কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তির আশা ছেড়ে দিয়েছে বিএনপি। দলের নেতারা বলছেন, এখন তাদের সামনে একটি পথই খোলা আছে, তা হচ্ছে রাজপথের আন্দোলন। কিন্তু সেই আন্দোলনের সফলতা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে দলটির মধ্যে। দেশের বিদ্যমান অবস্থায় কোনো কারণে আন্দোলন ব্যর্থ হলে দল হিসেবে বিএনপির ‘টিকে’ থাকাই কঠিন হবে বলে মনে করেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কোনো কোনো নেতা।
যদিও দলটির নেতাদের আশা ছিল চাপমুক্ত থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত অসুস্থ খালেদা জিয়াকে মানবিক কারণে হলেও জামিন দেবেন। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন শুনানি শেষে খারিজ করে দেন। এতে দলের নেতাকর্মীরা আশাহত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেন, সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে জাতি স্তম্ভিত হয়েছে। যে রায় হয়েছে সেই রায়ে আমরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ। জাতি পুরোপুরিভাবে স্তম্ভিত শুধু নয়, ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, যে প্রত্যাশা মানুষের মধ্যে ছিল অন্তত সর্বোচ্চ বিচারালয়, যা আমাদের শেষ আশা-ভরসার স্থল, যেখান থেকে প্রিয় নেতা ন্যায়বিচার পাবেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি সেই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
দলের নেতারা মনে করেন, খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যাওয়ার পর যৌথ নেতৃত্বের নামে দল পরিচালিত হচ্ছে। এই যৌথ নেতৃত্বে রয়েছেন লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির নেতারা। অনেকেই মনে করেন এই যৌথ নেতৃত্ব খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সফল হয়নি। খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপির প্রতিটি সিদ্ধান্তই ভুল প্রমাণিত হওয়ায় নেতাকর্মীদের মনোবল এখন শূন্যের কোঠায়। এই অবস্থায় আগামীর কর্মসূচি ঠিক করাসহ জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক অথবা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিশেষ সভা ডাকার দাবি উঠেছে দলের মধ্যে।
দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরামের গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতা আমাদের সময়কে বলেন, তিন মাস পর পর বিএনপির নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডাকার কথা থাকলেও ২১ মাসেও কোনো বৈঠক হয়নি। তাই নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডাকার আগে ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, থানা, উপজেলা, পৌর, জেলা ও মহানগর কমিটির বৈঠক ডাকতে হবে। একই কার্যক্রম অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বেলায় হতে হবে। পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে যদি কাউন্সিল করা না যায়, বিশেষ সভা ডেকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নতুন নেতৃত্ব ঠিক করতে হবে।
তবে রাজধানী ঢাকার নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করা না গেলে কাক্সিক্ষত সফলতা আসবে না বলে মনে করেন ওই দুই নেতা। তারা বলেন, ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডকে উজ্জীবিত করতে হবে। এ জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের বিক্ষিপ্ত না থেকে যে কোনো কর্মসূচি পালনে ওই ওয়ার্ডের বিএনপির নেতৃত্ব মানতে হবে। সেভাবে কাজ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ঢাকা মহানগরের কমিটি গঠনে ঢাকার স্থানীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি যেসব এলাকার লোকজন ঢাকায় বেশি এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করে, বিশেষ করে এমন বৃহত্তর বরিশাল, নোয়াখালী, কুমিল্লার নেতাদের কমিটি গঠনে গুরুত্ব দিতে হবে। এসব না মানার কারণেই ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ মহানগর তথা বিএনপি আন্দোলনে সফল হচ্ছে না।
জানতে চাইলে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু আমাদের সময়কে বলেন, ‘রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে এবং রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে আন্দোলন করা যায় না। এভাবে স্বৈরাচারের হাত থেকে অতীতে কোনোদিন গণতন্ত্র মুক্ত হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। ঘরে ঘরে বসে জেলায় জেলায় বিক্ষোভ করে কোনো লাভ হবে না। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হলে এক দফার আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই।
