শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩০ অপরাহ্ন

প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম ও একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ

ড. মো. খোরশেদ আলম
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১
  • ৫২৭ বার

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত সেই রিপোর্টে বিজ্ঞান শিক্ষার উদ্দেশ্য বলতে লেখা হয়েছিল, ‘বিজ্ঞানের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো সমাজের উন্নতি সাধন করা’ এবং প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষার শেষ ধাপ পর্যন্ত এ লক্ষ্যে কারিকুলামকে সাজানোর কথা বলা হয়েছিল।

সময়ের আবর্তে অনেক শিক্ষা কমিশন বাংলাদেশ পেয়েছে, কিন্তু ড. কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের মতো জনমুখী শিক্ষা কমিশন আর হয়নি। একইভাবে ভারতের কোঠারি শিক্ষা কমিশন (১৯৬৪-১৯৬৬) সম্পর্কেও বলা যায়-উভয় শিক্ষা কমিশন তাদের নিজ নিজ দেশের শিক্ষানীতি প্রণয়নে যে নিষ্ঠা ও প্রজ্ঞা দেখিয়েছিল, তা সেই সময়ের জন্য সত্যিই ছিল বাস্তবমুখী।

আমাদের দেশের সর্বশেষ শিক্ষাক্রমটি ২০১০ সালের, সেখানে বিজ্ঞান শিক্ষার বিষয়ে লেখা আছে, বিজ্ঞান হচ্ছে প্রকৃতিকে অনুধাবন করা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রকৃতির রহস্য উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান মানবসভ্যতাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ‘যথাযথ বিজ্ঞান শিক্ষা’ এ কাজটি ত্বরান্বিত করে-এ কথা বলা হয়েছিল সে রূপরেখায়।

তবে তারপর আমরা ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২০’ হাতে পেয়েছিলাম, সেখানে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সার্বিকভাবে শিক্ষার একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

দেখা গেছে, ভবিষ্যতের জন্য এটিতে সম্পূর্ণ নতুন কিছু দিকদর্শন উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখানে রূপান্তরমূলক দক্ষতার কথা বলা হয়েছে-শিক্ষার্থী বিবিধ বিষয়ের অধীত বিদ্যাকে জীবনের যে কোনো স্তরে এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে কাজে লাগাতে পারবে, জীবিকা নির্বাহ করে খেতে পারবে এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা নেওয়ার জন্য অভ্যস্ত হবে। নিঃসন্দেহে এটি খুব যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত।

সম্প্রতি প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন এনে প্রণয়ন করা শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় অনুমোদন দিয়েছে সরকার। নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা রাখা হয়নি। একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক, নাকি ব্যবসায় শিক্ষায় পড়বে, সেটি ঠিক হবে উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে। অর্থাৎ ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বিষয়ে পড়ানো হবে।

প্রাথমিকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না। পুরোটাই মূল্যায়ন হবে বিদ্যালয়ে ধারাবাহিকভাবে শিখন কার্যক্রমের মাধ্যমে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের বাকি শ্রেণিগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে কিছু মূল্যায়ন শিখনকালীন কার্যক্রমের ভিত্তিতে এবং কিছু অংশের মূল্যায়ন পরীক্ষার মাধ্যমে হবে। আগামী বছর থেকে তা পরীক্ষামূলকভাবে চালু হবে এবং পর্যায়ক্রমে সেটি ২০২৮ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক। পর্যায়ক্রমে আমাদের এ ব্যবস্থায় যেতেই হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণিকক্ষে শিখনকালে বা পাঠদান চলাকালে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক ভিত্তিতে সারা বছর ধরে মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে।

বর্তমান প্রচলিত পদ্ধতিতে প্রথম সাময়িকী, দ্বিতীয় সাময়িকী বা অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে যে মূল্যায়ন হয়, তা অপেক্ষাকৃত গতানুগতিক ও সহজ। কিন্তু শিখনকালে ধারাবাহিক মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি ফলপ্রসূ করার জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ আবশ্যক।

প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরে বিদ্যমান শিক্ষাক্রমটি কোমলমতি শিশুদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে। শ্রেণিগত মূল্যায়ন পদ্ধতি তাদের ওপর অতিরিক্ত মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছে। আরেকটি নেতিবাচক দিক হচ্ছে, অভিভাবকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক ধরনের অশুভ প্রতিযোগিতা, যার চাপ শিক্ষার্থীকেই বহন করতে হচ্ছে। ফলস্বরূপ আনন্দময় শিক্ষার পরিবর্তে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে তৈরি হয়েছে স্কুল বা পরীক্ষাভীতি।

একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার আলোকে মাদ্রাসা ও কারিগরি স্তরেও অভিন্ন পাঠ্যবই থাকবে-এটিও ছিল দীর্ঘদিনের দাবি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষার বদলে শিখনকালীন মূল্যায়ন রাখা হয়েছে ৬০ শতাংশ। মূল্যায়নটি থাকছে শিক্ষকদের কাছে, তাই নতুন শিক্ষাক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়নে বিপুলসংখ্যক শিক্ষককে প্রস্তুত করার একটা চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

তবে যে মহৎ উদ্দেশ্যে ও বাস্তবতার আলোকে এ রূপরেখাটি পর্যায়ক্রমে ২০২২ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে, সে সক্ষমতা আমাদের আছে। এ ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের মূল কারিগর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয়সংখ্যক নতুন শিক্ষক নিয়োগ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রতি যৌক্তিক তদারকি ও নজরদারির ব্যবস্থা রাখতে হবে। তা না হলে এ পদ্ধতি সৃজনশীল পদ্ধতির মতো সম্পূর্ণ সফল নাও হতে পারে।

আমরা যদি একটু বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে বলি-রূপরেখাটি খুব চমৎকার হলেও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কিংবা একুশ শতকের উপযোগী নাগরিক গড়ে তুলতে যেমনটি প্রয়োজন, মাধ্যমিকে বিভাগ উঠিয়ে দিয়ে সেটি একটি চ্যালেঞ্জে ফেলা হয়েছে বলে মনে হয়। নবম-দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা বর্তমান নিয়মে পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের ওপর আলাদা তিনটি ১০০ নম্বরের বই পড়ে এবং গবেষণাগারে সেটি হাতে-কলমে দেখে থাকে।

নতুন পদ্ধতিতে সেটি মাত্র একটি বইয়ে নেমে আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মাত্র একটি বইয়ে বা ১০০ নম্বরের পত্রে, একত্রে পদার্থ-রসায়ন-জীববিজ্ঞান ঢুকিয়ে দিলে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান শিক্ষার বুনিয়াদ দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে দুর্বল বিজ্ঞান শিক্ষা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এবং একুশ শতকের উপযোগী নাগরিক তৈরির জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

নতুন রূপরেখায় ইতিবাচক অনেক বিষয়ের পাশাপাশি বিশেষ করে বিজ্ঞান শিক্ষায় এক ধরনের ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে বলে মনে হয়। উচ্চমাধ্যমিকে যারা বিজ্ঞান পড়বে, তাদের পক্ষে মাধ্যমিকের পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান বিষয়ের সীমিত জ্ঞান নিয়ে উচ্চমাধ্যমিকের পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান আয়ত্ত করা কঠিন হতে পারে, যা শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহী করে তুলতে পারে।

পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো আলাদা গুরুত্বে না পড়িয়ে এগুলোকে পরিবেশের বিষয়ের সঙ্গে, তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়ের সঙ্গে মিলিয়ে-ছড়িয়ে পাঠদান করা হলে তা বিজ্ঞানের মৌলিক জ্ঞান বৃদ্ধিতে কতটুকু সহায়ক হবে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

গত বছর আমরা যখন জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২০ হাতে পেয়েছিলাম, তখন বাংলাদেশ স্টেম ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বিজ্ঞান, প্রকৌশল, গণিত ও কৃষি শিক্ষাকে যৌক্তিকভাবে আরও কিছুটা কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম।

এ আধুনিক শিক্ষাক্রমটি আরও ভালো হতো, যদি এতে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কিত দুটি করে ঐচ্ছিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেত-যাতে করে যে চাইবে সে সেই বিষয়ে অধিকতর জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। ঐচ্ছিক বিষয়ের সুবিধা হলো-মূল সিস্টেমের সুবিধাও সবার জন্য অক্ষুণ্ন থাকবে এবং যারা চাইবে তারা পছন্দের বিষয়ে বাড়তি পড়াশোনা করে তাদের পরবর্তী ধাপের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে পারবে।

আমরা চাই দেশে এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠুক, যাতে আমাদের শিক্ষার্থীরা একুশ শতকের উপযোগী আধুনিক, দক্ষ, শিক্ষিত ও বিকশিত মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠে। জোর করে কাউকে পদার্থবিদ, অর্থনীতিবিদ বা প্রকৌশলী বানানো যাবে না; কিন্তু যে চায় তাকেও একটা সুযোগ দেওয়ার অপশন থাকা উচিত।

তবে এ কথা ঠিক, যে কোনো নতুনত্বই এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। বিশ্বের অন্যান্য দেশে নির্দিষ্ট সময় পরপর বাস্তবতা ও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাক্রম মূল্যায়ন ও যুগোপযোগী করা হয়ে থাকে। আমরা যেহেতু নতুন শিক্ষাক্রমে আগামী বছর থেকে যাওয়ার চিন্তা করছি, তাই বাস্তবতার আলোকে যৌক্তিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে তা সফল হবে বলে প্রত্যাশা করছি।

পরিশেষে বলব, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে নতুন শিক্ষাক্রম এমনভাবে বাস্তবায়িত হোক, যেটি হবে একাধারে আন্তর্জাতিক মানের এবং আমাদের স্থানীয় সমস্যার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। প্রত্যাশা থাকবে, নতুন শিক্ষাক্রম এমন বিশ্বনাগরিক তৈরি করবে, যা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে ভূমিকা রাখবে এবং একইসঙ্গে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকবে।

ড. মো. খোরশেদ আলম : শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com