কারাগারে বন্দীদের জন্য প্রতিদিন সরকারি বরাদ্দের ভাত-মাছ-গোশতসহ যেসব খাবার দেয়া হচ্ছে তার মানে সন্তুষ্ট নন বন্দীরা। তাই এ খাবার গ্রহণে বেশির ভাগই অনিচ্ছা প্রকাশ করছেন। ফলে যাদের সামর্থ্য রয়েছে তাদের অধিকাংশই কারাক্যান্টিন থেকে টাকা দিয়ে বাড়তি দামে খাবার কিনে খাচ্ছেন বলে জানা গেছে। দেশের বিভিন্ন জেলার কারাগারে খবর নিয়ে এ তথ্য জানা গেছে।
সম্প্রতি ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে সরেজমিন খোঁজ নিতে গিয়ে কারাগারের বাইরে অপেক্ষমাণ তাদের স্বজনদের সাথে আলাপকালে সরকারি খাবার গ্রহণে বন্দীদের অনীহার কথাটি জানা যায়। তবে শুধু যে এ দু’টি কারাগারে সরকারি খাবার গ্রহণে বন্দীদের অনীহা রয়েছে তা নয়, বরং চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারসহ অন্যান্য কারাগারের বন্দীরাও সরকারি বরাদ্দের খাবার ঠিকমতো খেতে পারছেন না বলে কারাগার সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে কারাগার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কারা অধিদফতর থেকে সরকারি বরাদ্দের দেয়া খাবারের মান সঠিকভাবে যাচাই ও মনিটরিং করে সরবরাহ করা হলে সেই খাবারে বন্দীদের কিছুটা হলেও আগ্রহ বাড়তে পারে। পাশাপাশি কারাগারের ভেতরে কারাক্যান্টিন থেকে যেসব পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে সেগুলোর দাম বাজারমূল্যে বিক্রি নিশ্চিত করার নির্দেশনা কারা অধিদফতর থেকে দেয়া হয় তাহলে অসহায় বন্দীরা কিছুটা হলেও খাবারের কষ্ট থেকে বেঁচে যাবেন।
সম্প্রতি গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে সরেজমিন খোঁজ নিতে গেলে কারাগারের সামনে অপেক্ষমাণ দু’জন বন্দীর জামিনে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা এক নারী এ প্রতিবেদককে বলেন, কারাগারে এক মাস ৫ দিন ধরে আমার স্বামী এবং ভাই কোটালীপাড়ায় একটি মারামারির মামলায় কারাগার আটক আছেন। তাদের দু’জনেরই জামিন হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় তারা মুক্তি পাচ্ছেন। তাদের নেয়ার জন্য আমরা পরিবারের সবাই অপেক্ষা করছি। কারাগারে এ কয়দিন থাকার কারণে কী পরিমাণ টাকা খরচ হয়েছে আর সরকারিভাবে বন্দীদের যে খাবার দেয়া হচ্ছে তার মান কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারাগারে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। মাছ তরিতরকারি কিনে খেতে হয়। সকালের নাশতায় এক পিস রুটি আর একটু গুড় দেয়। তাতে হয় না কিছুই। এক প্লেট খিচুড়ি আর একটা সিদ্ধ ডিম। সেটিই মনে হয় ৫০ টাকা প্লেট করে নেয়। সেটা খায় সকাল বেলায়। আর দুপুর বেলা মাছ গোশত যা ভালো লাগে সেটি কিনে খায়। সরকারিভাবে যে খাবার দেয় তা কি খাওয়া যায় নাÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সেই খাবার একেবারে নিরামিষ। ডাল দেয়। এ সময় পাশে দাঁড়ানো অপর এক নারী জানান, ডাল একদম পাতলা। পানি ডাল। আর ভাত ‘এত্তো বড় বড়’। বড় বড় মানে জানতে চাইলে বলেন, মোটা মোটা চালের ভাত। এটা খেতে অনেক কষ্ট হয়। বেশির ভাগ দিন শুধু তরকারিই রান্না হয়। মাছ কোনো দিন দেয়, আবার কোনো দিন দেয় না। খাবার দাবার ভালো হয় না। বুঝেন না, সরকারি খাবার তো। অনেক কষ্ট হয় খাবার দাবারে। মাসে কত টাকা খরচ হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাসে আমরা যখন দেখা করতে আসি তখন বিস্কিট, কলা, সিগারেট এখান থেকে কিনে দেই। সাথে পিসি অ্যাকাউন্টে ১০০০-১৫০০ টাকা দিয়ে যাই। সেটা দিয়ে এক সপ্তাহ তারা খায় দু’জনে। নগদ টাকা দিয়ে শুধু তরকারি আর সকাল বেলার নাশতা তারা ভেতরে কিনে খায়। বাকি তেল সাবানসহ সবই আমরা কিনে দেই। যদি ভালো বিছানায় ঘুমাতে চায় তাহলে বেড ভাড়া এক হাজার টাকা দিতে হয়। এক মাস পাঁচ দিনের মধ্যে আমরা প্রতি সপ্তাহে দুই দিন করে আইছি। অনেকবার দেখা করেছি। ১০ টাকা করে টিকিট কেটে কথা বলছি। ভেতরে কী ধরনের কষ্ট হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের তারা বলেছেন শুধু খাবারেই কষ্ট বেশি হয়।
মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে খোঁজ নিতে গেলে সেখানে অপেক্ষারত নয়ন নামে একজন ব্যক্তি এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি এক মাস আগে এই কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছি। আমার সহযোগী কেস পার্টনার এখানে আছে। তার সাথে দেখা করলাম। ভেতরের অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারাগার তো কারাগারই। এখানে তো সমস্যা থাকবেই। তারপরও জেলার সাহেব আগে থেকে দুর্নীতি অনেক কমিয়ে এনেছেন। সরেজমিন দেখা যায়, বন্দীর সাথে স্বজনদের সাক্ষাৎ করতে কোনো টাকা নেয়া হচ্ছে না। আগে ২০ টাকা করে নেয়া হতো। আগতরা লাইন ধরে স্লিপ কেটে সাক্ষাৎ করছেন। যাওয়ার আগে তল্লাশি করা হচ্ছে।
কারাগারের প্রধান গেটের সামনে অপেক্ষায় আছেন সম্প্রতি মানিকগঞ্জ মহাসড়কে বাসের ধাক্কায় এক রিকশাচালক নিহতের ঘটনায় আটক চালকের মা ও শ্বশুর। তারা এ প্রতিবেদককে বলেন, কারাগারতো বাবা কারাগারই। সমস্যা থাকবেই। শুনছি ভেতরে খাবার দাবারেই বেশি সমস্যা। দুই মাস ধরে পোলায় ভেতরে আছে। সরকারি খাবার কেমন দেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তারা বলেন, সরকারি খাবারের মান কারাগারে আর কত ভালো হবে? তারপরও আমরা আর কিই করতে পারব। আমরা তো গরিব মানুষ। আমরা পোলারে জামিনে বের করার চেষ্টা করছি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিভাগের ডিআইজি প্রিজন টিপু সুলতানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি, যার কারণে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। কারাগার সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু ঢাকা বিভাগের দু’টি কারাগারেই সরকারি খাবারের মান খারাপ তা কিন্তু নয়। চট্টগ্রাম ডিভিশনের চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারসহ অধিকাংশ কারাগারেই সরকারিভাবে সরবরাহ করা চাল-ডালসহ নিত্যপণ্যের মান খুবই খারাপ।
এ প্রসঙ্গে সাবেক ডিআইজি প্রিজন্স মেজর সামছুল হায়দার সিদ্দিকী (অব:) নয়া দিগন্তকে বলেন, কারাগারে সরকারি বরাদ্দের যে খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে সেটির মান সঠিকভাবে কর্তৃপক্ষ যাচাই করে দিলে অসহায় বন্দীদের কিছুটা হলেও উপকার হবে। এতে তারা উন্নতমানের খাবার খেতে পারবেন। কারণ অনেক বন্দীই আছে, যারা পিসির অ্যাকাউন্টে জমা টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় খাবার কিনে খেতে পারেন না। শুধু তাই নয়, একই সাথে কারাক্যান্টিন থেকে যেসব পণে বিক্রি হচ্ছে সেগুলোও যাতে বাজারমূল্যে বিক্রি করা হয়, সেটিও কারা অধিদফতর থেকে মনিটরিং হওয়া উচিত। কারণ এটি করা হয়েছে শুধুমাত্র বন্দীদের কল্যাণের জন্য।
উল্লেখ্য, গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত কারাগারের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য মোতাবেক কাশিমপুর মহিলা কারাগারসহ সারা দেশের ৬৮ কারাগারে মোট বন্দীর সংখ্যা ৮৮ হাজার ২৩৬ জন। আইজি প্রিজন্সের দায়িত্বে রয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশা। গত বুধবার আইজি প্রিজন্সের সাথে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ প্রতিবেদকের দেখা হলে তিনি গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারের বিষয়টি অবগত রয়েছেন এবং বিষয়টি তিনি দেখছেন বলে জানান।