এখন কী করবেন জানতে চাইলে সাবেক এই উপমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তো নীতিনির্ধারণী ফোরামের নেতা না। তবে দলের কত নম্বরে আছি, জানি না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়ও ডাকা হয় না। নির্বাচনে না যাওয়ার জন্য বলেছিলাম। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ, সংসদে শপথ নেওয়া এবং আন্দোলন না করা সবই ছিল ভুল। আমরা যারা সত্য কথা বলি তাদের বৈঠকেও ডাকা হয় না। যৌথ সভায়ও আমাদের ডাকা হয় না।’
এদিকে নীতিনির্ধারণী ফোরামের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না দলের নেতাকর্মীরা। কেউ কেউ দাবি তুলেছেন দ্রুত নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডাকতে। দীর্ঘদিন নির্বাহী কমিটির বৈঠক না ডাকায় দলীয় ফোরামে কথা বলতে না পারায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান মামুন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, অবিলম্বে করণীয় ও কৌশল নির্ধারণে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা আহ্বানের প্রস্তাব করছি।
দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা আমাদের সময়কে জানান, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান থাকেন লন্ডনে। তার পক্ষে দেশের বাস্তব চিত্র জানা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। স্থায়ী কমিটি অথবা অন্য কোনো মাধ্যম তারেক রহমানকে যেসব তথ্য দেন, তার ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত দেন তিনি। ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছাড়া দলের ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিবসহ সম্পাদকম-লীর সমন্বিত কোনো সভা হয় না। বেশিরভাগ নেতাই দলের কর্মকা- সম্পর্কে জানতে পারেন না। এমনও অনেক নেতা আছেন গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে অথবা কোনো জুনিয়র নেতার কাছে বিএনপি কী করবে তার খোঁজ জানতে চান।
জামিন না হওয়ায় কারাগারেই থাকতে হচ্ছে খালেদা জিয়াকে- এ অবস্থায় বিএনপি কী করবে অথবা চিন্তা করছে জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, এখন আমরা কী চিন্তা করছি তা সময় এলেই জানা যাবে। তবে এরই মধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আগামী রবিবার ঢাকায় থানায় ও সারাদেশে জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছি। এর পর আলাপ-আলোচনা করে পর্যায়ক্রমে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি দেব। চেয়ারপারসনের মুক্তির দাবিতেই আমরা আন্দোলন করব।
দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামের একাধিক নেতা জানান, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘মহাসমাবেশ’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। পুলিশের অনুমতিসাপেক্ষে চলতি মাসে এই সমাবেশ করতে চাইছে দলটি। ২৯ অথবা ৩০ ডিসেম্বর এই সমাবেশ করতে চান তারা।
ভাইস চেয়ারম্যান ও যুগ্ম মহাসচিব পর্যায়ের দুই নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সমাবেশ করে কী হবে। তার আগে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের উজ্জীবিত করতে হবে। কৃষক দল, তাঁতী দল, শ্রমিক দল, মৎস্যজীবী দলের নেতারা কে কী করছেন, যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলকে আরও কীভাবে সক্রিয় করা যায় তা নিয়ে কাজ করতে হবে। তারেক রহমান ছাড়াও ঢাকায় অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের দেখভাল করতে কয়েক নেতাকে দায়িত্ব দেওয়ার পক্ষে তারা। সেটাও দ্রুত ঠিক করতে হবে। রাজপথের আন্দোলন তো সব সময় তরুণরাই করে। অঙ্গ সংগঠনগুলো সাহস করে না নামলে কোনো আন্দোলন সফল হবে না।
আন্দোলনের সফলতা নিয়ে কোনো শঙ্কা আছে কিনা জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মোশাররফ হোসেন বলেন, দেখেন গত বুধবার খালেদা জিয়ার জামিন আদেশ খারিজের আগের দিন সুপ্রিমকোর্ট এলাকায় কে বা কারা মোটরসাইকেলে আগুন দিয়েছে, সেখানে বিএনপির সব সিনিয়র নেতাসহ সক্রিয় সবার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। শুধু মামলাই দেয়নি, নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি করছে। এটা একটি স্বৈরাচারী দেশ, এখানে গণতন্ত্রের কোনো স্পেস নেই। এর মধ্য দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাব। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে বিএনপির পক্ষে আন্দোলন সফল করা সম্ভব কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আন্দোলন সফল হওয়ার নজির আছে। এ দেশেও সফল হবে। তা সময়ের ব্যাপার, জনগণই সফল আন্দোলন করবে।