আফগানিস্তানে আমেরিকানদের পরাজয়ে বিশ্বের সবাই যে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তা নয়। চীন তো নয়ই। চীন দেখা যাচ্ছে খুশিই হয়েছে। কারণ এ চীন তো আর আগের চীন নয়। মাও সে তুংয়ের চীন একেবারেই নয়। তবে এখনো তারা কমিউনিস্ট পার্টির শাসনেই রয়েছে এবং পার্টি মাও সে তুংকে ভোলেনি বলে জানাচ্ছে। কদিন আগে তারা যে তাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদযাপন করছিলেন, সেই রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে পার্টিপ্রধান শি জিনপিং মাও সে তুংয়ের গলাবন্ধ কোট পরেই উপস্থিত হয়েছিলেন, আশপাশে মাও সে তুংয়ের ছবিও ছিল। কিন্তু সেখানে মাও ছিলেন না। তার আন্তর্জাতিকতা ছিল অনুপস্থিত।
অনুষ্ঠানে দেশপ্রেমিক গান গাওয়া হয়েছে, কমিউনিস্টদের আন্তর্জাতিক গান ইন্টারন্যাশনাল গাওয়া হয়নি এবং বলা হয়েছে, যা হরদমই বলা হচ্ছে- আমরা সমাজতন্ত্রীই। কিন্তু আমাদের সমাজতন্ত্র চীনা সমাজতন্ত্র। পরাধীন ভারতের কংগ্রেসপন্থি অনেক ‘সমাজতন্ত্রী’ও ওই রকমের কথা দর্পের সঙ্গে ঘোষণা করতেন, জানিয়ে দিতেন যে, তাদের সমাজতন্ত্র আমদানি করা জিনিস নয়- খাঁটি দেশি বস্তু এবং যতই ওসব বলতেন, ততই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে পেছনের দিকে ঠেলে দিতেন, যেটি অন্যতম কারণ ভারতে সামাজিক বিপ্লব না ঘটার। চীনের এই জাতীয়তাবাদী কমিউনিজমের আন্তর্জাতিক প্রতিফল এখন খুবই দৃশ্যমান। এটা আমরা টের পেয়েছিলাম ১৯৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়, এখন টের পাচ্ছে সেনা অভ্যুত্থানে পিষ্ট মিয়ানমারের মুক্তি সংগ্রামী মানুষরা; সেনা অভ্যুত্থানকারীদের প্রতি চীন যে কেবল পরোক্ষ সমর্থন জানিয়ে ক্ষান্ত হয়েছে, তা নয়। সম্প্রতি সেখানে ২১টি পরিকল্পনায় তারা অর্থবিনিয়োগ করেছে।
বিশ্বের যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে, চীন এখন বিনিয়োগ করছে; সেই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী-পুঁজিবাদী আদর্শকেও উৎসাহ দিচ্ছে। অসুখও ছড়াচ্ছে। করোনা ভাইরাস তাদের গবেষণাগারে উৎপাদিত হয়েছে কিনা, সে নিয়ে সন্দেহ থাকলেও তাদের দেশ থেকেই যে ছড়িয়েছে- তাতে তো কোনো দ্বিমত নেই। তবে চীন যে নিজের দেশে ওই মহামারীর সুন্দর রকমের মোকাবিলা করতে পারল, এর কারণ তার বর্তমান পুঁজিবাদী চরিত্র নয়। কারণ হচ্ছে কমিউনিজমে তাদের অভিজ্ঞতা। কমিউনিস্ট হয়েছিল বলে চীন যে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উন্নতি, শৃঙ্খলা ও ঐক্য চীনের অর্জনে এসেছে- সেই শক্তিতেই এ সাফল্য। কোভিড-১৯ অসুখটা চীন প্রথমে ধনী দেশগুলোর কাছেই পাঠিয়েছিল। সেখান থেকে তা দরিদ্র দেশে ছড়িয়েছে এবং মানুষকে না ঘটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতোই একটা বিপদে ফেলেছে।
এখন ভয়ঙ্কর রকমের প্রতিক্রিয়াশীল তালেবানের সঙ্গে খাতির জমাতে চীন ত্রুটি প্রদর্শন করছে না। আফগানিস্তানের ওপর সে চোখ রেখেছে। সেখানে বিনিয়োগ করছে, আরও করবে, সে দেশের অব্যবহৃত খনিজসম্পদের উত্তোলনে অংশ নেবে এমন ইচ্ছা, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে আফগানিস্তানে নিয়ে যাবে। চীনের পণ্য বাজার দখল করবে- এ রকমের অভিপ্রায়ও তারা নিশ্চয়ই লালন করছে। চীনের আশাবাদটা হয়তো নিতান্ত অলীক নয়।
পাকিস্তানও মনে হচ্ছে খুশি। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তো বলেই ফেলেছেন, আফগানিস্তান দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙেছে। দাসত্বটা আমেরিকার শাসনের। ‘মুক্ত’ আফগানিস্তানের সঙ্গে এখন ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো জমবে। বিপদের সময় পাকিস্তান তালেবানকে সাহায্য করেছে। আশ্রয়-প্রশ্রয় তো বটেই, অর্থ-সহায়তাও দিয়েছে। এখন ফেরত পাওয়ার পালা। পাকিস্তানের ভেতরে তালেবানের পাকিস্তানি সংস্করণও রয়েছে। উৎফুল্ল হবে তারাই অধিক। তালেবানের আদি লালনভূমি ছিল পাকিস্তানই। সেখানকার মাদ্রাসাগুলোতেই তালেবানের প্রাথমিক শিক্ষা। কিন্তু ইতোমধ্যে পাকিস্তানি ঘরানার তালেবান বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। উগ্রপন্থি জঙ্গিদেরও দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীও, বিশেষ করে তাদের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ, এদের সমর্থক। আর রাষ্ট্র তো পেছন থেকে চালায় সামরিক বাহিনীই। ইমরান খান তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে তবেই ক্ষমতায় এসেছেন এবং টিকে থাকবেন বলে আশা করছেন। তবে মুখ শুকাবে পাকিস্তানের প্রগতিশীল মানুষ ও মেয়েদের। মেয়েদের একাংশ সেখানে অনেক অগ্রসর। কিন্তু তারা জঙ্গি ও মৌলবাদীদের কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তালেবানি নারীবিদ্বেষ চাঙ্গা হলে মেয়েদের নিরাপত্তায় টান পড়বে। এ নিয়ে ইমরান খান যে খুব উদ্বিগ্ন, তা মনে হয় না।
এই সাবেক ক্রিকেট ক্যাপ্টেন অত্যন্ত পিতৃতান্ত্রিক, দেশে-বিদেশে একাধিক বিয়েশাদি করেছেন, বিয়েবহির্ভূত সন্তানের পিতাও হয়েছেন- যে খবর তার স্ত্রীদেরই একজন প্রকাশ করে দিয়েছেন। খান সাহেবের শাসনাধীন রাষ্ট্রে ধর্ষণ বিলক্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ জন্য ধর্ষকদের নয়, মেয়েদেরই তিনি দোষ দিতে পছন্দ করেন। তার দেশের মেয়েদের ধমক দেওয়ার সুরেই তিনি বলেছেন- মেয়েরা যদি খাটো কাপড় পরে, তা হলে তাদের দেখে পুরুষ মানুষ যদি নিতান্ত রোবট না হয়- তবে তো উত্তেজিত হবেই। খান সাহেব পুরুষ মানুষের ভালোই একটা সংজ্ঞা দিয়েছেন। তবে যে পুরুষরা ওইভাবে উত্তেজিত হয়ে আপন আপন পুরুষত্বের পরিচয় জাহির করে, তারা অবশ্যই নত হবে- যদি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শাসন উপস্থিত থাকে। পিটুনি দেয়। শুনেছি ইমরান খান পাকিস্তান সেনাধ্যক্ষ নিয়াজির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, নাকি ভ্রাতুষ্পুত্রই। ওই ‘বাঘা’ নিয়াজি অবশ্য কাঁদতে কাঁদতে একাত্তরে বিদায় হয়েছিলেন ভারতীয় জেনারেলদের পেছনে নিজেকে আবডাল করে। তিনি যখন তার সেনাদের লেলিয়ে দিয়েছিলেন লুণ্ঠন ও ধর্ষণে নিমগ্ন হতে, তখন বাংলাদেশের কোনো নারীই স্বল্পবসনে তাদের সামনে গিয়ে হাজির হননি- উল্টো তাদের ভয়ে বনজঙ্গলে আত্মগোপন করেন, পানাপুকুরে ডুব দিয়ে প্রাণপণে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। হানাদার ওই পুরুষপুঙ্গবরা অবশ্যই ‘উত্তেজনাবিহীন’ হতো- যদি সময়মতো পিটুনি খেত। পিটুনি অবশ্য তাদের দেওয়া হয়েছে। তবে প্রত্যেককে আলাদা করে দেওয়া সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ প্রস্তুত ছিল না। নেতৃত্ব বাঙালিকে প্রস্তুত অবস্থায় রাখেনি। সে দুঃখ ভোলার নয়।
ইমরান খান আর কী কী জানেন, আমরা জানি না। তবে এটা দেখা যাচ্ছে, তিনি জানেন না যে, ধর্ষণ হচ্ছে ক্ষমতার প্রকাশ। ক্ষমতাবান হয়ে বা হতে পেরে পুরুষ মানুষ ক্ষমতাহীন নারীর ওপর পৈশাচিক অত্যাচার করে; কাজটা যতটা না পুরুষসুলভ, তার চেয়ে অনেক বেশি পশুসুলভ। বুঝতে পারি ইমরান খানরাও আসলে তালেবানপন্থিই। যতই আধুনিক হোন, ক্রিকেট খেলুন, ধনী ইংরেজ ঘরের ইহুদি মেয়েকে বিয়ে করুন ও তালাক দিন না কেন। তিনি একজন খর্বাকার মানুষ- তালেবানের মতোই নারীদের যিনি খর্ব করতে চান। এমন পুরুষরা তালেবানকেও হার মানাতে পারে ‘পৌরুষে’র দাপটে। আফগান তালেবান চায় মেয়েরা ঘরে থাকুক। অন্য তালেবানও কম যায় না। সে যাই হোক, তালেবানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে পাকিস্তানে ইসলামপন্থি জঙ্গিদের কিছুটা সুবিধা হবে। তবে সমাজের, এমনকি রাষ্ট্রেরও কোনো সুবিধা ঘটার আশা তো নেই-ই, উল্টো অসুবিধা হওয়ারই কথা। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি না ভাঙলে সে দেশের মানুষের মুক্তি নেই। তবে ভাঙবে যদি সামাজিক বিপ্লব ঘটে, তবেই; নইলে নয়- যে বিপ্লবকে তালেবান ও ইমরান খানরা ঠেকানোর ব্যাপারে একাট্টা।
তালেবানের জয়ে তাই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো পাকিস্তানিরই উৎফুল্ল হওয়ার কারণ নেই। বাংলাদেশে যারা জঙ্গিবাদী, তারা কিছুটা উৎসাহিত বোধ করেছে হয়তো। ভাবছে, তাদের সহযোদ্ধারা আফগানিস্তানে জিতেছে, ভবিষ্যতে তারাও জিতবে, বাংলাদেশে। এটা সত্য যে, বাইশ-তেইশ বছর আগে মুজাহিদরা যখন রুশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়ছিল, তখন নানা দেশ থেকে উগ্র ইসলামপন্থিদের কয়েক সদস্য আফগানিস্তানে গিয়ে হাজির হয় এবং যুদ্ধে অংশ নেয়। বাংলাদেশ থেকেও কয়েক যুবক সেখানে গিয়েছিল। আফগানিস্তানে তারা যুদ্ধ কতটা করেছিল, কে জানে। তবে কেউ কেউ যে বোমা বানানো ও মানুষ খুন করার বিদ্যা রপ্ত করে আসতে পেরেছিল, সেটি টের পাওয়া গেছে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়