার আল কায়েদা, আইএসসহ স্থানীয় উগ্রবাদী গ্রæপগুলোর পুনঃউত্থান ঘটবে? ২০ বছর আগের মতোই অন্ধকার ফিরবে আফগানিস্তানে? আবারও কি বোরকা ছাড়া বাইরে বেরোতে পারবেন না নারীরা? আবারও কি বন্ধ হবে স্কুল, বিজ্ঞান শিক্ষা? পুরুষের পাশে নারীরা হাঁটলে আবারও কি জুটবে ‘তালেবানি’ ফতোয়া? নাকি এক পরিবর্তিত মৌলবাদী শাসন দেখবে আফগানিস্তান? নতুন নেতৃত্ব কি নতুন পথে চলবে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে অপেক্ষায় থাকতে হবে।
চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক