ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তে মুসলিম অধ্যুষিত কয়েকটি প্রদেশের সমন্বয়ে মুসলিম লীগের দাবি বহুলাংশে পূরণে গঠিত হয় মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি। অবস্থানগত কারণে ঐতিহাসিকভাবেই অঞ্চলটি ছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের বহিঃআক্রমণকারীদের ভারতে প্রবেশ দুয়ার।
প্রাচীন দ্রাবিড় বা সিন্ধু সভ্যতার সিন্ধুতেই অবস্থিত মহেঞ্জোদারো (অর্থাৎ মৃতের স্তূপ) হতে ৪০০ মাইল দূরের হরপ্পাও পাকিস্তানের পাঞ্জাবে অবস্থিত। এদের বংশজাত ভাষারূপে আজো প্রচলিত পাকিস্তানের একমাত্র, বেলুচিস্তানের ব্রাহুইদের ভাষা। বহিরাগত আর্যরা সর্বপ্রথম উপনিবেশ গড়ে ভারতীয় পাঞ্জাবের হরিয়ানা রাজ্যের আম্বালা জেলায়। এদের সরাসরি বংশধর হলো অধিকাংশ পাঞ্জাবি, যারা আজ হিন্দু, শিখ ও মুসলমানরূপে ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত।
খ্যাতনামা ব্যাকরণকর্তা পাণিনি (খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী) ও নীতিশাস্ত্রবিশারদ চাণক্যেরও জন্ম (খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী) এখানে। এই পাঞ্জাবেরই পাকিস্তানি অংশের রাওয়ালপিন্ডির ঐতিহাসিক তক্ষশীলায় তাদের জন্ম, যেখানে ছিল ভারতের সর্বপ্রাচীন বিদ্যাপীঠ। যোদ্ধার মানদণ্ডে ‘সামরিক জাতি’ বলে শুধু আধুনিক কালের ব্রিটিশরাই নয়, প্রাচীনকালে ভারত আক্রমণকারী গ্রিকদেরকে প্রতিরোধ যুদ্ধের নৈপুণ্য ও সাহসিকতায় তখনকার এশিয়ায় অদ্বিতীয় বলে তাদেরকে স্বয়ং আলেকজান্ডারেরও প্রশংসার উদ্ধৃতি রয়েছে খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট এ স্মিথের The Oxford History of India নামক বইয়ের ৮৭ পৃষ্ঠায়। প্রাচীনকাল হতে অঞ্চলটি কোনো-না-কোনো অংশ হয় পারস্য সাম্রাজ্যের, কখনো গ্রিক, কুষাণ, হুন নয়তো আফগান শাসকদের দখলীয় রাজ্য ছিল। ৭১১-১২ খ্রিষ্টাব্দে আরবরা সিন্ধু দখল করায় তখন থেকে সেখানে ইসলামের প্রসার শুরু হয়।
পূর্বাংশ : (পূর্ববাংলা-পূর্ব পাকিস্তান-বাংলাদেশ) পূর্ব সীমান্তের পূর্বাংশের বহুলাংশই সমুদ্রগর্ভ থেকে উত্থিত ভূ-ভাগ। তথ্য মতে, প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে ভারতের অন্তর্গত বর্তমান পশ্চিম দিনাজপুরের প্রাচীন কোটিবর্ষ বা বানগড় ছিল সমুদ্র তীরবর্তী। পণ্ডিতগণের মতে বাংলার আদিবাসী ওঁরাও, মুণ্ডা, ভূমিজ, মালপাহাড়ি, সাঁওতাল প্রভৃতির দেহে পাওয়া ভেড্ডিড (আদি অস্ট্রেলীয়) উপাদান পরবর্তী বাঙালিদের মধ্যেও পাওয়া। সেই ভেড্ডিড নরমুণ্ডু মহেন জো দারোর ভগ্নস্ত‚পে পাওয়া গেছে। প্রায় হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হওয়া, বর্ধমান জেলার পাণ্ডুরাজার ঢিবি শহরটি একটি বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। তবে সরল বাঙ্গালা অভিধানের ৭৮৯ পৃষ্ঠার ‘পাণ্ডববর্জিত শব্দের অর্থে নিকৃষ্ট’ বলে গঙ্গার পূর্ব তীরবর্তী স্থানকে পাণ্ডববর্জিত দেশ বলা হচ্ছে। মালদহ বা প্রাচীন গৌড়ের প্রায় ২০ মাইল নিম্নে গঙ্গার সৃষ্ট ব-দ্বীপ থেকে গণ্য করা হলে পশ্চিম বাংলার কিছু অংশসহ গোটা পূর্ববাংলাকে ‘নিকৃষ্ট’ বলা হয়েছে। মধ্যযুগের প্রারম্ভ থেকে হিন্দু রাজারা উত্তর ভারত হতে ব্রাহ্মণ এনে নিষ্কর ভূমি দান করে স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থার সাক্ষ্য ইতিহাস। তারা এখানে অন্য সবাইকে শূদ্র বলত। অর্থাৎ মধ্যবর্তী ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বলে দুই বর্ণের অস্তিত্ব স্বীকার করত না। এ ধরনের বিবিধ তথ্য বাঙালির দেহে আর্য রক্ত না থাকারই প্রমাণ বহন করে। বাংলার ইতিহাস কমপক্ষে আড়াই হাজার বছরের। তা হলো আদিবাসী, জৈন, বৌদ্ধ, এককালের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও মুসলমান নির্ভর। ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে মুসলমানদের দখলে যাওয়ার পরে বাংলায় ইসলামের দৃশ্যমান প্রসার ঘটতে শুরু করে। তাই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বহিরাগত মুসলমানের যেমনি রয়েছে সরাসরি বংশধর, তেমনি নিম্নবর্ণের হিন্দু ও বেশির ভাগ বৌদ্ধ ধর্মান্তরিত হওয়ার রয়েছে ঐতিহাসিক তথ্য। এর ফলে ১৯০০ শতাব্দীতেই মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে শুরু করে। জাতি তথা প্রকৃতিগত কারণেই বাঙালিরা এমনকি সন্নিকটের হিমালয় অঞ্চলীয় মোঙ্গল গোষ্ঠীভুক্ত প্রাচীন শাক্য বা লিচ্ছবিদের মতো সাহসী যোদ্ধা জাতি নয় বরং আবেগী ও আরামপ্রিয়।
দুই অংশের একত্রকরণ
প্রায় ৯০০ মাইল দূরত্ব সত্ত্বেও পশ্চিমাংশের সঙ্গে একত্রকরণে বাংলার বিধান সভার মুসলিম সদস্যরা ১৯৪৭ সালে ভোট দেন। এ যেন ১৯১১ সালে বাংলার ভাগ রদের মাত্র ৩৬ বছর পরেই তাদের ভগ্নহৃদয়ের পুনরুদ্ধার। প্রায় হাজার বছরেরও অধিক আগেরকার গ্রাম্য কৃষিনির্ভর প্রাচীন বাঙালি উচ্চ ও দরিদ্রের জীবনদর্শন সম্বন্ধে প্রাকৃত ভাষায় লেখা দুটি পদের প্রথমটি হলো : ‘পুত্ত পবিত্ত বহুও ধনা ভত্তি কুটুংবিনি সুদ্ধ মনা। হাক্ক তরাসই ভিচ্চগনা কো কর বব্বর সর্গগমনা\’ অর্থাৎ পুত্র পবিত্রমনা, অজস্র ঐশ্বর্য, স্ত্রী ও কুটুম্বিনীরা শুদ্ধচিত্ত, হাঁকডাক শুনে ভৃত্যের দল শশব্যস্ত- এই সব ছেড়ে কোনো বর্বর স্বর্গে যেতে চায়?
দ্বিতীয়টি হলো : ‘ধূমেন রিক্তমপি নির্ভর বাস্পকারি দূরীকৃতানলমপি প্রতিপন্ন তাপম। দৈন্যাতি শূন্যমপি ভূষিত বন্ধুবর্গ আশ্চর্য্যমেব খলু খেদকরং। অর্থাৎ দরিদ্রের গৃহ ধূমুশূন্য হইয়াও বাস্প পরিপূর্ণ, আগুন না থাকিলেও তাপ রহিয়াছে, দৈন্যের দ্বারা শূন্য, কিন্তু ভূষিত বন্ধুবর্গের দ্বারা পূর্ণ- ইহাই আশ্চর্য এবং বেদনাপূর্ণ। (ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, প্রথম খণ্ড, পৃ-৭০-৮৫)।
গোটা বাংলায় হাতেগোনা কয়েকজন মুসলমান নবাব ও জমিদারসহ বেশ কিছু সংখ্যালঘু জমিদার ও তাদের স¤প্রদায় ছিল বিত্তবান ও সচ্ছল। পক্ষান্তরে দরিদ্র ছিল বিশেষত নিম্নবর্ণের নমশূদ্ররা, যাদের তুলনায় দরিদ্রতর ছিল প্রায় ৯০ ভাগ মুসলমান। অন্যের মালিকানাধীন ভূমিতে বৃত্তিধারী কৃষির কারণে বহমান দারিদ্র্য মুসলিম শাসনামলে ছিল না। ভারতে ব্রিটিশের শিক্ষা কমিশনের সভাপতি ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার এই রূঢ় সত্যটির স্বীকার করে ১৮৭১ সালে প্রকাশিত তার ‘দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ বইটির ১৩৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘একশ সত্তর বছর আগে বাংলায় কোনো সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তানের দরিদ্র হয়ে পড়া ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার, কিন্তু বর্তমানে তার পক্ষে ধনী হওয়াটাই প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।’ তার ৭৫ বছর পরেও বাঙালি মুসলমানের এই অপরিবর্তিত দুর্দশায় কাদের জন্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া? এমন এক প্রশ্নোত্তরে জিন্নাহর দেয়া ‘সার্বিক উত্তরণের’ উত্তর উদ্ধৃত করেছেন দৈনিক ইত্তেফাকের সাবেক বার্তা সম্পাদক শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন তার ‘ইতিহাস কথা কও’ বইয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় পৃষ্ঠায়। শিক্ষায় পশ্চাৎপদতায় তাদের সরকারি চাকরি প্রাপ্তি প্রসঙ্গেও একই সময়ে হান্টারের মন্তব্য ছিল, There is now scarcely a government office in Calcutta … out of theree hundred boys in the English college (Calcutta). কলকাতায় এমন কোনো সরকারি অফিস এখন দুর্লভ যেখানে কুলি, পিয়ন, দোয়াতে কালি ভরা, পেনসিল কাটা ইত্যাদি পদের চেয়ে মুসলমানরা বেশি কিছু আশা করতে পারে। কয়েক বছর আগেও কলকাতায় ইংলিশ কলেজে ৩০০ ছাত্রের মধ্যে শতকরা একভাগও ছিল না মুসলমান। (১৯৮৫ সালে আমেরিকাসহ বিবিধ দেশে প্রকাশিত ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার প্রখ্যাত সম্পাদক রাজমোহন গান্ধীর ‘‘Understanding the Muslim Mind’’ বই-এর পৃষ্ঠা ৩৩-৩৪)।
কংগ্রেস তথা সংখ্যালঘু কর্তৃক স্বাধীনতা অসমর্থিত হবার পর বাংলার পরিণামে বিভাজ্য পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনও হয় প্রত্যাখ্যাত। অগত্যা মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পাওয়া সুযোগ হারাতে না চাওয়ায় ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের অগ্রাধিকারে হয় একত্রকরণ, যা ছিল সার্বজনীন বাঙালি মুসলমানের প্রত্যাশিত ও সমর্থিত।